রফিকুল ইসলাম জসিম,
নিজস্ব প্রতিবেদক>
পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম আজন্ম হয়ে থাকে। কিছু মানুষ চিরদিনের জন্য গেঁথে থাকেন মানুষের হৃদয়ে। সমাজে তাদের নাম বাঁচিয়ে রাখেন চিরদিন। তেমনি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে যারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তাদেরকে আজ মানুষ গড়ার কারিগন হিসেবে এ সমাজে সর্বমহলে শ্রদ্ধার পাত্র।
শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর আজ ৫ অক্টোবর এই দিনটিকে পালন করা হয় ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে। পৃথিবীর সব দেশের শিক্ষকদের নিকট এই দিনটি অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার। এ দিবস উপলক্ষে আজ তুলে ধরবো মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তর করে দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে শিক্ষক যারা অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন তাদের নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন।
বাংলাদেশের মনিপুরি মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রূপকার তথা আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন বাংলাদেশের পাঙালদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট বহুভাষাবিদ ও সমাজসেবক মোঃ আব্দুস সামাদ। বাংলাদেশী মণিপুরিবাসী তাঁকে চেনে “বিএ সামাদ” কিংবা “সামাদ স্যার” নামেই। মানুষ গড়ার কারিগন হিসেবে যিনি এ মণিপুরি মুসলিমের ও দক্ষিণ কমলগঞ্জে সর্বমহলে শ্রদ্ধার পাত্র।
শিক্ষকতা হচ্ছে একটি মহান পেশা এবং পৃথিবীর সকল পেশার সেরা পেশা। শিক্ষকরা হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও। পিতা-মাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই। শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। শিক্ষকরা স্বমহিমায় বিশুদ্ধ জ্ঞান, মানবিক আর নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং দিক্ষীত করে গড়ে তুলেন দেশের যোগ্য নাগরিক। শিক্ষা যেহেতেু জাতির মেরুদন্ড শিক্ষকরা হচ্ছেন এই মেরুদন্ড গড়ার কারিগর।
দক্ষিণ কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে শিক্ষার আল পৌঁছে দিতে মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষিতমহল বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন৷ এই মহান শিক্ষকদের হাতে গড়া বহু শিক্ষার্থী বর্তমান সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন সচিব, যুগ্ম-সচিব, ডিসি, এসপি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়রসহ সমাজের ঊর্ধ্বতন নানা পেশায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
এক সময় মণিপুরি মুসলিমেরা অন্যান্য পেশা না করে শিক্ষকতা তাদের মহান পেশা হিসেবে গ্রহন করেতেন৷ কারণ শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। অর্থাৎ শিক্ষকই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তর করে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়; বরং শিক্ষকতা এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে-যুগে কালে-কালে তাই শিক্ষক জ্ঞানের দীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডার।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের বন্দরগাঁও (ঘোরামারা) গ্রামের মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের পরিবারের জন্মগ্রহণকারী মোঃ আব্দুস সামাদ সহ সেসময় ব্যাক্তিরা ১৯৫৪ সালে তেতই গাঁও রসিদ উদ্দিন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করে৷ তিনি প্রতিষ্ঠা থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহন করে৷ দীর্ঘ ২৪ বছর পর সেখানে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহন করেন৷ তিনি জিকে যুবক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন৷ পাশাপাশি সমিতির মাধ্যমে জিকে ঈদগাহ ও জিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন৷
বন্দরগাঁও (ঘোরামারা) একই গ্রামের মোঃ আব্দুল খালিক সিলেট সরকারি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভের পর তেতই গাঁও রসিদ উদ্দিন বিদ্যালয়ের আমৃত্যু প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ স্কুলের দক্ষ প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন৷
ইসলামিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের পাশ ঘিরে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী দীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আদমপুর বাজার হাফিজিয়া মাদ্রাসা। কোরআন শরীফের খেদমতের লক্ষ্যে ততকালীন উসমান আলী ইসলামীয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রয়াত সুপার মাওলানা ফরিদ উদ্দিন, আমির উদ্দিন, মাও.উসমান, আনোয়ার হোসেন বাবু, ডা.মনির ও হাফিজ জমসেদ আলীর চিন্তাভাবনায় সোয়া দুই শতক জায়গার উপর নির্মিত হয় এই হাফিজিয়া মাদ্রাসা।
পশ্চিম কান্দি গাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণকারী হাফেজ মোঃ জমশেদ আলী তার নিরলস প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি আজ স্বমহিমায় উদ্বাসিত। সর্বজনশ্রদ্বেয় হাফেজ মোঃ জমসেদ আলী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি প্রধান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন৷ দীর্ঘ ২৫-২৬ বছর ধরে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সুনাম ছড়াচ্ছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর বাজার হাফিজিয়া মাদ্রাসা।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত গোলের হাওর গ্রামে মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষা গ্রহনের পর পাকিস্তানের লাহোরে উচ্চশিক্ষার শেষে নিজ গ্রামে ফিরে এসে আদমপুরে উসমানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন এবং ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন৷ এছাড়াও বর্তমানে মুফতি খুবাইব আহমাদ জাহাঙ্গীর ইসলামপুর গোলের হাওর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী তিনি মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) ও দারুস সালাম ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন।
নিজ নিজ পেশার মান-মর্যাদা জীবনের মর্যাদার মতোই মূল্যবান। পেশার মর্যাদা শুধু জীবনের মর্যাদা বৃদ্ধি করে না, মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগায়, সমাজকেও পথ দেখায়। শিক্ষক সমাজ এখন এমন অনুকরণীয়, অনুসরণীয় পথের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
-এটি