রফিকুল ইসলাম জসিম,
নিজস্ব প্রতিবেদক>
মণিপুরি মুসলিমের পর্দা য়েম্বাক ছাতা সম্পর্কে এমন সব তথ্য রয়েছে যা অনেকেই হয়ত জানে না। মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল) মহিলাদের মাথায় পর্দা হিসাবে ব্যবহার করা হত এই বিশেষ ছাতা পর্দা য়েম্বাক।
বাঁশের কাঠামোয় তৈরি পাতার ছাউনি দেওয়া এ পর্দা য়েম্বাক ছাতা একসময়’বেশ ব্যবহৃত হত তখনকার সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয় পর্দা য়েম্বাক ছাতা খুব একটা দেখা যায় না এখন। সময় বদলেছে; তার স্থান দখল করে নিয়েছে হিজাব-নেকাব৷ বেশিদিন আগের কথা নয়। বছর পঁচিশ তিরিশ ’পেছনে ফিরি, প্রতিটি মুসলিম মণিপুরিদের বাড়িতে এটি প্রচলন ছিল। কমপক্ষে ঘরে ২/৪ টা করে য়েম্বাক থাকতো। আর এখন মণিপুরি মুসলিম নতুন প্রজন্মরা পর্দা য়েম্বাক ছাতার কথা বললে অনেকের কাছে অজানা।
বৃষ্টি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নয়, সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নয়, যদিও এ পর্দা য়েম্বাক ছাতা সর্বপ্রথম তৈরি হয়েছিল মণিপুরি মুসলিম মহিলাদের অন্যতম একটি পর্দা সামগ্রী।
মণিপুরি মুসলিম পাঙালরা মূলত ইসলাম ও মণিপুরি সংস্কৃতির অপূর্ব এক সমন্বয়ে চলে তাদের জীবন ধারা। তখনকার সময় সমগ্র মণিপুরি মুসলিম পাঙাল মেয়েরা ঘর থেকে বাহিরে বের হলে সাদা কিংবা কালো বোরকার উপর এ পর্দা য়েম্বাক (এক ধরণে বাঁশের ছাতা) ব্যবহার করে বাইরে যেতেন, সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।
প্রায় দু'শতাধিক বছর ধরে বাংলাদেশে বাঙালিদের সাথে সহাবস্থানকারি একমাত্র মুসলিম ধর্মাবলম্বি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হলো মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল) সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ পর্দা য়েম্বাক ছাতা মণিপুরি অধ্যুষিত কমলগঞ্জে আদমপুরের পল্লী ছনগাঁও গ্রামের হামোম তনুবাবু বাড়িতে মণিপুরি জাদুঘরে ঘুরে এর সন্ধান পাওয়া গেছে।
সেখানে মণিপুরি মুসলিম নারীদের ব্যবহৃত ৩টি পর্দা য়েম্বাক ছাতা রযেছে। এসময় পর্দা য়েম্বাক ব্যবহারের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- পাঙাল মেয়েরা একসময় মাথায় পর্দা হিসাবে ব্যবহার করে আসছিল কিন্তু বর্তমানে কেউ এটি ব্যবহার করেন না এর কারণটা হচ্ছে বিজ্ঞানের কল্যাণে ঐতিহ্যবাহী য়েম্বাকের যুগ শেষ হয়েছে।
মণিপুরি মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী এ পর্দা য়েম্বাক ছাতা গুলো কিভাবে পেলেন জানতে চাইলে হামোম তনুবাবু জানান, গণমানুষের কবি দিলওয়ার ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর হামোম তনুবাবুর স্বপ্ন সাধের ‘চাউবা মেমোরিয়াল মনিপুরী ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি মিউজিয়াম’-এর আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
ওইদিন থেকেই তিনি তার সংগ্রহশালাকে অধিক সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে ঘুরতে থাকেন গ্রামের পর গ্রাম, বাড়ির পর বাড়ি। মনিপুরীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করতে থাকেন তাদের ব্যবহৃত কৃষি, তাঁত, বিনোদন, খেলাধুলা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণ নিদর্শন।
এক পর্যায়ে তিনি আরো জানান, মণিপুরি মুসলিম মহিলাদের ব্যবহৃত পর্দা য়েম্বাক কোনাগাঁও গ্রামের লাল মিয়া কাছ থেকে প্রথম সংগ্রহ করেন, এরপর পশ্চিম জালালপুর গ্রামে ফখরউদ্দিনের স্ত্রী বিবি মরিয়ম কাছে দ্বিতীয়টি সংগ্রহ করেন, সর্বশেষ আবার কোনাগাঁও গ্রামের শারাফ উদ্দিনের কাছ থেকে এটি সংগ্রহ করেন। তবে এছাড়াও মণিপুরিদের সে সময়কার বোরকা ও তাদের নিজস্ব হাতের তৈরি মণিপুরি মুসলিম বিবাহিত মেয়েদের কোমরে কাপড় প্যাচানো খওয়াঙনাম্-ফি ও খুদাই (ওড়না) সহ আরো অনেককিছু সংগ্রহ রয়েছে তার মিউজিয়ামে।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, বেশিদিন আগের কথা নয়। আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগের মণিপুরি মুসলিম মহিলাদের এ পর্দা য়েম্বাক ছাতা গুলো ব্যবহার করতেন বলে জানান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের শুকুর উল্লার গ্রামের মুরুব্বি মোঃ আব্দুর রহমান।
তিনি আরো জানান, এই বিশেষ ছাতা গুলো সর্বপ্রথম বিক্রি করতেন দক্ষিণ তিলকপুরে হাজী মোঃ বাহাও উদ্দিনের বাপ-দাদারা। এই প্রসঙ্গে হাজী বাহাও উদ্দিন সাথে কথা বলে তিনি জানান, তারা নিজে এই ছাতা তৈরি করেননি। জৈন্তার একজন বাঙালির কাছ থেকে কিনে মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বিক্রি করতেন। তাদের কাছ থেকে এমনকি ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, বাংলাদেশ, মায়ানমার ও মণিপুর রাজ্যের লোকেরাও কিনতেন৷ প্রতিটি ছাতায় বাঁশ এবং পাতা দিয়ে অতি সূক্ষ্মভাবে বোনা এই নিপুণ শিল্পদ্রব্য পর্দা য়েম্বাক ছাতা ৷
মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের তরুণ গণমাধ্যমকর্মী রফিকুল ইসলাম জসিম মনে করেন, মণিপুরি মুসলিম মহিলাদের ব্যবহৃত এ পর্দা য়েম্বাক ছাতা ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রতিটি বাড়িতে সংরক্ষণ রাখা উচিত কিন্তু সময়ের পরিবর্তন, প্রযুক্তির কল্যাণের মণিপুরি পাঙালদের পর্দা য়েম্বাক থেকে হিজাব, একটি সংস্কৃতিরও পরিবর্তন।
পাঙাল মহিলাদের দেখা যেতো বোরকার মাথায় মাথায় এ পর্দা য়েম্বাক। বাড়ি থেকে বাহিরে , কিংবা ‘কোথাও’ যেতে, আসা-যাওয়া, তখনকার মাথায় পর্দা য়েম্বাক ছাতা একহাতে ধরে রাখতে দেখা যেত । তারপরও মণিপুরি মুসলিমের এ পর্দা য়েম্বাক হারিয়ে যাচ্ছে কেন? এটি খুব বেদনাদায়ক! যুগের পরিবর্তনে আধুনিকতার স্টাইলে ! বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রভাব এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে মণিপুরি মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী পর্দা য়েম্বাক।
নারীর বেপর্দার ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। মৃত্যুর পর মহিলাদেরকে পর্দার জন্য কঠিন বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। হাদীসে আছে, ‘দোজগীদের অধিকাংশই হবে নারী।’ তাই সব নারীদেরই উচিত পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে চলা। নারীরা হয়তো ভাবতে পারেন তাদের ওপর জোর করে পর্দার বিধান চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আসলে তা নয়। পর্দা নারীর মৌলিক অধিকার। পর্দার সঙ্গে চলতে পারাটাই নারীর ন্যায্য পাওনা।
মণিপুরি মুসলিম মহিলাদের মেয়েরা হীরার চেয়েও বেশি মূল্যবান। ঐতিহ্যেবাহী এ পর্দা য়েম্বাক ছাতার মাঝে লুকিয়ে আছে মণিপুরি মুসলমানের অতিমূল্যবান সম্পদ।
-এটি