।।সাঈদ হোসাইন।।
সহজ, সরল, সাদাসিধে এক মাওলানা। প্রতিদিন কিতাব হাতে নিয়ে দারসে যেতেন, দারস শেষে আবার নিজ রুমে ফিরে আসতেন। এই ছিল নিয়মিত রুটিন। আশির দশকে যারা দেখেছেন, তারা এমনই বলেছেন। পরবর্তীতে শাইখুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা মুহাম্মদ ইউনুস (হাজী সাহেব হুজুর) রহ. এর নেক নজর পড়ে তাঁর উপর।
হাজী সাহেব রহ. তখন হাটহাজারী মাদরাসার শুরার সভাপতি ও অভিভাবকপুরুষ। শুরার ফায়সালা অনুযায়ী তিনি মুহতামিম নির্বাচিত হন। হাটহাজারী মাদরাসার এক বার্ষিক মাহফিলে তিনি বলেন, 'মুহতামিম হওয়ার খায়েশ আমার নেই। হাজী ইউসুফ সাহেব এবং হাজী ইউনুস সাহেব রহ. আমাকে মুহতামিম বানিয়েছেন।' আমরা যার কথা বলছি তিনি হলেন আমাদের সবার প্রিয় আল্লামা আহমদ শফী রহ.।
[caption id="" align="aligncenter" width="353"] এ বইটিসহ মাকতাবাতুত তাকওয়ার প্রকাশিত বই সম্পর্কে জানতে ছবিতে ক্লিক করুন।[/caption]
২০১০ সালে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতিসহ সরকারের বিভিন্ন ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার মাধ্যমে এই নামটি আপন শক্তির দ্যুতি ছড়িয়ে ওঠে আসে লাইম লাইটে। ২০১৩ সালে ‘ইসলাম বিদ্বেষের প্রতিবাদে গর্জে উঠুন’ শিরোনামে সরকার ও দেশবাসীর প্রতি খোলা চিঠি দিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হন। এরপর থেকে প্রায়ই তিনি জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠেন। এরপর ৬ এপ্রিল শাহবাগের ইসলাম বিরোধী নাস্তিক্যবাদী অপশক্তি গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে ইসলামি মহা গণজাগরণের ডাক দেন।
১৩ দফা দাবির জন্য হাদিসের সিংহাসন ছেড়ে রাজপথে নেমে আসেন বয়োবৃদ্ধ এই মহানায়ক। তাঁর উস্তাদ ও শাইখ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. যেমন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তিনিও তেমনি সেই ব্রিটিশদের প্রেতাত্মা নাস্তিক্যবাদীদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
তারপর আসে ৫ মে। ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয় এক রক্তঝরা ইতিহাস। সেদিন উলামায়ে কেরাম একের পর এক রক্ত গরম করা ভাষণ দিচ্ছিলেন। জালিমের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হকের আওয়াজ বুলন্দ করছিলেন। রক্তচোষাদের এ আওয়াজ সহ্য হয় নি।
তাদের রক্তপিপাসা জেগে ওঠে। কারণ ওরা যে রক্তপিপাসু! ওদের রক্তদন্তী বসিয়ে দেয় আমার ভাইদের উপর। রাত যখন গভীর হয় ওরা তখন যেন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করে দেয়। রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে। আমাদের রক্তাশ্রু ঝরে। রক্তনিশান উড়ে। শহীদ ভাইদের আত্মা যেন বলে ওঠে—
"জীবনের চেয়ে দীপ্ত মৃত্যু তখনি জানি
শহিদি রক্তে হেসে ওঠে যবে যিন্দেগানি।"
৫ মে'র রক্তাক্ত ঘটনায় তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। কিন্তু তিনি বিচলিত হন নি, ভেঙে পড়েন নি। এর বেশ কিছুদিন পর তিনি 'দ্বিতীয় আলো'কে একটি ঈমানদীপ্ত সাক্ষাৎকার দেন। ঈমানি জজবা ও আবেগের মিশেলে সেই সাক্ষাৎকারে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন—
'আমাদের উপর যে আক্রমণ করেছে রাতে—ঘুমন্ত অবস্থায়, জিকির-আজকার করা অবস্থায় এই আক্রমণ করা হয়েছে আপনারা সবাই জানেন। নাস্তিকবাদীরা তিন-চার মাস পর্যন্ত উলঙ্গ হয়ে মহিলা-পুরুষ যেভাবে রাস্তার পর রাস্তা দখল করে যে কাজ করেছে, সবাই জানেন তাদেরকে গুলি করা হয় নাই কয়েক মাস পর্যন্ত। কিন্তু আমাদেরকে ২/৩ ঘণ্টা, আমি ফজরে যেয়ে বলে দিতাম— যাও এখন তোমরা নিজ নিজ স্বগ্রামে চলে যাও, এই ২-৩ ঘণ্টা সময় আমাদেরকে দেয় নাই৷ এ ধরনের হামলা ও বর্বরতা আমাদের উপর চালানো হয়েছে। আল্লাহর শোকর আমরা নাকাম না। নবী আলাইহিস সালামের সামনে ৭০ জন বড় বড় সাহাবাকে হত্যা করেছে কাফেররা তারপর বিজয় লাভ করেছেন। দীন জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ।
আশা করি সামনে আপনারা এ ধরনের দীনের ডাক যদি শুনেন, তাহলে আপনারা আগের চেয়ে বেশি ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ভাইয়েরা! হাদিসের মধ্যে আছে যারা শহীদ হবে তারা এমন কষ্ট পাবে, যেমন একটা পিপড়া তাদের কামড়ালে কষ্ট হয়। ওই ধরনের কষ্ট পাবে। না হয় 'ছুম্মা উকতাল ছুম্মা উহয়া ছুম্মা উকতাল ছুম্মা উহয়া' কেন বলেছেন? সেজন্য ভাইয়েরা আপনারাও দীনের জন্য ধর্মের জন্য শাহাদাত বরণ করার জন্য চেষ্টা করবেন।
[caption id="" align="aligncenter" width="372"] এ বইটিসহ মাকতাবাতুত তাকওয়ার প্রকাশিত বই সম্পর্কে জানতে ছবিতে ক্লিক করুন।[/caption]
১৩ দফার ব্যাখ্যা মানুষকে জানিয়ে দিবেন। অনেকে বুঝেও বুঝতে পারছে না। আমাদের দায়িত্ব আমাদের পালন করে যেতে হবে। যে কোনো বাতিল ফিরকা দেখা দিবে, আমাদের যতক্ষণ পর্যন্ত জান থাকবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব ইনশাআল্লাহ।'
এরকমই ছিল তাঁর ঈমানি আবেগ ও জিহাদী চেতনা। এরকমই ছিল তাঁর তাগুত বিরোধী সুস্পষ্ট অবস্থান। তিনি ১৩ দফার ঈমানি দাবিতে পাহাড়ের মতো অটল, অবিচল ছিলেন।
আল্লামা আহমদ শফী আমার বুখারি শরিফের উস্তাদ। আমার দারুল মাআরিফ থেকে হাটহাজারী মাদরাসায় আসার প্রধান কারণ হল— তাঁর কাছে বুখারি শরিফ পড়ার প্রবল আগ্রহ। কারণ তিনি হলেন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. এর শিষ্য ও খলিফা। আমার মরহুম দাদাজীও ছিলেন মাদানি রহ. এর খাস শাগরেদ। অপরদিকে আল্লামা শফী রহ. এর সাথে আমার দাদাজী শাইখুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা মুহাম্মদ ইউনুস (হাজী সাহেব হুজুর) রহ. এর সাথে গভীর মহব্বত ও এহতেরামের সম্পর্ক ছিল।
দাদাজী আল্লামা শফী রহ. এর ইলম, আমল, আখলাক ও ইখলাস দেখে হাটহাজারী মাদরাসায় তাকে মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ সেসময় হাটহাজারী মাদরাসায় তাঁর চেয়েও অনেক যোগ্য উস্তাদ ছিলেন। কিন্তু দাদাজীর নেক নজর পড়েছিল তাঁর উপর। আল্লামা শফী রহ. এর পরিচালনাকালে হাটহাজারী মাদরাসার যে ঈর্ষণীয় উন্নতি-অগ্রগতি হয়েছে, তা দেখলে বুঝা যায় দাদাজীর নির্বাচন কতই না শুদ্ধ ও সঠিক ছিল, কতই না অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন তিনি!
আল্লামা আহমদ শফী রহ.-কে আমরা পেয়েছি তাঁর শেষ জীবনে। যখন তিনি একেবারে শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই। হুজুর এই বয়সেও দেশের বিভিন্ন জেলায় সফর করতেন। কিন্তু দারস মিস দিতেন না। দূর-দূরান্ত থেকে সফর করে এসেও হুজুর বিশ্রাম না নিয়ে দারসে উপস্থিত হতেন।
আর দারসে হুজুর বুখারি শরিফের যে নোসখাটা আনতেন সেটা দারস চলাকালীন প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টা নিজ হাতে তুলে নিয়েই পড়াতেন, টেবিলে রাখতেন না। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম— এই বুড়ো মানুষটা এত শক্তি পায় কোথায়!? মাঝেমধ্যে আমাদের মসনবি পড়াতেন। ফারসি জানা না থাকায় এটা আমি বুঝতাম না। পরে এর একটা বাংলা তরজমা কিনে পড়েছিলাম। মসনবির শে'রগুলো পড়ার সময় তিনি খুব আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। তাঁর হৃদয়ে যেন ইশকে ইলাহির ঢেউ খেলে যেত!
একবার কোনো এক হাদিসের ব্যাখ্যায় হুজুর বললেন, 'আপনাদেরকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দাওয়াত দিতে হবে।' শাসকগোষ্ঠীর কাছে দাওয়াতি স্বার্থে যাওয়া হুজুরের ফিকিরে ছিল। কিন্তু এই কাজটি হুজুরের বয়সের ভার এবং নানা ধরনের অসুস্থতার কারণে আর হয়ে ওঠে নি। তাই ছাত্রদের মধ্যে এই ফিকির ছড়িয়ে দিলেন।
উপমহাদেশে মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহ. থেকে শুরু করে সাইয়ে আবুল হাসান আলী নদভী রহ. পর্যন্ত সবাই এ বিষয়টির উপর জোর দিয়েছিলেন। শাসকগোষ্ঠীর কাছে ইসলামের বৈপ্লবিক দাওয়াত পেশ করে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ইসলামের আলোকধারায় সজ্জিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁরা। আর একাজের ফলাফলও পেয়েছেন। শাসক এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনও হয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে আবার নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।
২০১৭ সালের একটা স্মৃতি মনে পড়ছে। শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর দস্তমুবারকে ‘দস্তার’ গ্রহণের জন্যে কাতারবদ্ধ হয়েছি। ধীরগতিতে চলছি। আমার দস্তার গ্রহণের মুহূর্ত চলে এল। শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী রহ. আমার মাথায় হাত রাখলেন অতঃপর দস্তার তুলে দিলেন।
আর শাইখুল হাদীস আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রহ. তাঁর তাওয়াজ্জুহ দিলেন। শাইখুল ইসলামের কোমল স্পর্শ ও ছুঁয়ায় ধন্য দস্তার আর শাইখুল হাদীসের তাওয়াজ্জুহের হিম শীতল পরশে যুগপৎ গর্ববোধ ও ভয়-বিহ্বলতা অনুভব হল তখন। গর্ববোধের কারণ ত বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু ভয়-বিহ্বলতার কারণ হল— যে মহান দায়িত্বের আমানত মাথার উপর চাপিয়ে দিলেন সেই ‘বোঝা’ কি বহন করতে পারব আমি?
যা হোক, আমার সৌভাগ্য যে— আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর সান্নিধ্য-সৌরভ এবং তাঁর দুআ পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। সৌদিআরব আসার আগে তাঁর কাছ থেকে দুআ নিতে গিয়েছিলাম। হুজুর তখন আমার জন্য দুআ করেছিলেন। এটাই ছিল হুজুরের সাথে আমার শেষ দেখা!
লেখক: শিক্ষার্থী, ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদিআরব
-কেএল