।।মুহিব্বুল্লাহ কাফি।।
১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২০ রোজ শুক্রবার বাদ মাগরিব হাঁটছি রাস্তায়। আমার সঙ্গে হাঁটছে আলাউদ্দিন। ওর সাথে অনেকদিন পর দেখা। তাই কতো কথাই না আমাদের চার পাশ ঘুরপাক খাচ্ছিলো। একপর্যায়ে কথা উঠলো হাটহাজারি মাদরাসার বর্তমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে। ছাত্রদের আন্দোলন ও দাবি নিয়ে।
হাটহাজারি মাদরাসার বর্তমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে সরকারের মাদরাসা বন্ধের ঘোষণা নিয়ে। কথা বলতে বলতে মাঠের এককোণে গিয়ে বসলাম আমরা দুজন।
বিরস গলায়, দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে আমি বলে উঠলাম, দুই হাজার বিশ সালটা কেমন জানি বিষময় হয়ে গেলো। সবচে ক্ষতি হয়েছে করোনাভাইরাস আসায়। বিশ্বের মানচিত্রে বড়ো ধরনের কালো দাগ এঁকে দিয়ে গেলো এ ভাইরাস ।
আমাদের ক্ষতিটাও কম হয়নি। বললো আলাউদ্দিন। সেই ২০১৯ থেকে শুরু করে দুই হাজার বিশের আজ অবধি আমাদের কতো বড়ো বড়ো মুরুব্বিগণ চলে গেলেন! ক বড়ো বড়ো শায়খুল হাদিস চলে গেলেন না ফেরার দেশে। দরসগাহ থেকে শুরু করে খানকাহ,মাঠ-ময়দান খালি করে চলে গেলেন পরকালে। আমাদের কাঁদিয়ে ওই না ফেরার দেশে!
শুধু কি চলে গেলেন! আলাউদ্দিনকে থামিয়ে বলে উঠলাম আমি। একের পর এক আমাদের মুরুব্বিরা চলে যাওয়ায় আমাদের মনের ভেতর শোকের যে ঘা জন্মেছে তা যেনো শুকাবার জো-ই পাচ্ছে না। এক ঘা শুকাবার আগেই নতুন আরেক ঘা পয়দা হচ্ছে মনের কিনারায় অন্য আরেক মুরুব্বি চলে যাওয়ায়।
- তুই কি লক্ষ করেছিস! এ কমাসে আমাদের এতিম করে কতো মুরুব্বিরা চলে গেলেন। বললো আলাউদ্দিন।
- আমি বললাম, হুম। অনেক। যেমন, শায়খুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলি রহ. আল্লামা হবিগঞ্জী রহ. মাওলানা যুবায়ের আহমদ আনসারী রহ. মাওলানা আনোয়ার শাহ কিশোরগঞ্জী রহ. সহ আরো অনেক বড়ো বড়ো উলামায়ে কেরামগণ চলে গেলেন এ কয়েকমাসের ভেতরই।
- জানি না যারা আমাদের মুরুব্বি আছেন তাদের মধ্যে এবার কে বা কারা চলে যান! ব্যাথিত গলায় বললো আলাউদ্দিন।
বলা তো যায় না, শাহ আহমদ শফি হুজুরও চলে যেতে পারেন এবার। লাগামহীন মুখে হঠাৎ আমি বলে ফেললাম। এ কথা বলে কেমন জানি আমি বোকা বনে গেলাম।
চোখের পলক স্থির করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আলাউদ্দিন। বললো,কী বললি! বিবশতা এঁটে গেলো তার মুখাবয়ে। সে প্রস্তুত ছিলো না আমার এমন অকথার। মুখের লাগাম টেনে বললাম, ইন্না-লিল্লাহ! এটা কী বললাম! আল্লাহ মাফ করুন। দুআ করি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা যেনো তাঁর নেক হায়াত দরাজ করেন। আমিন। বলে উঠলো আলাউদ্দিন।
দুজনের কথোপকথনের মধ্যেই এশার আজান ভেসে আসলো। আমরা মসজিদের দিকে পা বাড়ালাম। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব বলতে লাগলেন, দেশের বরেণ্য আলেম,লাখ লাখ আলেম গড়ার কারিগর, হাটহাজারি মাদরাসার মুহতামিম,হেফাজত ইসলামের সম্মানিত আমির, শাইখুল ইসলাম শাহ আহমদ শফি রহ. আজ সন্ধ্যা ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন।
আমরা হুজুরের জন্য দুআ করি আল্লাহ তাআলা যেনো তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উঁচু মাকাম দান করেন। আমিন।
ইমাম সাহেবের ঘোষণা শোনে স্তব্ধ আমি! কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ঠাঁই বসে রইলাম। এ কি শুনলাম আমি! কিছুক্ষণ আগে আমার মুখ ফসকে যা বের হলো তাই...! উফ,কিছুই ভাবতে পারছি না। আকাশ কালো করা মেঘ জমে গেলো আমার দুচোখের কোণে। পলক নামানোর আগেই ঝরে পড়লো অশ্রু।
মুহূর্তের মধ্যে হুজরকে ঘিরে সব স্মৃতি সজিব হতে লাগলো। যেনো আমার চোখের সামনে এক আয়না ভেসে উঠলো। যে আয়নায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার স্মৃতি উদ্ভাসিত হলো। স্মৃতির দর্পণে ভেসে উঠলো ২০১৯ এর সাতাইশ জানুয়ারির দিনটি।
তখন আমি ফরিদাবাদ তাকমিল পড়ি। গেলাম চট্টগ্রাম। আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারি মাদরাসায়। আমরা পাঁচ সহপাঠী। মাদরাসার মেইন গেইট দিয়ে সকাল সকাল ঢুকে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের পুরনো সহপাঠী আবদুস সালাম,ফয়সাল আহমদ ও আমীরুল ইসলাম এর অপেক্ষায়।
তারা হাটহাজারির তাকমিলের ছাত্র। যখন সূর্য একটু হেসে উঠলো দেখলাম রোদ পোহানোর জন্যে হুইলচেয়ারে করে শাইখুল ইসলাম শাহ আহমদ শফি রহ. কে ছাত্ররা মাদরাসার উঠোনে নিয়ে আসলো। কেউ চলে গেলো কেউ আবার দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমরা দাঁড়িয়ে আছি আরো দূরে। মুকুটহীন সম্রাট মাথা নিচু করে হুইলচেয়ার বসে আছেন। মাদরাসার উঠোনে। সূর্য যেনো তার পৃষ্ঠদেশে হাত বোলিয়ে দিচ্ছে আলতো ছোঁয়ায়।
আমাদের সম্মুখে এমন একজন সফল নেতা উপবিষ্ট যে, যার ভয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সাহস পায়না দেশের বাতিলেরা,রাম-বাম পন্থীরা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কটুক্তিকারীরা। কারণ, তারা দেখে ছিলল তার আহ্বানে ৫ই মে ২০১৩ এর শাপলা চত্বর। তাঁর সাহস আর তীক্ষ্ম বুদ্ধির সর্বদাই সমীহ করেছে রাম-বাম পন্থীরা।
এমন একজন আপসহীন নেতা, সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি রহ. এর সুযোগ্য খলিফা, লাখ-লাখ আলেমদের উসতাদ ও মুরুব্বি আমাদের সামনে উপবিষ্ট আছেন। আহা! কি যে ভালো লাগছিলো সেদিন হুজুরকে আমাদের সম্মুখে দেখে!
চোখে আরো ভাসতে লাগলো সেদিনটি, যেদিন মাওলানা সাদ সাহেবের কারণে মোহাম্মদপুর জোড়ে আসার আগে আমাদের ফরিদাবাদ মাদরাসায় তাশরিফ এনে ছিলেন হুজুর এবং আমাদের দরস দেয়ার সেই ছবি এখনো আমার স্মৃতিতে আঁকা আছে। ৪ নভেম্বর ২০১৮ তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুকরানা মাহফিলে হুজুরের মাথা নিচু করে বসে থাকার ছবি এখনো সজিব আমার স্মৃতিপটে।
ফরিদাবাদে ২০১৮-১৯ এ আমাদের খতমে বোখারির শেষ দরসের স্বর এখনো আমার কানে বাজে। সর্বশেষ ফরিদাবাদের খতমে বোখারির দরসে হুজুরকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। আাহা! সেই নুরানি চেহারা ও সুমিষ্ট খতমে বোখারির দরসের সেই স্বর এখনো আমার কাছে জীবিত।
এরপর স্বচক্ষে হুজুরকে দেখার আর জো পাইনি। হুজুর তো এমনিতেই অসুস্থ ছিলেন তার ওপর মৃত্যুর আগে আরো দুর্বল হয়ে পড়েন। শেষমেশ ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২০ এর সন্ধ্যাবেলা পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়ে বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে আমাদের এতিম করে চলে গেলেন রব্বে কারিমের কাছে। তিনি তো চলে গেলেন কিন্তু আমরা! আমরা তো এতিম হয়ে গেলাম।
এমন একজন অবিভাবক হারালাম যার ভয়ে বাতিলেরা সিঁটিয়ে থাকতো। রাম-বামেরা যার ভয়ে আমাদের দিকে কুনজরে তাকাবার ও মাথা চাগা দিয়ে উঠার সাহস পেতো না। সেই তিনি-ই আমাদের ছেড়ে...!
বিশ্বের মানচিত্র থেকে বিরল এক শায়খুল ইসলামকে হারিয়ে আমরা আজ এতিম। যার জানাযায় লাখো মানুষের উপস্থিতি, লাখো আলেমের বিগলিত চোখের পানি ঝরিয়ে, পুরো বাংলদের মানুষকে কাঁদিয়ে শুয়ে আছেন হাটহাজারির মাকবরায়।
হে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা তোমার কাছে এক বিশেষ আরজি, তুমি শাইখুল ইসলাম শাহ আহমদ শফি রহ. এর কবরকে জান্নাতি সুবাতাস দিয়ে সিক্ত রাখুন। আমিন।
-কেএল