।।মুফতি শামসুল হক।।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী। রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। ইতিহাসের এক মহানায়ক। শতাব্দীর বীরপুরুষ। অবিসংবাদিত নেতা। ক্ষণজন্মা মনীষী।। বাংলাদেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। আধ্যাত্বিক রাহবার। শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ ও মহা জাগরণের প্রতীক।
বহু গুণে গুণান্বিত শতাব্দীর সেরা এই মনীষী জন্মেছেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। ইলমের শহর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে। লেখাপড়ার হাতে খড়ি নিজ গ্রামের মৌলভী আজিজুর রহমানের নিকট। এরপর সরফ ভাটা মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জিরি মাদরাসায়। সেখানে পাঁচ-ছয় মাস অধ্যয়ন করেন।
এরপর ব্রিটিশ ও জার্মানির যুদ্ধ দামামা বেজে ওঠায় তিনি আর সেখানে পড়ালেখা করতে পারেননি। অতঃপর ১৩৬১ হিজরীতে এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীনি বিদ্যাপীঠ আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীতে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে মিশকাত ও জালালাইন পর্যন্ত শিক্ষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করেন।
এরপর হাদিস ও তাফসির শাস্ত্রের উচ্চ জ্ঞান অর্জন করার অদম্য স্পৃহা নিয়ে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন। সেখানে তিনি দাওরায়ে হাদিস মাস্টার্স এবং উচ্চতর তাফসির শাস্ত্রের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। দেওবন্দ থাকা অবস্থায় তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার, শাইখুল ইসলাম সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি রহমাতুল্লাহ আলাইহি-এর বিশেষ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন।
দেওবন্দে ছাত্র অবস্থাতেই তার বাইয়াত গ্রহণ ও চার তরিকার উপর খেলাফতপ্রাপ্ত হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। ইলম আমল ও আধ্যাত্মিকতায় ধন্য এই মনীষী একাধারে চার বছর অধ্যায়ন ও যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের সামনে থেকে কোরআন হাদিস তাফসির ও ফিকাহ শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরপর যুগের অন্যতম রাহাবার সাইয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী রহমাতুল্লাহ আলাইহি এর ইলম ও আমলি প্রতিনিধি হিসেবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
দেশে ফিরে তিনি তাঁর প্রিয় উস্তাদ হাটহাজারী মাদ্রাসার তৎকালীন পরিচালক আল্লামা আব্দুল ওয়াহহাব রহমতুল্লাহি আলাইহির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁর জ্ঞান প্রজ্ঞা মেধা ও বিরল প্রতিভা দেখে তাকে দারুল উলুম হাটহাজারীতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। খুব অল্পদিনের মাঝেই তার পাাঠদানের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
১৪০৭ হিজরিতে তৎকালীন মুহতামিম হযরত মাওলানা কারী হামেদ সাহেবের ইন্তেকালের পর তাকে মজলিসে শুরার সর্বসম্মতিক্রমে মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব অর্পিত হবার পর তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মাদ্রাসা পরিচালনা করেন। শুধু হাটহাজারী মাদ্রাসায় নয়, সারা দেশের অসংখ্য মাদ্রাসা মসজিদ দায়িত্বশীলতার সাথে পরিচালনা করেছেন তিনি।
এছাড়াও সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আল হাইয়াতুল উলইয়ায়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এর সভাপতি এবং বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন আমৃত্যু। তার সফল উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় দারুল উলুম হাটহাজারীর নজিরবিহীন সংস্কারের কাজ হয়েছে। তার সময়ে ছাত্রদের আবাসন সঙ্কট নিরসন কল্পে কয়েকটি আবাসিক ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে। এক কথায় হযরতের মাধ্যমে জামিয়ার উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বের আলোচিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ অনেকটাই আল্লামা আহমদ শফীর অনন্য সৃষ্টি। সংগঠনের সম্মানিত আমির ছিলেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে ইসলামের বহু খেদমত হয়েছে। তার আহবানকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামা হযরতগণ অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতেন এবং তার ডাকে সাড়া দিয়ে সবাই হাটহাজারী ছুটে এসে ইসলামের পথে অটল থাকার শপথ গ্রহণ করতেন।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ইস্যুভিত্তিক অনেক সংগঠন গঠিত হয়েছে। আন্দোলন হয়েছে ইসলাম বিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে। কোনো আন্দোলনে সকল ইসলামী দল ও সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম ছিল না। কিন্তু আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আহ্বানে হেফাজত ইসলামের যে নাস্তিক বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, তাতে সকল ইসলামী রাজনৈতিক দল ও সংগঠন যেভাবে উপস্থিতি ছিল, তেমনি এদেশের সকল মাদ্রাসারও অংশগ্রহণ ছিল। হাজির ছিলেন পীর-মাশায়েখ গণ।
আমিরে হেফাজতের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তার নেতৃত্বে হেফাজত ইসলামের মাধ্যমে ইসলাম বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেছেন এদেশের প্রতিনিধিত্বকারী সকল আলেম।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণাঢ্য জীবন কর্ম অবদানসমূহ এমন সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে বলে শেষ করা সম্ভব নয়। তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র আলোচনা করলে স্বতন্ত্র একটি বইয়ের প্রয়োজন। আল্লাহ হয়ত এ কাজ তার কোন বান্দার মাধ্যমে করাবেন।
কালের সেরা এ মনীষী সারা বিশ্ববাসীকে এতিম করে গত ১৮/২০/২০২০ খ্রিস্টাব্দে রোজ শুক্রবার ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এর মাধ্যমে মহা জাগরণের এক প্রতীকের তিরোধান ঘটে। আল্লামা আহমদ শফী ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। পৃথিবী থেকে একজন মহীরুহ চিরবিদায় নেন। আল্লাহ তাআলা তকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন.
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া আবু বকর সিদ্দিক রা. ভূজপুর, চট্টগ্রাম।
-কেএল