মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক।।
মানবজাতীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম। মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই মূল উদ্দেশ্য। মানুষের উত্তম গুণাবলির মধ্যে ধৈর্য অন্যতম। ধৈর্য বলতে বোঝায় সংযম অবলম্বন করা ও নফসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। সাধারণত অপারগতার কারণে বা অসমর্থ হয়ে প্রতিকারের চেষ্টা বা প্রতিরোধ না করা। নিজের মনোভাবের সাথে ঐকমত্য সৃষ্টি হয় না এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে নিজের ক্ষমতা ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ না করে নম্রতা ও সৌজন্যের মাধ্যমে মোকাবিলা করার নামই ধৈর্যশীলতা।
রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন- আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য (মুসলিম ও তিরমিজি)। যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলায় সহনশীল মনোভাব প্রদর্শনের মাধ্যমেই এ গুণের স্বরূপ প্রকাশ পায়। ধৈর্যের প্রথম ধাপ যথার্থ সময়ের প্রতীক্ষা করা। সকল প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্যের সাথে লক্ষ্য অর্জনে অটুট থাকা। যত বাধা-বিপত্তি আসুক আস্থার সাথে কাজ করে যাওয়া।
ধৈর্যশীল ব্যক্তি অফুরন্ত পুরস্কার লাভ করবে। বিপদের সময় অস্থির না হওয়া; বরং এর মধ্যে কল্যাণ নিহিত আছে বিশ্বাস করা। সৃষ্টিকর্তা বর্ণনা করেন- ‘আর হ্যাঁ, (জান্নাতে) তাদের ঘরের প্রত্যেক দরজা দিয়ে ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে তাদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এবং বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম। কারণ, পৃথিবীতে তোমরা ধৈর্যকে নিজেদের আদর্শ করে নিয়েছিলে। কতই না উত্তম আখেরাতের এ ঠিকানা’ (সুরা: রা’দ, আয়াত- ২৩ ও ২৪)।
অবশ্যই আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, সম্পদহানি, স্বাস্থ্যহানি ও ফসলহানির মাধ্যমে পরীক্ষা করব। তবে সুসংবাদ রয়েছে ধৈর্যশীলদের জন্য, যারা মুসিবতে নিপতিত হয়ে বলবে অবশ্যই আমরা আল্লাহর জন্য এবং অবশ্যই তাঁরই কাছে আমরা ফিরে যাব। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েতপ্রাপ্ত’ (সুরা: বাকারা- ১৫৫)। ‘কোনো বিপদ এলে যারা বলে, আমরা আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে- এদের ওপর তাদের সৃষ্টিকর্তার রহমত ও দয়া অঝোর ধারায় বর্ষিত হবে। আর জেনে রাখো!
এরাই সঠিক সুপথগামী’ (সুরা: বাকারা, আয়াত- ১৫৬ ও ১৫৭)। ধৈর্যের বিশেষত্ব হল মুসিবতে অন্তর দুর্বল না করা। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে যত প্রতিবন্ধকতা আসুক তা ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করা। ‘বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’ (সুরা: লোকমান, আয়াত- ১৭)।
আমি তো তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। কত উত্তম বান্দা সে! সে ছিল আমার অভিমুখী (সুরা: সা’দ, আয়াত- ৪৪)। হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন (সুরা: বাকারা, আয়াত- ১৫৩)।
হাদিসের আলোকে, ‘রাসুল (সা:) কোনো মুসিবতে পড়লে হা-হুতাশ করতেন না।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন’ (ইবনে কাসির)। ধৈর্য ফজিলত অনেক, ইমাম ইবনে কাসির তার তাফসিরে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন- ‘কেয়ামতের দিন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে, ধৈর্যশীলরা কোথায়! আপনারা বিনা হিসেবে জান্নাতে চলে যান। ঘোষণা শুনে একদল লোক বেহেশতের পথে রওনা করবে। ফেরেশতারা বলবে, আপনারা কারা?
কোথায় যাচ্ছেন? তারা বলবে, আমরা ধৈর্যশীল বান্দা; জান্নাতে যাচ্ছি। ফেরেশতারা বলবে, এখনও তো হিসাব-নিকাশ হয়নি। ধৈর্যশীল বান্দারা বলবেন, আমাদের হিসাবের আগেই জান্নাতে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবার ফেরেশতারা বলবে, তাহলে আপনারা তো খুবই মর্যাদাবান ও আমলদার বান্দা। আপনাদের সেই আমল সম্পর্কে বলুন যার বিনিময়ে এ গৌরবময় মর্যাদা অর্জন করেছেন।
তারা বলবেন, দুনিয়ার জীবনে আমরা সবরের জীবনযাপন করেছি। সৃষ্টিকর্তার পথে চলতে গিয়েও তাঁর বিধান মানতে গিয়ে অনেক ত্যাগ ও বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। এর বিনিময় আমরা কখনও অভাব-অভিযোগ করিনি। সবসময় ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। এসব শুনে ফেরেশতারা বলবে, মারহাবা! আপনাদের আমলের যথার্থ প্রতিদানই আপনারা পেয়েছেন।’
এজন্য সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ঘোষণা করেন- ‘ধৈর্যশীলদের প্রতিদান বিনা হিসাবে দেয়া হবে’ (সুরা: আজ-জুমার, আয়াত- ১০)। ধৈর্যের প্রতিদান সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, ‘আমি যখন মোমিন বান্দার কোনো আপনজনকে মৃত্যু দেই আর সে ধৈর্য অবলম্বন করে, তখন আমার কাছে তার একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত’ (বুখারি)।
আমরা সাধারণত বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবতে বিচলিত না হওয়াকেই ধৈর্য বলে মনে করি। মূলত ধৈর্য অনেক ব্যাপক অর্থ ধারণ করে। ধৈর্য তিন প্রকার। যথা: অন্যায় অপরাধ তথা পাপকার্য থেকে বিরত থাকা। ইবাদত আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকর্মে কষ্ট স্বীকার করা। বিপদে অধীর না হওয়া (তাফসিরে বায়জাবি)। পরিপূর্ণ ধৈর্যই মানবজীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে।
দুনিয়ার জীবন আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মাত্র। জীবনের বাঁকে বাঁকে পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া এবং পরীক্ষা দেয়া জীবন-মৃত্যু সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। সৃষ্টিকর্তা বলেন, ‘তিনি বড়ই মহান ও শ্রেষ্ঠ, যাঁর হাতে রয়েছে (সৃষ্টিলোকের) রাজত্ব। আর তিনি প্রতিটি জিনিসের ওপর শক্তিমান। তিনি জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন- যাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে কে বেশি ভালো। তিনি মহাশক্তিশালী ও ক্ষমাশীল (সুরা: আল-মুলক, আয়াত- ১ ও ২)।
বিশ্বের সকল মহামানবগণ নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন ধৈর্য্যরে মাধ্যমে। বিশ্বের যা কিছু আবিষ্কার, দু:সাহসিক অভিযান সবই ধৈর্য্যরে ফল। সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সব অবদানের সৃষ্টি হয়েছে তা ধৈর্য্যরে সুফল। সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসুল (সা:) অপরিসীম সহিষ্ণুতা ও ধৈর্যের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। শত্রুর আঘাতে তাঁর দেহ থেকে রক্ত ঝরেছে, জীবন সংঙ্কটাপন্ন হয়েছে, তবু নবী কোন শত্রুকে অভিশাপ দেননি, বরং তাদের ক্ষমা করে জগতে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
তাঁর আদর্শ জগৎ বাসীর জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তাই জীবনকে সুন্দর, সার্থক ও মহৎ করে গড়ে তোলার জন্য ধৈর্য ও সহনশীলতার ব্যাপক অনুশীলন দরকার।
লেখক: প্রাবন্ধিক
-এটি