মুফতি মাহবুবুর রহমান
বিবাহের কাবিননামার মধ্যে ১৮ নং একটি কলাম রয়েছে। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কলামটি সম্পর্কে অনেকেই জানেনা আবার অনেকে জেনেও তেমন গুরুত্ব দেয় না। অথচ কলামটি পূরণ না করলে বরপক্ষ ও কনেপক্ষ উভয়ই, বিশেষ করে বরপক্ষ খুব ঝামেলায় পড়েন।
কলামটি খালি রাখলে যে ঝামেলা হয়; মেয়েরা যেহেতু কিছুটা রাগী থাকে, ধৈর্য এবং বুদ্ধি কম থাকে, তাই কখনো যদি দুজনের মাঝে কোনভাবে হালকা মনোমালিন্য হয়, তখন কনে সোজা চলে যায় কাজী সাহেবের কাছে। বলে; আমার ঝামেলাটা মিটিয়ে দিন। কাজী সাহেব মোটা অংকের টাকা নেয়ার জন্য ১৮ নং এই কলামটি সম্পর্কে আগে থেকে কাউকে অবহিত করে না। যখন কনে মোটা অঙ্কের টাকা দেয় তখন কাজী সাহেব লিখে দেয় ফাতেমাকে তালাক দেওয়ার অধিকার প্রদান করা হলো”।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল; যেহেতু বর এ কলামটি পূরণ করেনি, কাজী পূরণ করেছে। তাই কাজী সাহেবের পূরণ করার দ্বারা মহিলা তালাকের অধিকার পাবে না। এমতাবস্থায় সে নিজেকে তালাক দিলে ইসলামের দৃষ্টিতে তালাকও পতিত হবে না। ওদিকে সরকারিভাবে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে কারণ সরকার দেখবে না কলামটি কে পূরণ করেছে।
মহিলা এ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সরকারিভাবে সে তার স্বামী থেকে পরিত্রাণ পেলেও ইসলামের দৃষ্টিতে সে তার ঐ স্বামীরই থেকে যাবে, কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে সেটা ইসলাম যেনা ব্যভিচার হিসেবেই গণ্য করবে। সন্তান হলে জারজ সন্তান হিসেবে লালিত পালিত হবে।
আর যারা পূরণ করেন তারাও যথাযথ শব্দ ব্যবহার করতে না পারায় বিপদমুক্ত হতে পারেন না। আবার অনেকে লিখে দেয় “আমি ফাতেমাকে তালাকের অধিকার দিলাম না”। এটা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে খুব ঝামেলার সৃষ্টি হয়। বর যখন স্বাক্ষর ছাড়া অন্য কিছু লিখে তখন সবাই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখে। আর তখনই শুরু হয় বাকবিতন্ডা।
তাই বিষয়টি সমাধানের জন্য আল-হিলাতুন্নাজেযাহ কিতাবের লেখক যথাযথ শব্দ প্রয়োগে এমনভাবে লিখতে বলেছেন যা উভয় পক্ষের জন্য উপকারী।
১৮ নং কলামে লেখা আছে; স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দিবে কিনা? এরপর কিছু জায়গা ফাঁকা রয়েছে। সেখানে কনের নাম উল্লেখ করে যা লিখতে হবে তা নিন্মরুপ;
“বিবাহের পরে আমি যদি একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই, অতিরিক্ত নির্যাতন করি, বা একেবারেই ভাত-কাপড় না দেই তখন মোসাম্মাৎ ফাতেমা প্রতি-ঘটনার তিন দিনের মধ্যে, তার নির্ভরযোগ্য দুজন অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে নিজের উপর এক তালাকে বায়েন নিতে পারবে”।
যে শর্তগুলো এখানে দেওয়া হয়েছে তার কোনো একটি ভঙ্গ হলে কনে নিজের উপরে তালাক নিতে পারবে। আর মহিলারা সাধারণত যখন রাগ হয় তখন পরবর্তীতে কি হবে সেটা না ভেবেই একটা কিছু করে ফেলে।
এজন্য শরীয়ত তাদেরকে তালাকের অধিকার দেয়নি। যেমন বাচ্চাদের হাতে কেউ কাচের পাত্র দেয় না। কারণ সে তার গুরুত্ব না বুঝে যেকোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে দিতে পারে। তদ্রূপ মহিলারাও যখন রাগ হবে তখন সে তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে দ্রুত তালাক নিয়ে নেবে।
সুতরাং অনেকগুলো বিষয় চিন্তা করে উপরোক্ত লেখাটি লেখা হয়েছে। যা গভীর ভাবে লক্ষণীয়। লেখার মধ্যে কোন রকম ব্যতিক্রম হলে ঝামেলা তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
উক্ত লেখার মধ্যে “আমি যদি একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই” বাক্যে “একেবারে” শব্দটি না থাকলে স্বামী যদি স্ত্রীর অজান্তে একদিন বা দুদিন কোথাও থাকে। তাহলে স্বামী নিরুদ্দেশ হয়েছে অজুহাতে, নিজের উপর তালাক নিয়ে নিতে পারবে। অথচ এটাকে নিরুদ্দেশ বলা চলেনা।
“যদি অতিরিক্ত নির্যাতন করি” বাক্যে অতিরিক্ত শব্দটি প্রয়োগ না করা হয় তাহলে কোনদিন কখনো একটি কটু কথা বা একটি চড়-থাপ্পড় এর উপর ভিত্তি করে নিজের উপর তালাক নিয়ে নিতে পারবে।
একেবারেই ভাত-কাপড় না দেই বাক্যে একেবারে শব্দটি ব্যবহার না করা হয় তাহলে কোনদিন কখনো যদি পছন্দের তালিকায় একটি মাত্র কাপড় না দেয়া হয় বা কোন কারণে কোন এক ওয়াক্ত ভাত না খেয়ে থাকতে হয় তাহলে মহিলা নিজের উপর তালাক নিয়ে নিতে পারবে।
“প্রতি ঘটনার তিন দিনের মধ্যে কথাটা না লিখলে কোন একদিনের কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেকোন সময় তালাক নিয়ে নিতে পারবে। যেমন কেউ তার স্ত্রীকে একটি থাপ্পর দিলো কিন্তু স্ত্রী সেসময় কিছুই করলো না। দু-চার বছর পর যখন এ স্বামীর কাছে থাকতে মন চাচ্ছে না তখন সে ঐ থাপ্পরের কথা স্মরণ করে তালাক নিতে পারবে। অথচ তিন দিনের কথা উল্লেখ থাকলে পারবেনা।
দুইজন নির্ভরযোগ্য অভিভাবক এর অনুমতিক্রমে কথাটি বলা হয়েছে তার কারণ; শুধু মেয়েকে অধিকার দিলে সে রাগের মাথায় কোন চিন্তা না করে তালাক নিয়ে নিবে। অথচ তার অভিভাবক বিষয়টি ভালো-মন্দ চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিবে।
এক তালাক নিতে পারবে” কথা বলার কারণ হলো; যদি এক না বলে শুধু “তালাক” নিতে পারবে বলে। তাহলে মহিলা তিন তালাক নিতে পারবে। তাই সে তিন তালাক নিয়ে নিলে পরবর্তিতে আর ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকবেনা। এমনকি অন্য এক জায়গায় বিবাহ হওয়ার পর সে না ছাড়লে বিবাহ করারও সুযোগ থাকবে না। আর যদি এক তালাক লেখা থাকে, আর মহিলা এক তালাক নিয়ে নেয় তাহলে সে সুযোগ থাকবে।
সুতরাং আমাদের উচিত হবে বিবাহের আগেই বিষয় ভালো করে শিখে কাবিননামার ১৮ নং কলাম যথাযথভাবে পূরণ করা। আল্লাহ আসান করেন।
লেখক: শিক্ষক, গওহরডাঙ্গা মাদরাসা।
-এটি