আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: আমিরে হেফাজত ও শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রহ ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহঃ-এর হাতে গড়া শিষ্য, স্থলাভিষিক্ত এবং সুযোগ্য প্রতিনিধি।
তাকে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে বাবুনগর মাদরাসা থেকে আহ্বান করে হাটহাজারী মাদরাসার মসনদে হাদীসে বসিয়েছেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইসলামী অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব বানিয়ে প্রশিক্ষিত করেন, যাতে পরবর্তিতে তিনি সংগঠনের হাল ধরে ইলমে নববীর উত্তরাধিকার বহন করতে পারেন। তিনি কিছু দিন হাটহাজারী মাদরাসার সহযোগী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমৃতু শিক্ষা পরিচালক ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রখর মেধাবী শিক্ষক ও প্রথিতযশা মুহাদ্দিস।
তার শ্রদ্ধাভাজন পিতা হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস হজরত আল্লামা আবুল হাসান চাটগামী রহঃ লিখিত ‘তানজিমুল আশতাত’ নামক মিশকাত শরিফের সুবিশাল ব্যাখ্যা গ্রন্থ বাংলাদেশ-ভারত ও পাকিস্তানের ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত। অনেক চড়াই উতরাই ও ঘাত অভিঘাত অতিক্রম করার বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল তার। ওস্তাদ আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ:-এর মতো তারও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। আলাপচারিতায় বোঝা যায় প্রচলিত রাজনীতির কূটকৌশল ও কূটনীতির মারপ্যাঁচের সাথে তিনি পরিচিত নন। আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহঃ-এর ইন্তেকালের পর তিনি হেফাজতে ইসলামের আমির নির্বাচিত হন।
ছাত্র ও জনতার প্রতি সব সময় তার অকৃত্রিম স্নেহ ও দোয়া ছিল। হাদিস বিষয়ে যে কোনো জটিল প্রশ্ন করা হলে কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই তাৎক্ষণিক জবাব দিতেন। এতে হাদিসশাস্ত্রে তার গভীরতা ও পান্ডিত্যের পরিচয় মেলে। তিনি ছিলেন মূলত সমাজ সচেতন ও উম্মাহর দরদি এক মনীষী। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এমন এক রাহবার যার ওপর আস্থা রাখা যায়; যাকে সাধারণ মানুষ ভালোবাসেন। পদলোভ, অর্থলিপ্সা ও ক্ষমতার অভিলাষ তার ছিল না। সারা জীবন জ্ঞানচর্চা, ধর্মপ্রচার ও সমাজ পরিবর্তনের মেহনত করে গেছেন। চাপ বা আপোস তাকে নববী আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সারল্য ও অনাড়ম্বরতা তার জীবনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। স্বাধীন দেশে লাল-সবুজের মানচিত্রে বসবাসরত সকল জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য তিনি নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন।
১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুর ১২.০০ টা ৩০ মিনিটে ৬৮ বছর বয়সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় লক্ষ-কোটি অনুরাগীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভ করেন। দুঃসময়ে জাতি তাকে হারিয়ে মাঝি বিহীন নৌকার মত হয়ে গেল। তার ইন্তেকালে দেশের কওমি অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হবার নয়। তার মত নেতৃত্ব দেয়ার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি একেবারেই বিরল।
বহুমাত্রিকতায় মরহুমের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য ও কর্মমুখর। তিনি একাধারে মুহাদ্দিস, গবেষক, সংগঠক, লেখক, বক্তা এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষাসচিব ও শায়খুল হাদিস, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক, নাজিরহাট বড় মাদরাসার মুতাওয়াল্লি, জিরি মাদরাসার পরিচালনা পরিষদের সদস্য, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক এবং ইনসাফ২৪ ডটকম ও কওমি ভিশন ডটকমের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের তিনি বেশ পছন্দ করতেন। কারণ তাদের মাধ্যমে ন্যায্য অধিকারের দাবী যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়।
দেশের বিভিন্ন মাহফিলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি সর্বদা বলতেন, ‘হকের ওপর যেন থাকতে পারি, হকের ওপর যেন মরতে পারি, হকের উপর থাকলে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়। আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে। আমিও জেল খেটে এসেছি। তিনি বলতেন, ইসলামের জন্য প্রয়োজনে সুতার টুপির পরিবর্তে লোহার টুপি পরিধান করব তবুও ইসলামকে ভুলন্ঠিত হতে দিব না। আল্লামা বাবুনগরী রহঃ যখন বোখারি শরিফের পাঠদান করতেন, দারুল হাদিসে তিল ধারণের ঠাঁই থাকত না। এমনকি ছাত্ররা বারান্দা ও সিঁড়িতে কিতাব নিয়ে বসে যেত তার জ্ঞানলব্ধ তাকরির শোনার জন্য। ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন অতিপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ওস্তাদ।
১৫ নভেম্বর ২০২০ সালের রবিবার বাংলাদেশের এক স্মরণীয় দিন উম্মুল মাদারিস আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলামে (হাটহাজারী মাদ্রাসা) বাংলাদেশের সর্ব স্তরের উলামাদের উপস্থিতিতে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে হযরতওয়ালাকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির নির্বাচন করা হয়।
আমির নির্বাচিত হওয়ার পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী জানিয়েছিলেন, ‘আমি সরকারবিরোধী নই, সরকারের শত্রু নই এবং সরকারের পক্ষও নই, সরকার সমর্থকও নই। কারো অন্যায্য চাপ বা প্রভাবের সামনে মাথা নত করব না। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই।
কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানো আমার লক্ষ্য বস্তু নয়। যেহেতু হেফাজত রাজনৈতিক দল নয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনে আমাদের কোনো প্রার্থিও নেই, প্রপাগান্ডাও নেই। ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও তাহজিবের বিকাশ এবং নাস্তিক্য্যবাদের প্রতিরোধে আমরা কাজ করে যাবো। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ধর্ম অবমাননা ও কটূক্তির সব প্রয়াস বন্ধ করে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। হেফাজত তার সুনির্দিষ্ট রূপ-রেখা নিয়ে এগিয়ে চলবে।
সরকার সরকারের কাজ করুক, আমরা আমাদের কাজ করি। কিন্তু নাস্তিক্যবাদী শক্তি যদি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করে, এতে সরকার যদি কোনো অ্যাকশন না নেয়, অথবা সরকার যদি নিজের পক্ষ থেকে এমন কোন পদক্ষেপ নেয় যা শরিয়াহ পরিপন্থী; তাহলে ঈমানের তাগিদে আমরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।’
আপোস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকারকে নসিহত করা বা সৎ পরামর্শ দেয়া একটি মহৎকর্ম। এ কাজটি হতে হবে নিঃস্বার্থ। অতীতেও বুজুর্গানে দ্বীন করেছেন। এতে ব্যক্তিস্বার্থ যদি প্রাধান্য পায় তাহলে নসিহত ফলপ্রসূ হবে না। ভারতের মুজাদ্দিদে আলফেসানি ও তুরস্কের শায়খ আফিন্দি নকশবন্দীর মতো মানুষ তো এখন আর নেই।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও যখন হাটহাজারী মাদরাসায় এসেছিলেন, তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে কারো সাথে দেখা করতে যাননি। যতদূর সম্ভব ‘দরবার ও সরকার’ থেকে দূরত্বে অবস্থান করাকে তিনি নিরাপদ মনে করেছেন।
তিনি আসলাফ ও আকাবিরদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পছন্দ করতেন। বিত্তশালীদের তোয়াজ করা ও ক্ষমতাশীনদের পিছে পিছে ঘোরাফেরায় তিনি অভ্যস্থই নই বরং আগ্রহীও ছিলেন না।
ঐতিহ্যগতভাবে এ ধাঁচে তিনি গড়ে ওঠেননি। ২০১৩ সালের ৫মে ঐতিহাসিক শাপলা ট্রাজেডির কালো রাতের পর ৬মে তিনি পুলিশের হাতে আটক হন এবং সরকার কর্তৃক বাবুনগরীর পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদিন তার পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার সময় প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে সালাম জানিয়েছেন।
পৃথিবীর যে দেশে আপনি চিকিৎসা করাতে চান রাষ্ট্রীয় খরচে প্রধানমন্ত্রী সে ব্যবস্থা করবেন।’ কিন্তু আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী উত্তরে বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার সালাম। প্রস্তাবের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের সক্ষমতা আমার আছে।’
এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে তিনি কওমি অঙ্গনের আলেম উলামাদের নেতৃত্বে আসীন হন। শীর্ষস্থানীয় প্রতিবাদী উলামাদের ইন্তেকালে কওমি অঙ্গনের উলামা মাশায়েখদের নেতৃত্বের সঙ্কট দেখা দেয়।
সরকারের শিক্ষা ও নারীনীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে নাস্তিক্যবাদী শক্তির আস্ফালন, ব্লগার ও সুশীল নামে পরিচিত একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের ইসলামবিরোধী বক্তব্য ও মন্তব্য যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন শাহ আহমদ শফী রহ:-এর হাতে গড়া ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে অরাজনৈতিক সংগঠনের হাল ধরেন। সে সময় তার চেয়ে গ্রহণযোগ্য অন্য কোনো ব্যক্তি সামনে ছিল না। আলেম উলামা তাকেই আমির হিসেবে বেছে নেন। তিনি হয়ে ওঠেন নবজাগরণের প্রতীক।
১৯৫৩ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামের এক ইলমি খান্দানে তার জন্ম। বাবুনগর মাদরাসায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখা বাবুনগর মাদরাসায় শেষ করে হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন এবং দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনের সর্বত্র তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৭৬ সালে করাচিতে অবস্থিত জামিয়া বিননুরিতে উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন।
দুই বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা করে তিনি আরবি ভাষায় ‘সিরাতুল ইমামিদ দারিমি ওয়াত তারিখ বি শায়খিহি’ (ইমাম দারিমি ও তার শিক্ষকদের জীবনবৃত্তান্ত) শীর্ষক পুস্তক রচনা করে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। করাচিতে তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহঃ, মুফতি ওয়ালি হাসান টুঙ্কি রহঃ, মাওলানা ইদরিস মিরাঠি রহঃ, মাওলানা আবদুল্লাহ ইউসুফ নোমানি প্রমুখ।
১৯৭৮ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। ২০০৩ সালে তিনি শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমাদ শফি রহঃ এর অনুরোধে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায় যোগদান করেন। পরবর্তিতে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন। সারা জীবন তিনি শিক্ষকতা করেন এবং তার কাছে হাদিস অধ্যয়ন করেছেন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০ হাজারেরও বেশি।
বাংলা, উর্দু ও আরবি ভাষায় হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ সহ ৩০টির বেশি গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেন। তার বেশ ক’টি বক্তৃতার সঙ্কলনও বেরিয়েছে আল্লামা বাবুনগরীর রহঃ এর ইন্তেকালের সংবাদে শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং সারা বিশ্বের মুসলিমদের মাঝে এক শোকের ছায়া নেমে আসে। রাত সাড়ে ১১টায় অনুষ্ঠিত নামাজে জানাজায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শোকার্ত মানুষের অংশ্রহণ মরহুমের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বহন করে।
জানাযা শেষে মাকবারায়ে জামিয়ায় শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমাদ শফি রহঃ এর পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হন। শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী বেঁচে থাকবেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। ইসলামী শিক্ষার বিকাশ, দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, হকের আওয়াজ বুলন্দ করার সংগ্রাম এবং নাস্তিক্যবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলনে তার নিরাপোস ভূমিকার জন্য ইতিহাসে তিনি চির স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মাকাম নসিব করুন। আমিন।
-এটি