মুফতী মুহাম্মাদুল্লাহ।।
মানুষ কখনও একা বসবাস করতে পারে না। মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হয়। কোনো মানুষ চাইলে একা জঙ্গলে বাসতে পারবে না। তাকে অবশ্যই পরিবারের কাছে, সমাজে ফিরে আসতেই হবে। তাই পরিবারিক জীবনে, সমাজিক জীবনে যে গুণটি সবচেয়ে বেশি জরুরী, তা হলো ধৈর্য। সবর না থাকলে, ধৈর্য না থাকলে মানুষকে পরিবারে, সমাজে লজ্জিত হতে হয়। অপমানিত হতে হয়।
তাই প্রতিটি মানুষের যেমন পানির প্রয়োজন, পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না, তদ্রƒপ প্রতিটি মানুষের জীবনে ধৈর্য থাকা আরও বেশি জরুরী। একজন মানুষ সুঠাম দেহের অধিকারী। তার শরীরে প্রচণ্ড শক্তি। কিন্তু সে ধৈর্যশীল নয়। তবে সে সুঠাম দেহের অধিকারী হতে পারে, তার শরীরের প্রচণ্ড শক্তি থাকতে পারে, সে কিন্তু প্রকৃত শক্তিশলী নয়। প্রকৃত শক্তিশালী তো সে যে ধৈর্যশীল। যে সবর করে। কথায় কথায় রেগে যায় না। ধৈর্য ধরে। কথায় কথায় জলে ওঠে না। সবর করে।
আল্লাহ তা‘আলাও কুরআনে ধৈর্যশীলদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ বলেন,
{وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ} [البقرة : ১৫৫]
‘আর দেখ আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো (কখনও) ভয়-ভীতি দ্বারা, (কখনও) ক্ষুধা দ্বারা এবং (কখনও) জান-মাল ও ফসলহানী দ্বারা। যেসব লোক (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়, তাদেরকে সুসংবাদ শোনাও।’
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে কখনও কখনও পরীক্ষা করেন বালা-মুসীবতের দ্বারা। কখনও সেই বালা-মুসীবত আসে নিজের ওপর, কখনও আসে পরিবার-পরিজনের ওপর, আবার কখনও আসে ধন-সম্পদের ওপর। আল্লাহ মুসীবত দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষা করেন, দেখি আমার বান্দা মুসীবতে ধৈর্য ধরে কি না। যদি বান্দা আপতিত বিপদে ধৈর্য ধরে, তাহলে আল্লাহ বান্দার ওপর খুশি হন। খুশি হয়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন।
অথচ আমাদের ওপর কোনো বিপদ-আপদ আসলে আমরা ধৈর্য হারা হই। আবল-তাবল কথা বলি। যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। বিপদ তো আমাদের পেয়ারা রাসূলের ওপরও এসেছে, তাহলে শুনা যাক তিনি বিপদে পড়ে কী বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় ছেলে ইবরাহীমকে হারিয়ে বলেছেন,
إن العين تدمع و القلب يحزن و لا نقول إلا ما يرضي ربنا و إنا بفراقك يا إبراهيم لمحزونون.
‘চক্ষু তো অশ্রু বিসর্জন করে। অন্তর তো পেরেশান। তবে আমরা তো এমন কথা বলেবো, যে কথায় আমাদের রব খুশি হন। আর এমন কথা কখনই বলবো না, যে কথায় আমাদের রব অসন্তুষ্ট হন। হে ইবরাহীম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা শোকাহত।’
তাই আমাদেরকে রাসূল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তবেই আমারা প্রকৃত মুমিন হতে পারবো। আল্লাহ কুরআনে বলেন,
{إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ} [الزمر : ১০] ‘যারা সবর অবলম্বন করে তাদেরকে তাদের সাওয়াব দেওয়া হবে অগণিত।’
আয়াতে যে الصَّابِرُونَ এসেছে, এই الصَّابِرُونَ কারা? এটা নিয়ে মুফাসসিরে কিরাগণের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন এই الصَّابِرُونَ হলো ওই সকল লোক, যারা অটুট ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে ঈমানের ওপর ইসলামের ওপর অধিষ্ঠিত থাকে। সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হওয়া সত্ত্বেও ধর্মচ্যুত হয় না।
কেউ কেউ বলেছেন, ওই সকল হিজরতকারী যারা আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধাব ও জন্মভূমির বিচ্ছেদে ধৈর্যধারণ করেছে।
কেউ কেউ বলেছেন, الصَّابِرُونَ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, হযরত জাফর ইবনে আবূ তালেবসহ তাঁর সাথিসঙ্গীরা। যারা হিজরত করে হাবশায় বর্তমানে ইথিওপিয়ায় গিয়েছিলেন।
তবে এখানে الصَّابِرُونَ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ব্যাপক। অর্থাৎ যারা স্বভূমিতে প্রায়বন্দী অবস্থায় বহুবিধ অত্যাচারে জর্জরিত হয়েও স্বধর্মে অটল-অবিচল ছিলেন। তারাও الصَّابِرُونَ দ্বারা উদ্দেশ্য।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সকল আনুগত্যকারীকে ওজনে মেপে মেপে প্রতিদান দেওয়া হবে। কেবল ধৈর্যশীলেরা হবে এর ব্যতিক্রম। তাদেরকে ওপর তো প্রতিদান বর্ষিত হতে থাকবে বৃষ্টির মতো।
হযরত আনাস রাযিয়িাল্লাহু থেকে ইস্পাহানী বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (হাশরের মাঠে) দাঁড়িপাল্লা বসানো হবে, নামাযীদেরকে ডাকা হবে এবং ওজন অনুসারে তাদেরকে প্রতিদান দেওয়া হবে। এরপর ডাকা হবে আল্লাহর রাস্তায় দানকারীদেরকে। তাদেরকেও প্রতিদান দেওয়া হবে ওজন অনুসারে। হাজীদেরও প্রতিদান দেওয়া হবে এভাবেই। পরে ডাকা হবে বিপদে ধৈর্যধারণকারীদেরকে। কিন্তু তাদের জন্য থাকবে না কোনো তুলাদণ্ড, পুণকর্মের ফিরিস্তী, অথবা আমলনামা। তাদের ওপর বর্ষিত হতে থাকবে অপরিমেয় প্রতিদান। তখন পৃথিবীতে যারা স্বাস্থবান ছিলো তারা কামনা করবে, হায়! দুনিয়াতে যদি আমাদের শরীর কাঁচি দিয়ে কাটতে থাকা হতো। (তাহলে আমরাও হতাম অপরিমেয় সৌভাগ্যের অধিকারী।)
একটি হাদীস,
عَنْ جَابِرٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রيَوَدُّ أَهْلُ العَافِيَةِ يَوْمَ القِيَامَةِ حِينَ يُعْطَى أَهْلُ البَلَاءِ الثَّوَابَ لَوْ أَنَّ جُلُودَهُمْ كَانَتْ قُرِضَتْ فِي الدُّنْيَا بِالمَقَارِيضِগ্ধ
‘হযরত জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দুঃখ-দৈন্য ভোগকারীদেরকে যখন পুরস্কৃত করা হবে, তখন পৃথিবীর জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ ভোগকারীরা মনে মনে এই ভেবে আফসোস করতে থাকবে যে, পৃথিবীতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে যদি আমাদের গায়ের চামড়া কাঁচি দিয়ে কর্তন করা হতো। (তাহলে আমরাও আজ পুরস্কৃত হতাম।)’
একটি হাদীস,
عن أبي مالك الأشعري عن النبي صلى الله عليه و سلم إنه كان يقول : ... الصلاة نور و الصدقة برهان و الصبر ضياء.
‘হযরত আবূ মালেক আল আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ... নামায হলো নূর বা আলো, সদকা হলো বুরহান বা দলীল আর সবর হলো যিয়া বা উজ্জ্বল।’
এই হাদীসে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযকে বলেছেন নূর আর সবর তথা ধৈর্যকে বলেছেন যিয়া।
আল্লাহ কুরআনে বলেন, {هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا} [يونس : ৫] তিনিই সূর্যকে যিয়া তথা উজ্জ্বল করেছেন আর চাঁদকে করেছেন নূরানী তথা আলোকিত।’
একটি প্রশ্ন, সূর্য আর চাঁদের মাঝে কার বেশি আলো? কে বেশি উজ্জ্বল? কে বেশি শক্তিশালী? অবশ্যই সূর্যই চাঁদ থেকে বেশি শক্তিশালী।
এবার আসি আগের কথায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযকে চাঁদের আলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন আর সবর তথা ধৈর্যকে সূর্যের আলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই হাদীস থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, নামায থেকেও সবরের গুরুত্ব বেশি। অথচ নামাযের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, الصَّلاَةُ عِمَادُ الدِّينِ ‘নামায হচ্ছে দীনের খুটি।’
তাহলে এখন বুঝতে হবে নামায থেকে কীভাবে সবরের গুরুত্ব বেশি! সবর কীভবে উজ্জ্বল হলো! হ্যাঁ, একটু চিন্তা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। দীনের প্রতিটি আদেশ-নিষেধের সঙ্গে জাড়িয়ে আছে সবর তথা ধৈর্য। ধৈর্যের ওপরই নির্ভরশীল ইসলামের আদেশ-নিষেধ। ইসলামের প্রতিটি আদেশ পালনের আগে ধৈর্য থাকা খুবই জরুরি।
আর নিষেধও বেলায় একই কথা। শরী‘আতের প্রতিটি নিষেধ মেনে চলতে হলে থাকা চাই সবর তথা ধৈর্য। ধৈর্য না থাকলে শরী‘আতের আদেশ-নিষেধ মেনে চলাও সম্ভব হবে না। যেমন খুব শীতের সময় ফজরের নামায পড়তে হলে গরম লেপ-কম্বল থেকে বের হতে হবে। হাড় কাঁপানো শীতে ঠান্ডা পানি দিয়ে অযু করতে হবে। এরপর কুয়াশা ভেদ করে আসতে হবে মসজিদে। এতোগুলো কাজের সঙ্গে জাড়িয়ে আছে সবর তথা ধৈর্য। যদি কোনো ব্যক্তি সবর না থাকে তাহলে তার পক্ষে এই কনকনে শীতের সময় মসজিদে আসা সম্ভব নয়।
আর জিহাদে তো নিজের জানকে শত্রুর হতে রেখে লড়াই করতে হয়। নিজের জানকে শত্রুর হাতে রাখতে কী পরিমাণ সবর থাকা জরুরী তা আপনিই বরং চিন্তুা করুন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন, {وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ} [البقرة: ৪৫] ‘তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো ধৈর্যের মাধ্যমে এবং নামাযের মাধ্যমে।’ এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নামাযের আগে সবরকে এনেছেন। তাই বুঝা যায় সবরের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি নামায থেকে।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে আশন্বিত করে বলেন, তোমরা দুনিয়ার কল্যাণ চাও, পরকালে মুক্তি চাও, তাহলে তোমাদেরকে দুটি কাজ করতে হবে। ১. তোমাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে। ২. তোমাদেরকে নামায পড়তে হবে। তবেই তোমরা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের ভাগিদার হবে। এখানে ধৈর্য ধরার অর্থ হলো, সবরের সঙ্গে শরী‘আতের ফরয বিধানাবলি মেনে চলতে হবে।
কেউ কেউ বলেন, এখানে সবরের অর্থ হলো রোযা। কেননা রামযানকে বলা হয়েছে সবরের মাস। কেউ কেউ বলেন, এখানে সবর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, الصبر صبران: صبر عند المصيبة حسن، وأحسن منه الصبر عن محارم الله.
সবর দুই প্রকার।
প্রথমত, বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করা। এই সবর হলো হাসান। তথা উত্তম। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ যে সকল কাজ করতে নিষেধ করেছেন, অর্থাৎ শরী‘আতে যে সকল কাজ নিষিদ্ধ ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। আর এই সবরের নাম হলো আহসান। অর্থাৎ অতি উত্তম।
সবরের আরেকটি প্রকার হলো ইবাদত ও আনুগত্যে সবর করা।
আল্লাহ আরও বলেন, {فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ} [الأنفال : ৬৬] ‘তোমাদের মধ্যে যদি দৃঢ়চিত্ত এক শ লোক থাকে, তবে জয়ী হবে দুই শর ওপরে।’দেখুন এই আয়াতেও বলা হয়েছে এক শ জন ধৈর্যধারণকারী দুই শ জনের ওপর জয়ী হবে। সুতরাং ধৈর্যের সঙ্গে রয়েছে নুসরত তথা সাহায্য। ধৈর্য ধরলে সাহায্য আসবেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মাদীনায় এসেছেন। ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। তাই তো তিনিই আবার বীরের বেশে মক্কা বিজয় করেছেন। ধৈর্যই তাঁকে মক্কা বিজয়ের মতো সফলতা এনে দিয়েছে। তাই ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। তাই ধৈর্য ধরতে হবে। সবর করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে ধৈর্য ধরার তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক: শিক্ষক: মাদরাসা উলূমে শরী‘আহ, ৭৪/১-এ, উত্তর যাত্রাবাড়ী, মাদরাসা রোড, ঢাকা-১২০৪।
-এটি