মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
সৌদির সেবা কোম্পানির সঙ্গে হজ এজেন্সির চুক্তির নির্দেশনা মহেশখালী থানার বিশেষ অভিযানে পরোয়ানাভুক্ত ১১ জন আসামি গ্রেফতার বৃষ্টির সময় কাবা প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় ওমরা পালনকারীদের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট গ্রাহকদের মূলধন ফেরত পাওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন মাওলানা আতহার আলীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ইতিহাস রচিত হতে পারে না: ধর্ম উপদেষ্টা জরুরি সভা ডাকল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কক্সবাজারে উৎসবমুখর পরিবেশে রোপা আমন ধান কাটা শুরু চাঁদপুর হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় জামিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাহর সাফল্য বগুড়ায় আন্দোলনে নিহত রিপনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত

ধৈর্যের উপমা নবীপত্নী উম্মে হাবিবা রা.!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নূর মুহাম্মদ রাহমানী।। উম্মে হাবিবা রা.। ইতিহাসের আকাশে অন্তহীন আলো ছড়ানো এক নাম। ধৈর্যের উপমা। এই গুণের সার্থক সমৃদ্ধ জীবন। পৃথিবী এখনও আবাদ-চঞ্চল তাদেরই নামে। বাবা আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামস। মা সাফিয়া বিনতে আবিল আস ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ। তিনি ইসলামের চতুর্থ খলিফা ওসমান রা. এর ফুফু। অর্থাৎ উম্মে হাবিবা রা. ওসমান রা. এর ফুফাত বোন।

উম্মে হাবিবা রা. এর জন্মদিনের ঘটনা। ঘরে কয়েকজন নারী, আবু সুফিয়ান সোজা ভেতরে গেলেন, যেখানে বিবি সাফিয়া নবজাতক কন্যা নিয়ে বসা ছিলেন। অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকেন আপন কন্যার প্রতি। আনন্দের সায়রে ডুবতে থাকেন।

বিবি সাফিয়া স্বামীর চেহারায় খুশির আভা প্রত্যক্ষ করলেন। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার অন্তর বলছে, আমাদের নবজাতক আত্মজা অনেক বরকতময় হবে। সাফিয়া বললেন, হাঁ, তাই হবে। আবু সুফিয়ান খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখলেন, তার চেহারায় আশ্চর্য রকমের আলো চমকাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এ বাচ্চা পুরো বংশের জন্য রহমত হবে।

বাবা আবু সুফিয়ান নাম রেখেছিলেন রামলা। বাবা-মায়ের চোখের তারা। কোনো চাহিদা আর আবদার অপূর্ণ রাখতেন না। ছোট কোনো কষ্টেও খুব পেরেশান হতেন উভয়ে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত পাত্রও খুঁজতে শুরু করেন। শেষে উবাইদুল্লাহ ইবনে জাহাশের খোঁজ পেয়ে পুলকিত হন।

উবায়দুল্লাহর মা-বাবার কাছেও আবু সুফিয়ান কন্যা রামলার যৌবনে পদার্পন এবং বিভিন্ন দিক থেকে প্রস্তাব আসার সংবাদ পৌঁছল। তখন তারাও যোগ্য, সুদর্শন ও চরিত্রবান আত্মজের জন্য আবু সুফিয়ান পরিবারে আত্মীয়তা করাকে বেছে নিলেন। আবু সুফিয়ান রা. (তখনও তিনি মুশরিক) সুদর্শনা কন্যা রামলার বিয়ে অনুষ্ঠানে আরবের নানা গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকেরা অংশগ্রহণ করলেন। (উম্মাহাতুল মোমিমিন, প্রফেসর খালেদ, পৃ. ২৬৪)।

প্রিয়নবী সা. সাহাবিদের মজলিসে বসা ছিলেন। উবাইদুল্লাহ ও রামলা যুগলকে আসতে দেখে তাদের চেহারায় ভেসে ওঠল নুরানি আভা। তারা রাস্তা দিয়ে দিলেন। উভয়ে গিয়ে রাসুলের পায়ের কাছে বসলেন। রাসুল সা. জিজ্ঞেস করলেন, কেন এসেছ? হে আল্লাহর রাসুল, আপনার দ্বীনে দীক্ষিত করলে কৃতজ্ঞ হব। রাসুল সা. জিজ্ঞেস করলেন, কার কন্যা তুমি? রামলা বললেন, আমি আবু সুফিয়ানের কন্যা। আপনার নবুওয়াতের কথা শুনে মনটা আনন্দে ভরে ওঠল। অতঃপর স্বামী-স্ত্রী কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে ইসলাম গ্রহণে ধন্য হন। উপস্থিত লোকদের তখন খুশির অন্ত ছিল না! (আজওয়াজুর রাসুল উম্মাহাতুল মোমিনিন, পৃ. ৪৮৫-৪৮৬)।

জীবনের অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কারণ বাবা মক্কার প্রভাবশালী নেতা আবু সুফিয়ান ইবনে হারব। পরিণতি সম্পর্কে জেনেও ইসলাম গ্রহণ থেকে কেউ তাকে ফেরাতে পারেনি।

ইসলাম গ্রহণের পর স্বামী-স্ত্রী আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। সেখানে তাদের একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় হাবিবা। সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর উম্মে হাবিবা রা. একটি স্বপ্ন দেখেন। তার স্বামী উবাইদুল্লাহর চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। চোখ খোলার পর খুব উদ্বিগবোধ করলেন।

কয়েকদিন পর উবাইদুল্লাহ স্ত্রীকে বললেন, দেখ! আমি প্রথমে খ্রিস্টান ছিলাম, তারপর ইসলাম গ্রহণ করেছি। আবিসিনিয়ায় এসে আমার অনুভূতি হলো খ্রিস্টান ধর্মই ভালো। তাই আমি দ্বিতীয়বার খ্রিস্টান ধর্মকেই গ্রহণ করে নিয়েছি। আমার পরামর্শ হলো, তুমিও খ্রিস্টান হয়ে যাও। এটাই আমাদের জন্য উত্তম হবে। রামলা বিনতে সুফিয়ান স্বামীকে স্বপ্নের কথা শুনালেন, যাতে ভয়ে হলেও খ্রিস্টান হওয়ার ইচ্ছা থেকে ফিরে আসেন।

কিন্তু তিনি এর কোনো পরওয়া করলেন না; বরং মদপান শুরু করে দিলেন। সব সময় মদের নেশায় দুলতে থাকেন। উম্মে হাবিবা (রা.) বিষণ্ন হয়ে পড়লেন। একাকি জীবন। আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউ পাশে দাঁড়ানোর নেই। স্বামী খ্রিস্টান হয়ে গেল। বাবাও কাফের। এখন কী হবে! মহান আল্লাহর কাছে ধৈর্য ও দীনে অটল থাকার দোয়া করলেন। কিছুকাল পরে অতিরিক্ত মদপানের কারণে উবাইদুল্লাহ ইবনে জাহাশের মৃত্যু হয়।

এতটা কঠিন মুহূর্তেও তিনি ইসলামকে আগলে রাখলেন। নিরাশ হননি আল্লাহর সাহায্য আসা থেকেও। ফলে পুরস্কারও পেলেন জগতসেরা। পেলেন প্রিয়নবী (সা.) কে স্বামী হিসেবে। পেয়ে গেলেন পুরো মুসলিম জাতির মায়ের মর্যাদা। জান্নাতে নবীজির সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য।
তিনি এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, কে যেন তাকে উম্মুল মোমিনিন বলে ডাকছে। চোখ খোলার পর অনেক পুলক অনুভব করেন। এ সময় মহানবী (সা.) মক্কা নগরী থেকে হিজরত করে মদিনা মুনাওয়ারায় চলে এসেছেন।

ইসলামি সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করছেন। একদিন কোনো একজন নবী সা. এর কাছে আবিসিনিয়ায় অবস্থিত মুহাজিরদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত করে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আবু সুফিয়ান কন্যা উম্মে হাবিবা রা. একাকি অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। স্বামী মুরতাদ হয়ে মারা গেছে। কোলে একটা শিশুর বাচ্চা। তারপরও ধৈর্য ও দীনের ওপর অটল আছেন। মুসলিম বলে আত্মীয়-স্বজনরাও খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। তাকে আমাদের সহযোগিতা করা দরকার। রাসুল সা. উম্মে হাবিবা রা. এর কথা শুনে সহযোগিতার জন্য ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। সাহাবি আমর ইবনে উমাইয়া জামরি রা. কে আবিসিনিয়া সম্রাটের কাছে একটা পত্র হাতে পাঠালেন। চিঠিতে তিনি লিখলেন, উম্মে হাবিবা রা. যদি পছন্দ করেন, তাহলে তাকে আমার বিয়েবন্ধনে দেওয়া হোক।

ফলে আবিসিনিয়া সম্রাট আসহামা নাজ্জাশি জাফর ইবনে আবু তালেব রা. কে বলে দিলেন, মুলমান সম্প্রদায় আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার কাছে চলে আসবেন। সন্ধা হলে দাওয়াত মতো মুসলমান সবাই সম্রাটের শাহী মহলে একত্রিত হলেন। মুগ্ধ হওয়ার মতো সুখকর বিষয় হলো, সম্রাট নাজ্জাশির নিজেরও এ অনুষ্ঠানে খুশির অন্ত ছিল না।

কারণ উম্মে হাবিবা রা. এর বিয়েটা যে উভয় জাহানের সম্রাট মহানবী সা. এর সঙ্গে তার দরবারে তার হাতেই হচ্ছে। কত বড় সৌভাগ্যের বিষয়! নবী সা. এর বিয়ের উকিল হয়ে সম্রাট আসহামা ইতিহাসের সোনালী পাতায় নামযুক্ত করলেন। নবীর হয়ে ৪০০ দিনার মোহরানাও পরিশোধ করে দিলেন উম্মে হাবিবাকে রা.।

ঘটনাটি হিজরতের ৭ম বছরের। নবীপত্মী উম্মে হাবিবা সুন্দর সময় পার করছিলেন। ১৪ বছর পর বাবার সঙ্গে কন্যার মিলন ঘটল। বাবা তার কামরায় এসে যখন নবী সা. এর বিছানায় বসতে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে নবী সা. এর বিছানাটি গুটিয়ে ফেললেন। নওয়াজ রোমানি স্বীয় গ্রন্থ ‘আজওয়াজুর রাসুল উম্মাহাতুল মুমিনিন’ এ লিখেন, আবু সুফিয়ান অবাক হয়ে বললেন, জন্মদাতা বাবাকেও এ বিছানায় বসার উপযুক্ত মনে করো না! উম্মে হাবিবা বললেন, এটা নবী সা. এর মোবারক বিছানা। আর আপনি শিরকের নাপাকিতে আবদ্ধ। তাই চাই না, আপনার বসার দ্বারা এ বিছানার পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হোক! (পৃ. ৫০৮)।

নবীপ্রেম ছিল তার জীবনের অনুপম সৌন্দর্য। নবীর মুক্তোঝরা কথামালা লুফে নিতেন সযতনে। ভালোবাসার আতিশয্যে আবেদন করেছিলেন আপন বোন আজজা বিনতে সুফিয়ানকেও বিয়ে করার। কিন্তু নবী বললেন, সে আমার জন্য হালাল নয়।

দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে-পরের সুন্নতে মুয়াক্কাদা নামাজ সম্পর্কে একবার রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে ব্যক্তি ১২ রাকাত নফল নামাজ পড়বে, তার জন্য জান্নাতে ঘর বানানো হবে। উম্মে হাবিবা রা. এরপরে সারা জীবন কখনও এ ধরনের নফল ছাড়েননি।

উম্মুল উমিনিন উম্মে হাবিবা রা. জ্ঞান-বিদ্যা, প্রজ্ঞায় ছিলেন কানায় কানায় পূর্ণ। সরল বয়ানেও ছিলেন বেশ পারদর্শী। হাদিস শাস্ত্রে তিনি ছিলেন নবীপত্মীদের মধ্যে তৃতীয়। প্রথম ছিলেন আয়েশা রা. ও দ্বিতীয় ছিলেন উম্মে সালামা রা.। উম্মে হাবিবা থেকে ৬৫টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে ২টি মুত্তাফাক আলাইহি তথা বোখারি ও মুসলিমে আছে।

নবীজির ইন্তেকালের পর আরও ৩৩ বছর তিনি জীবিত ছিলেন। অবশেষে আপন ভাই মুয়াবিয়া রা. এর শাসনামলে ৪৪ হিজরিতে মদিনা নগরীতে ইন্তেকাল করেন। বয়স পেয়েছেন ৬৮। পরকালের সফরে যাওয়ার আগে আয়েশা রা. ও উম্মে সালামা রা. কে ডাকলেন। তারা এলে তাদের লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘আমাকে ওই ব্যাপারে ক্ষমা করবেন, যা একজন স্বামীর স্ত্রীদের মধ্যে হয়ে থাকে, তাই আপনাদের ব্যাপারে আমার থেকে যা কিছু হয়েছে ক্ষমা করে দেবেন।’ এত সুন্দর জীবনযাপন করার পরও মৃত্যুর সময় তিনি ক্ষমা চেয়েছেন সতীনদের কাছে।
নবীপত্মীগণ হলেন সমস্ত মুসলিম জাতির নারীদের জন্য আদর্শ নমুনা। নবীপত্মী উম্মে হাবিবা রা. এর পবিত্র জীবন গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে চলার অনেক অমূল্য পাথেয় সংগ্রহ হতে পারে।

শিক্ষক: হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ