মুফতি মুস্তাফা কামাল কাসেমী
হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। মহররমের দশ তারিখকে ইয়ামে আশুরা বলা হয়। আশুরার শাব্দিক অর্থ দশম। আশুরার তাৎপর্য কি? এ সম্পর্কে অনেক মতভেদ আছে।
অনেকে অনেক অপব্যাখ্যা করে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছে। সাধারণত আশুরা বলতে আমরা বুঝি যে, এই দিনে হযরত হুসাইন রাঃ কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে মর্মান্তিক ভাবে শাহাদৎ বরণ করেন।
এটাই হয়তো আশুরার তত্ত্বকথা। কিন্তু না, আশুরার তাৎপর্য ও ইতিকথা যেভাবে রাসূল সা. বলে গেছেন এবং হযরত সাহাবায়ে কেরাম রা. যে ভাবে পালন করেছেন বর্তমান যুগেও সেভাবে পালন করতে হবে। তাহলে সেটাই হবে শরীয়ত বা দ্বীন। সুতরাং এ মাসের গুরুত্ব অন্যান্য মাসের তুলনার আলাদা বলে বিবেচিত হয়েছে। বিশেষ করে আশুরার দশ তারিখ।
এ দিনটি অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় একটি দিন। পবিত্র মাহে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর্বে থেকেই মহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা ফরজ ছিল। পরবর্তীতে রমজানের রোজা এ উম্মতের উপর ফরয হওয়াই আশুরার রোজা নফল হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
আশুরার রোজার ফজিল: হাদিস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী এদিনের রোজা নফল হলেও এর গুরুত্ব ও মহত্ব কম নয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণিত, হুজুর সা. মক্কার কাফেরদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে সাহাবাগণকে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় হিজরত করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখছে।
হুজুর সা. জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা এ দিনে কিসের রোজা রাখো? উত্তরে তারা বললো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুছা আঃ এবং তার অনুসারী বনী ইসরাইল আল্লাহ কুদরতে কোন প্রকার নৌযান ছাড়াই এই মহাসমুদ্র লোহিত সাগর পার হয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেন।
তার অসীম মহিমায় পানি ছিদ্র হয়ে সমুদ্র গর্ভে বারটি রাস্তা বের হয়ে গেল এবং মুছা আঃ এর অনুসারীরা ফেরাউনের মত জালেম শাসকের হাত থেকে রক্ষা পেল। ফেরাউন বাহিনী পিছে ধাওয়া করে লোহিত সাগরের মধ্যে দিয়ে উক্ত রাস্তা বয়ে অতিক্রম করতে গেলে ফেরাউনসহ তার সৈন্যসামন্ত স্বদলবলে ইঁদুরের মত চুবানী খেয়ে মারা গেল।
এ দিনকে স্মারণ করে শুকরিয়া আদায় হিসাবে আমরা রোজা পালন করে থাকি। তাদের কথাগুলি শ্রবণ করার পর হুজুর সঃ বলেন, হযরত মুছা আঃ এর অনুসরণ- অনুকরনের ব্যাপারে আমরা বেশি হক রাখি। অতঃপর হুজুর সা. নিজে রোজা রাখলেন এবং সাহাবাদেরকে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, আগামী বছর যদি আমি জিবিত থাকি তাহলে এ রোজা পালন করবো (আবু দাউদ শরিফ)।
হযরত কাতাদাহ রাঃ হতে বর্ণিত, হুজুর সা. এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিন রোজা রাখবে আল্লাহ তা’য়ালা তার পূর্বের এক বছরের ছগীরা গোনাহ মাফ করে দিবেন (মুসলিম শরিফ) এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, ইহুদিরা শুধু মাত্র ১০ তারিখে রোজা রেখেছিলো। আমরাও কি ১০ তারিখে রোজা রাখবো? তার সমাধান ও ইসলামী শরীআতে রয়েছে। যেমন, হুজুর সা. বলেন, তোমরা ইহুদিদের বিপরীত ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখবে।
ফতুয়ায়ে মাহমুদিয়াতে আছে, যদি কোন ব্যক্তি শুধু ১০ তারিখে রোজা রাখে তাহলে মাকরুহ হবে। মোট কথা আশুরার দিনে রোজা রাখার সাথে সাথে সমস্ত নিয়ামতের শুকুর আদায় করার মনোভাব সৃষ্টি করায় হচ্ছে আশুরার দিনের বৈশিষ্ট্য। আশুরার পবিত্র দিনটি ইমাম হুসাইনের কারবালার শাহাদৎ বরণের কারণেই শুধু গুরুত্ব ও বেশিষ্ট্যের আসন পায়নি, বরং বিশ্বমানবতার ইতিহাসে বহু তাৎপর্য ও পূর্ণময় ঘটনা জড়িয়ে আছে এ দিনটির সাথে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় হযরত আদম ও হাওয়া আ. এর দোয়া এই দিনে কবুল হয়েছিল। এবং হযরত ইব্রাহিম আঃ নমরুদ কর্তৃক ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ড থেকে এই দিনেই নাজাত পেয়েছিলেন। হযরত নুহ আঃ এর কাশতি জুতি পাহাড়ে এই দিনেই ভিড়ে ছিলো। হযরত ইউনুস আঃ মাছের পেট থেকে এই তারিখেই মুক্তি পেয়েছিলেন।
হযরত হাফসা রাঃ হতে বর্ণিত, চারটি আমল এমন যা নবী সঃ কখনো ছাড়তেন না। (ক) আশুরার রোজা (খ) জিলহজ্জের প্রথম দশকের রোজা (গ) প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোজা (ঘ) ফজরের নামাযের পূর্বের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ (নাসায়ি শরিফ)।
উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা এ কথা সুস্পষ্ট ও দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হলো যে, শুধু কারবালার কারণেই এ দিনটি তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি, বরং আল্লাহ তা’য়ালা হযরত হুছাইন রাঃ এর শাহাদতের জন্য এমন একটি পবিত্র দিন নির্বাচন করেছেন, যার দ্বারা তার শাহাদতের মর্যাদা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই দিনে হযরত হুছইনের কারবালার ময়দানে মর্মান্তিক ভাবে শাহাদৎ সংগঠিত হওয়ায় সবার নিকট এ দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, বুজরুকগড়গড়ী মাদ্রাসা, চুয়াডাঙ্গা।
-এটি