মাওলানা শাহ মমশাদ আহমদ।।
লাশ দাফন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বিলম্ব করা সুন্নাহ পরিপন্থি ও রাসুলুল্লাহ সা, এর নির্দেশ বিরোধী নয় কি? যেহেতু রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমরা তাড়াতাড়ি মৃত ব্যক্তির দাফন কার্য সম্পাদন কর, কেননা সে যদি পুন্যবান হয়, তার জন্য উত্তম পরিনতি রয়েছে, তাকে তোমরা কল্যাণের দিকে নিয়ে যাচ্ছ। আর যদি সে এর ব্যতিক্রম হয়, তা হলে তার জন্য খারাপ পরিনতি রয়েছে, যাকে তোমরা তোমাদের কাধ থেকে তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিচ্ছ। (বুখারী, জানাযা অধ্যায়)
সামান্য পরিমাণ বিলম্ব করা যেতে পারে, দীর্ঘ সময় বিলম্ব করা মৃতের উপর অবিচার করার শামিল। কেননা নেকাত্মাকে যখন পরিবার পরিজন কবরস্থানের দিকে রওয়ানা হয় তখন সে বলতে থাকে আমাকে দ্রুত নিয়ে যাও, আমাকে দ্রুত নিয়ে যাও। (বুখারী,জানাযা অধ্যায়)
এতে প্রতিমান হয় নেক ব্যক্তির লাশ কবরস্থ করার জন্য দ্রুততা কামনা করে। আর আমাদের সমাজ আত্মীয় স্বজনের দেখার অজুহাতে, কখনো লোকসমাগম অধিক হবার অভিলাষে জানাযা বিলম্বিত করে। খ্যাতিমান আলেমদের লাশ দাফনে বিলম্ব করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে,অথচ উলামায়ে দেওবন্দের নীতি আদর্শ হচ্ছে অতি দ্রুত জানাযা দাফন সম্পাদন করা।
নিকট অতিতে ফেদায়ে মিল্লাত আল্লামা আস'আদ মাদানী রহ. সন্ধ্যায় ইন্তেকাল করেছেন, সকাল সাতটায় জানাযা হয়েছে। অতি সম্প্রতি দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস, বিশ্ববরেণ্য আলেম আল্লামা সাঈদ পালনপুরী রহ. কে তার কথা অনুযায়ী চারঘন্টার মধ্যে জানাযা দাফন করা হয়েছে, এটাই দেওবন্দীয়াত।
এছাড়া আমাদের দেশে খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের লাশ সামনে রেখে বক্তব্য প্রদানের একটি প্রথা চালু হয়েছে। প্রিয় নবী সা. জীবনে একবার কবর খননে বিলম্ব হওয়ার সুযোগে কবরস্থানে সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ্য করে আখেরাত বিষয়ে আলোচনা করেছেন, এছাড়া কখনো জানাযা সামনে নিয়ে বক্তব্য রাখেন নি।
জানাযার নামাজ সংগত কারণে বিলম্ব হলে যে কোন একজন বিদ্বান ব্যক্তি মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে আলোচনা করতে পারেন, জানাযার সামনে মানুষের মন নরম থাকে সে সুযোগে নাসিহত পেশ করা যেতে পারে কিন্তু লাশ সামনে রেখে বক্তব্য রাখার চলমান প্রথা, রাজনৈতিক পরিচয়ে বক্তব্যের ধারা, সুন্নাহ বিরোধী নয় কি?
কয়েকটি কারণে তা পরিতাজ্য
এক. সাধারণত বক্তব্যে মৃতব্যক্তির গুনের চেয়ে স্মৃতিচারনের সুযোগে বক্তার আত্মমর্যাদা তুলে ধরার অপচেষ্টা হয়।
দুই. রাজনৈতিক মঞ্চের মতো নিজকে উপস্থাপনের সুযোগ গ্রহণ করার মানসে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
তিন. জীবদ্দশায় মৃত ব্যক্তিকে এড়িয়ে চললেও জনপ্রিয়তা আদায়ের প্রত্যাশায় মায়াকান্না প্রদর্শন।
চার. মৃত্যুর মতো শোকাবহ পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে বক্তব্যের সুযোগ ও ধারাবাহিকতা কেন্দ্রিক পারস্পরিক বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
পাঁচ. বক্তব্য রেকর্ড ও লাইভ প্রদশর্নের রেওয়াজ সাধারণ মানুষের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে।
দারুসসালাম মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল আযীয দয়ামীরী রহ. এর জানাযা পূর্ব বক্তব্যে শায়খুল ইসলাম মদনী রহ. এর খলিফা গাজীনগরী রহ. বলেন, এ ধরণের বক্তব্যের রেওয়াজ বেদাতের আরেকটি নতুন সংযোজন।
আল্লাহ পাকেরই ইচ্ছা, হযরত গাজীনগরী মক্কায় ইন্তেকাল করেন, সেখানেই দাফন হয়, যেখানে বক্তব্যপর্বের কোন সুযোগ নেই।
উস্তাদে মুহতারাম মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা হাবীবুর রহমান রহ. ও এ প্রথা অপসন্দ করতেন, বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পরিহারের উদ্দেশ্যে অনেক জানাযায় দেরীতে উপস্থিত হতেন, যদিও পরিস্থিতির আলোকে অনেক সময় বক্তব্য ও রেখেছেন।
হযরত প্রিন্সিপাল রহ. এর জানাযা পূর্ব বক্তব্যপর্ব পরিস্থিতির আলোকে আমি পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছিলাম, হযরতের প্রিয়ভাজন সন্তানগন ছিলেন শোকেকাতর, নিজ রুহানী পিতার বিরহে ছিলাম বিপর্যস্থ, তারপরও বক্তব্য কেন্দ্রীক যে বিরুপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
তাই আমাদের দেশের হযরাত উলামায়ে কেরামের এবিষয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সময়ের দাবী। আবেগ নয়, কুরআন সুন্নাহের আলোকে সত্যিকার দীন ও দেওবন্দের চেতনা লালন করে এ সব প্রথার লাগাম টেনে ধরতে হবে। আল্লাহ তাওফিক দিন। প্রিয় নবীর সা. প্রদর্শিত পথে আল্লাহ আমাদের পরিচালিত করুন।
লেখক: মুহাদ্দিস- জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার সিলেট।
-এএ