নাঈম উদ্দীন জামী।।
সালাম আদান-প্রদান, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সর্বোত্তম মাধ্যম। এর মাধ্যমে যেমন পরস্পরের জন্য দোয়া করা হয়, তেমনি প্রীতিময় সুন্দর সুসম্পর্ক তৈরি হয়।
সালাম (سلام) আরবি শব্দ। এটি تسليم শব্দের ইসমে মাসদার। এর আভিধানিক অর্থ হলো- দোষ ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা। পবিত্র কুরআন মাজিদে سلام শব্দটি শান্তি ও নিরাপত্তা অর্থে ব্যবহিত হয়েছে। যেমন: পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, سلام على موسى وهارون.
পরিভাষায়, ❝আসসালামু আলাইকুম❞ বলে এক মুসলমান অপর মুসলমানের কল্যান কামনা করাকে সালাম ( سلام) বলা হয়।
কোনো মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হলে কথা বলার আগে সালাম দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রাসূল সা. বলেন, السلام قبل الكلم- অর্থাৎ, কথা বলার আগে সালাম দাও।
সালামের মাধ্যমে পরস্পর সহমর্মিতা, ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। সালাম দেওয়া সুন্নত আর সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব।
প্রথম সালামের প্রচলন: আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম আদম আলাইহিস সালামকে সালাম দেয়ার শিক্ষা দেন। হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর ফেরেশতাদের সালাম দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ফেরেশতাদের সালাম দিলে তারাও সালামের উত্তর দেন।
হাদিসে এসেছে- হজরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা যখন আদম আ. কে সৃষ্টি করলেন তখন তাকে বললেন, তুমি যাও এবং ঐ যে ফেরেশতামণ্ডলীর একটি দল বসে আছে, তাদের উপর সালাম পেশ কর। আর তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয় তা মনোযোগ সহকারে শ্রাবন করো। কেননা, ওটাই হবে তোমার ও তোমার সন্তান-সন্তুতির সালাম বিনিময়ের রীতি।’ সুতরাং তিনি (তাঁদের কাছে গিয়ে) বললেন, ‘আসসালামু আলাকুম’। তাঁরা উত্তরে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ’। অতএব তাঁরা ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ শব্দটা বেশি বললেন।’ (রিয়াদুস সালেহিন)
সালামের ফজিলত: ইসলামে সালামে ফজিলত অপরিসীম। সালামের মাধ্যমে যেমন পরস্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় তেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও সওয়াব লাভ করা যায়। বিভিন্ন হাদিসে সালামের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।
হজরত আবু উমামাহ রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহর সর্বাধিক কাছাকাছি মানুষ ওই ব্যক্তি; যে সর্বপ্রথম সালাম দেয়।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, মুসনাদে আহামদ)
একবার এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে এসে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’। তখন তিনি বললেন, লোকটির জন্য ১০টি নেকি লেখা হয়েছে। এরপর অন্য এক ব্যক্তি এসে (একটু বাড়িয়ে) বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লা ‘। তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তার জন্য ২০টি নেকি লেখা হয়েছে। এরপর অন্য এক ব্যক্তি এসে (আরও একটি শব্দ বাড়িয়ে) বললেন- ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু’। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সালামের) উত্তর দিয়ে বললেন, লোকটির জন্য ৩০টি নেকি লেখা হয়েছে।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ, মেশকাত)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইনবুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইসলামে সর্বোত্তম কাজ কী? তিনি বললেন, “(ক্ষুধার্তকে) খাবার দান করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সবাইকে (ব্যাপকভাবে) সালাম পেশ করবে।’ (মেশকাত, রিয়াদুস সালেহিন)
হজরত আবু হোরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, তোমরা ওই পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবে না, যে পর্যন্ত মোমিন না হয়ে যাও। (অর্থাৎ তোমাদের জিন্দেগি ইমানওয়ালা জিন্দেগি না হয়ে যায়।) এবং তোমরা ওই পর্যন্ত মোমিন হতে পারবে না যে পর্যন্ত পরস্পর একে অপরকে মহব্বত না করো। আমি কি তোমাদের ওই আমলটি বলে দেব না, যা করলে তোমাদের মধ্যে মহব্বত পয়দা হবে? ( সেটা এই যে) তোমরা পরস্পর সালামের খুব প্রচলন করো।
হজরত আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আগে সালাম করে, সে অহংকার থেকে মুক্ত। (বায়হাকি)
হাদিস শরীফে সালাম আদান প্রদানের বেশ কিছু আদব বর্ণিত হয়েছে।
১.শুনিয়ে সালাম দেওয়া: সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘আস-সালামু আলায়কুম’ বলতে হবে। عليك السلام (আলাইকাস সালাম) বলা সুন্নাত নয়।
আবূ জুরাই আল-হুজাইমী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট এসে বললাম, ‘عليك السلام’ (আলাইকাস সালাম)
ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘عليك السلام’
(আলাইকাস সালাম) বলো না। কারণ এটা হ’ল মৃতের প্রতি সালাম’। [আবু দাঊদ: ৫২০৯]
২. কথা বলার পূর্বেই সালাম দেওয়া: কথা বলার আগেই সালাম দেওয়া মুস্তাহাব। রাসূল সা. বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে প্রথমে সালাম দেয়’।[আবু দাঊদ: ৫১৯৭]
৩. কে কাকে সালাম দিবে: চলমান ব্যক্তি উপবিষ্টকে, আরোহী পদব্রজে ব্যক্তিকে, কম সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যককে এবং ছোটরা বড়দেরকে সালাম দিবে। রাসূল সা. বলেন, ‘আরোহী পদচারীকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’। [মিশকাত: ৪৬৩২] অন্যত্র তিনি বলেন ‘ছোটরা বড়দেরকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’ [বুখারী: ৬২৩১]
৪. সালামের আওয়াজ কেমন হবে: এমন শব্দে সালাম ও সালামের উত্তর দিতে হবে যাতে পরস্পর শুনতে পায়। তবে কোথাও ঘুমন্ত মানুষ থাকলে এমনভাবে সালাম দিবে যাতে জাগ্রত লোকেরা শুনতে পায় এবং ঘুমন্ত লোকের কোন অসুবিধা না হয়।
৫. নিজ গৃহে প্রবেশেকালে সালাম দেওয়া: বাড়ীতে বা গৃহে প্রবেশকালে প্রবেশকারী সালাম দিবে, যদিও ঐ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ ঐ ঘরে বসবাস না করে। আল্লাহ বলেন,- ‘অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে তখন পরস্পরে সালাম করবে। এটি আল্লাহর নিকট হ’তে প্রাপ্ত বরকমন্ডিত ও পবিত্র অভিবাদন’ (সূরা: আন-নূরঃ৬১)।
৬. অন্যের গৃহে প্রবেশেকালে সালাম: অন্যের বাড়ীতে বা ঘরে প্রবেশকালেও সালাম দিতে হবে। আল্লাহ বলেন,- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নিবে এবং এর বাসিন্দাদের সালাম দিবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর’ (সূরা: আন-নূরঃ ২৭)।
৭. প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দনকারী ব্যক্তিকে সালাম না দেওয়া: প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণে রত ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া উচিত নয়। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি নবী করীম সা. এর নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে তাঁকে সালাম করল, তিনি তখন পেশাব করছিলেন। তিনি তার সালামের জবাব দিলেন না’।[মুসলিম: ৩৭০]
৮. শিশুদের সালাম দেওয়া: শিশুদের সালাম দেওয়া মুস্তাহাব। শিশুরা সাধারণত বড়দের অনুকরণ করে। তাই শিশু থেকেই তাদের মাঝে সালাম বিনিময়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আনাস রা. একবার একদল শিশুর পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে তাদের সালাম করে বললেন যে, নবী করীম সা. ও অনুরূপ করতেন।[বুখারী: ৬২৪৭]
৯. ইয়াহুদী-নাছারাদের আগে সালাম না দেওয়া: ইহূদী-নাছারা ও বিধর্মীদেরকে আগে সালাম দেওয়া যাবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা ইহুদী-নাছারাদেরকে প্রথমে সালাম করো না’।[তিরমিযী:১৬০২,২৭০০] তবে তারা সালাম দিলে উত্তরে শুধু ‘ওয়া আলাইকুম’ বলতে হবে। রাসূল সা. বলেন, ‘যখন কোন আহলে কিতাব তোমাদের সালাম দেয়, তখন তোমরা বলবে ওয়া আলাইকুম (তোমাদের উপরেও)’। [বুখারী:৬২৫৮, ২৯৬২]
১০. পরিচিত-অপরিচিত সকল মুসলিমকে সালাম দেওয়া: মুসলিম মাত্রেই সালাম দেওয়া উচিত। সে আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, পরিচিত হোক বা অপরিচত। রাসূল সা. বলেন, ‘তুমি খাদ্য খাওয়াবে ও পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দিবে’।[মুসলিমঃ ৩৯]
১১.ইশরায় সালাম ও উত্তর না দেওয়া: ইশারায় সালাম দেওয়া যাবে না। তবে কেউ বোবা কিংবা দূরে অবস্থানকারী হলে মুখে উচ্চারণসহ ইশারায় সালাম বা উত্তর দিতে পারে। অনুরূপভাবে বধিরকে সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রেও মুখে উচ্চারণসহ ইশারায় সালাম বা উত্তর দেওয়া যাবে। রাসূল (সাঃ) বলেন,- ‘তোমরা ইহুদী-নাছারাদের সালামের ন্যায় সালাম দিও না। কেননা তাদের সালাম হচ্ছে হাত দ্বারা ইশারার মাধ্যমে’।[সহীহুল জামে: ৭৩২৭]
১২. সালামের সময় মাথা না ঝুঁকানো: সালাম প্রদানের সময় কারো সামনে মাথা অবনত করা বা ঝুঁকানো যাবে না। আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কোন একসময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কোন ব্যক্তি তার ভাই কিংবা বন্ধুর সাথে দেখা করলে সে কি তার সামনে ঝুঁকে (নত) যাবে? তিনি বললেন, না। সে আবার প্রশ্ন করল, তাহ’লে কি সে জড়িয়ে ধরে তাকে চুমু খাবে? তিনি বললেন, না। সে এবার বলল, তাহ’লে সে তার হাত ধরে মুছাফাহা (করমর্দন) করবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ’।[তিরমিযীঃ২৭২৮, ইবনে মাজাহঃ৩৭০২]
১৩.মুসলিম পুরুষের সাথে মুছাফাহা করা: মুসলমান পুরুষের সাথে সালাম বিনিময়ের পাশাপাশি মুছাফাহা করা মুস্তাহাব। রাসূল সা. বলেন, ‘দু’জন মুসলিম একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে মুছাফাহা করলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়’।[আবু দাউদ:৫২১২, তিরমিজি:২৭২৭]
১৪. গায়রে মাহরাম মহিলাদের সাথে মুসাফাহা না করা: যে সকল মহিলাদের সাথে বিবাহ বৈধ্য (গায়রে মাহরাম) তাদের সাথে মুসাফাহা করা হারাম। মহানবী সা. সকল মহিলার শ্রদ্ধার পাত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি (বেগানা) কারো সাথে মুসাফাহা করতেন না। ৫২৭ (আহমাদ ৬/৩৫৭, নাসাঈ ৭/১৪৯, ইবনে মাজাহ ২৮৭৪ নং) বায়আতের সময়েও তিনি কোন মহিলার হাত স্পর্শ করতেন না। ৫২৮(বুখারী ৫২৮৮, মুসলিম ১৮৬৬ নং) আর তিনি বলেছেন, “যে মহিলা (স্পর্শ করা) হালাল নয়, তাকে স্পর্শ করার চেয়ে তোমাদের কারো মাথায় লোহার ছুঁচ গেঁথে যাওয়া অনেক ভালো।” ৫২৯ (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ৫০৪৫ নং)
১৫. মুসলিম-অমুসলিম সম্মিলিত সমাবেশে সালাম দেওয়া। মুসলিম-অমুসলিম সম্মিলিত সমাবেশে সালাম দেওয়ার বিধান সম্পর্কে আল্লামা ঈমাম নববী র. বলেন, কোনো বৈঠকে বা জায়গায় মুসলিম-অমুসলিম একত্রে উপস্থিত থাকলে, তখন সালাম দেওয়ার পদ্ধতি হলো- السلام على من اتبع الهدى. বলবে।
অনুরূপভাবে কোনো অমুসলিমের নিকট পত্র লিখার সময়ও অনুরূপ লিখবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
-এএ