মুহাম্মাদ রাফে।।
একটি বছর ঘুরে শুরু হলো নতুন হিজরী বছর— ১৪৪৩। হিজরী সন আরবি হলেও এই সনটিকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সন হিসেবেই গ্রহণ করা হয়।সেজন্য ইসলামি শরিয়তে হিজরী সন, মাস ও তারিখ জানা থাকা ফরযে কেফায়া। সকল মুসলমানদের জানা থাকা উচিৎ।
কেউই যদি খবর না রাখে তাহলে সবাই গুণাহগার হবে। কেননা হিজরী সনের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে ব্যাপক। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষত ইবাদতের তারিখ, সময় ও মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিজরী সনের প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন: হজ্ব, রোজা, যাকাত, ঈদ ইত্যাদি।
হিজরী বা ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহাররম। মুহাররম শব্দটি আরবী, যার অর্থ— পবিত্র, সম্মানিত। কোরআনে বর্ণিত চারটি পবিত্রতম মাসের মধ্যে এটি একটি। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, "নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না। (সুরা- তওবা, আয়াত-৩৬)
হাদীসে বর্ণিত,হযরত আবু বক্কর (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, এক বছর হলো বারো মাসের সমষ্টি। তার মধ্যে চারটি মাস অতি সম্মানিত। সেগুলো হল— জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম, চতুর্থটি হল রজব। (সহিহ বুখারী, হাদীস নং ২৯৫৮)
আশুরার দিবস ও তার আমল– মুহাররম মাসের দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। এই মাস ও আশুরার দিন প্রাচীনকাল থেকেই মর্যাদাবান ও মাহাত্ম্যপূর্ণ এবং স্মরণীয় ও বরণীয়।
জানা থাকা ভালো— প্রতিটি ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য অন্যতম দুটি শর্ত রয়েছে। এক. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করা। দুই. রাসূল (সা.)-এর আনীত শরিয়ত এবং বর্ণিত পথ ও পন্থা অনুসারে ইবাদত করা।
আশুরার দিনেরোযা রাখা সুন্নত এবং এটিই এ দিনের প্রধান আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই রোজা নিজে পালন করেছেন। উম্মতকে রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তাই এর পূর্ণ অনুসরণ ও আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে উম্মতের কল্যাণ।
এই দিন রোজা রাখার ব্যাপারে বুখারি শরিফের ১৮৬৫ নং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় এলেন তখন দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন: কেন তোমরা রোজা রাখো? তারা বললো: এটি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করেছেন; তাই মুসা আলাইহিস সালাম এ দিনে রোজা রাখতেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা আ. এর অধিক নিকটবর্তী। ফলে তিনি এ দিন রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।'
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আশুরার রোজা ফরজ ছিলো। দ্বিতীয় হিজরি সনে রমজানের রোজাকে ফরজ করা হলে আশুরার রোজা ঐচ্ছিক হিসেবে বিবেচিত হয়। আশুরা দিবসে রোজা পালনের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "রমজানের পর সর্বাধিক উত্তম রোজা হলো মুহাররম মাসের অর্থাৎ আশুরার রোজা। আর ফরজের পরে সর্বাধিক উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।" (সহিহ মুসলিম: ১/৩৫৮)
আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
আশুরার রোযার উত্তম পদ্ধতি হলো– মুহাররামের দশম তারিখের সঙ্গে নবম তারিখ অথবা ১১ তারিখ যোগ করে মোট দুইটি রোযা রাখা। কেননা এই দিনে ইহুদিরা একটি রোজা রাখে। মুসলমানদের আমল তাদের থেকে ভিন্ন রাখার জন্যই এমন পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবসময় বিধর্মীদের অনুকরণ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।
আশুরার দিনে বর্জনীয় বিষয়– আশুরার দিন ক্রন্দন-বিলাপ করা, বুকে চাপড়ানো, পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করা, নিজেকে রক্তাক্ত করা ও শোক মিছিল করা কোনোটিই শরিয়ত সম্মত নয় বরং ইসলাম পরিপন্থী কাজ ।
এক হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, "তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।"
আশুরার দিন ভালো খাবারের আয়োজন করা ও ভালো কাপড় পরিধানের ব্যাপারেও কোন হাদিস বর্ণিত নেই। শরিয়তের কাজ মনে করে কেউ এমন করলে তা বিদআ'ত বা কুসংস্কার হবে।
অতএব, আশুরার দিন শোক-মাতম না করে এখান থেকে কী শিক্ষা নেয়া যায় সে চেষ্টাই করা উচিত। আরেকটি কথা স্মরণ রাখা আবশ্যক— আশুরা মানে কারবালার ঘটনা নয়; এদিন ঐতিহাসিক অনেক ঘটনা ঘটেছে। কারবালার ঘটনা সেই ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
যার মধ্যে সকল মুসলমানদের অনেক শিক্ষার উপকরণ রয়েছে। অতএব হুসাইন রা. এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।
মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো যথা– রোযা, তওবা- ইস্তেগফার, এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক চলাই সকল মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের ইসলাম পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত থেকে শরীয়ত নির্দেশিত কাজ করার তৌফিক দান করুন,আমিন।
-এটি