মুহাম্মাদ মাহদী হাসান
ইখলাস হলো মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মুসলমানদের একত্ববাদের বিশ্বাস ও আমলের প্রতিদানের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা ইখলাস বিহীন সম্পূর্ণ বৃথাই পরিণত হবে।
ইখলাসের আভিধানিক অর্থ:
ইখলাস শব্দটি আরবি 'আখলাসা' শব্দ হতে নির্গত। এ শব্দের 'মুজারেয়' হল, 'য়ুখলিসু' আর এর মাছদার, 'ইখলাসান' অর্থাৎ নিরেট বা খাটি বস্তু; কোনো বস্তু নির্ভেজাল ও খাটি হওয়া এবং তার সাথে কোন কিছুর সংমিশ্রণ না থাকাকে ইখলাস বলে। যেমন, বলাহয় ' আখলাসার রাজুলু দ্বীনাহু লিল্লাহ' অর্থাৎ, লোকটি তার দ্বীনকে কেবল আল্লাহর জন্যই খাস করল। লোকটি তার দ্বীনের বিষয়ে আল্লাহর সাথে কাউকে মিলায়-নি বা শরিক করে নি।
মানবজাতি ও জ্বীন জাতিকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনা করে মহান রব্বুল আলামিন। পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ' আমি মানবজাতি ও জীন জাতিকে সৃষ্টি করেছি, একমাত্র আমি( আল্লাহ পাকের) ইবাদাত করার জন্যে।
মুফাসসিরগণ উক্ত আয়াতের ব্যখ্যায় উম্মতকে বুঝানোর নিবৃত্তে প্রশ্ন করে বলেন। আমরা তো শারিরীক,পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদা পূরণে নামাজ, রোজা, হজ্ব,যাকাত, আদায়ের পর জীবিকা নির্বাহের কাজে,অফিস আদালত, ব্যবসা বাণিজ্য, ও কৃষি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকি, তাহলে কিভাবে আল্লাহ তা'য়ালার ঘোষণার উপর আমল করা সম্ভব হবে?
অর্থাৎ (কেবলমাত্র আল্লাহ পাকের ইবাদাত করা কিভাবে সম্ভব?) প্রশ্নের সাথে সাথে মুফাসসিরীনে কেরামগন, উত্তরে বলেন, বান্দার সমস্ত কাজকর্ম যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ অনুসারে, একনিষ্ঠতার সাথে, কেবলমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হবে, তখন এসকল কর্মকাণ্ড ইবাদাতের মাঝে গণ্য করা হবে।
অপর দিকে যদি কোন ব্যক্তি নিয়মিত নামাজ,রোজা, হজ্ব, যাকাত ও ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহ, সহ নফল আমলের নিয়মিত পাবন্দীও হয়।আর যদি ইখলাস না থাকে, তাহলে এসকল আমলের কোনটিই ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হবে না।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন, আপনি বলুন: আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল। [সূরা: আল আন’আম, আয়াত: ১৬২- ১৬৩]
আর আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত ব্যতিত দিনরাত একাকার করে যত আমল'ই করা হোক তাতে বিন্দুমাত্র প্রতিদানের আশা ও করা যাবেনা।
এপ্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,'সমস্ত আমল'ই নিয়তের ( বিশুদ্ধতার) উপর নির্ভরশীল, মানুষের জন্য তাই রয়েছে, যা সে নিয়ত করে। সুতরাং যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দিকে হয়, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্যেই হয়েছে বলে পরিগনিত হবে।
যার হিজরত দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে হবে, অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, তাহলে হিজরত যে উদ্দেশ্যে করেছে, সেজন্যেই হয়েছে বলে পরিগনিত হবে। (বুখারী শরীফ)
তাই আমল কবুল হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ নিয়তের বিকল্প নেই। আর বিশুদ্ধ নিয়ত হলো যা কিছু করা একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার নিভৃত্তে'ই করা।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে}
সূরা: আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৫
নিয়তকে বিশুদ্ধ করে অল্প আমল'ই মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে। এপ্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তুমি তোমার ইমানকে বিশুদ্ধ করো,অল্প আমল'ই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে। (আল-হাদিস)
আল্লাহ পাক মানবজাতিকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন, মানুষের আমলের পরিক্ষা করবার জন্যে,কে ইখলাসের সাথে আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে আমল করে? আর কে মানুষকে দেখানোর জন্য, বা দুনিয়া অর্জন করার নিভৃত্তে আমল করে?এজন্য মানুষকে দুনিয়াতে জীবন দান করেছেন।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ?
সূরা: আল মুল্ক, আয়াত: ২
মানুষকে ইবাদাতের পথনির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারিম অবতীর্ণ করেছেন।এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ অনুযায়ী একনিষ্ঠতার সাথে ইবাদাত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন: আমি আপনার প্রতি এ কিতাব যথার্থরূপে নাযিল করেছি। অতএব, আপনি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন। জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ এবাদত আল্লাহরই নিমিত্ত। সূরা: আয যুমার, আয়াত: ২- ৩
ইখলাস বিহীন কেউ যদি দিনরাত একাকার করেও নামাজ, রোজা, হজ,যাকাত, ও কোরবানি সহ সকল ধরনের ইবাদাতে নিমগ্নও থাকে তথাপি সে এসকল ইবাদাত সমূহের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে। সূরা: আল কাহা
আমাদের 'সমাজ' ধনী গরিব, সুন্দর কালো, উঁচু নিচু, শক্তিধর ও দূর্বলদের মাঝে তারতম্য করলেও, আল্লাহ তা'য়ালার কাছে এসবের কোন মূল্য নেই। আল্লাহ তা'য়ালা, কে ধনী কে গরিব, কে সুন্দর, কে কালো, কে উঁচু, কে নিচু, কে ক্ষমতাধর, কে ক্ষমতাধর নয়, এসবের কোন মূল্য নেই।
আল্লাহ তা'য়ালা দেখেন, বান্দার অন্তরে কি রয়েছে। সুন্দর হওয়াতে যদি আল্লাহ তা'য়ালার কাছে কোন দাম থাকতো, তাহলে হাবশি কালো বেলাল (রাঃ) এর এতো মর্যাদা হতোনা। অথচ; রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজের রজনীতে জান্নাতে হযরত বেলাল (রাঃ) এর পয়ের( চলাচলের) আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন।
হযরত বেলাল( রাঃ) এর এই মর্যাদা অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে নয়। এই মর্যাদা হযরত বেলাল (রাঃ) এর ইমান,আমল ও ইখলাসের বিনিময়ে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহপাক তোমাদের শরীর ও অবয়বের দিকে তাকান না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে লক্ষ করেন।’ (মুসলিম শরিফ, ২৫৬৪)
ইখলাস বিহীন আমলের পরিনতি, আল্লাহপাক কোরআন করিমে বলেন; আমি ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির জন্য তারা যেসব আমল করবে , আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলিকণা করে দেব।(সুরাহ ফুরকান:২৩)
এপ্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে হযরত আবু হুরাইরা( রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে ব্যক্তির বিচার কার্য সম্পাদন করা হবে , তিনি হলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হন, অতঃপর তাকে ডাকা হবে ,এবং তার নিকট আল্লাহ তা'য়ালার নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতে পারবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এ সব নিয়ামত পেয়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, তোমার রাস্তায় আমি যুদ্ধ করছি, এবং শহীদ হয়েছি। আল্লাহ তা'য়ালা বলবেন , তুমি মিথ্যা বলেছ।তুমি যুদ্ধ করেছ, যাতে মানুষ তোমাকে বাহাদুর বলে। তা তোমাকে বলা হয়েছে।
অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে,তাকে তার চেহারার উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে । এক ব্যক্তি ইলম অর্জন করল, মানুষকে শিখাল, এবং কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করলো। অতঃপর তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে, এবং তার উপর আল্লাহর নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতে পাবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এ বিষয়ে কি আমল করেছ?সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি এবং শিখিয়েছি। তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন পড়েছি। তিনি বলবেন , তুমি মিথ্যা বলেছ, তুমি ইলম শিখেছ, যাতে তোমাকে আলেম বলা হয়। আর কুরআন তিলাওয়াত করেছ, যাতে তোমাকে এ কথা বলা হয়, লোকটি ক্বারি। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে, তাকে তার চেহারার উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
এক ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা সামর্থবান করেছেন এবং তাকে বিভিন্ন ধরনের ধন-সম্পদ দিয়েছেন। তারপর তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে এবং তার উপর আল্লাহর নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতে পাবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এ বিষয়ে কি আমল করেছ?সে বলবে, তোমার জন্য, তুমি যে পথে ব্যয় করাকে পছন্দ কর, সে ধরনের কোন পথ আমি ছাড়িনি, যেখানে আমি তোমার জন্য ব্যয় করিনি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, তবে তা করছ, যাতে লোকেরা তোমাকে এ কথা বলে, লোকটি দানবীর। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হলে, তাকে তার চেহারার উপর ,উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।(নাউযুবিল্লাহ)
আল্লাহ পাক এধরনের ক্ষতিগ্রস্তদের অশুভ পরিনতি থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমাদেরকে একনিষ্ঠতার সাথে একত্ববাদ ও ইখলাসের উপর আমল করবার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী (ইফতা বিভাগ) জামিয়া ইসলামিয়া গাওয়াইর, দক্ষিণখান,ঢাকা।
-এটি