মাওলানা উসামা বিন আবদুর রশীদ ।।
কোরবানি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং ইবাদতের একটি বিশেষ প্রকার। কোরবানি ইসলামের অন্যতম শিআর বা ধর্মীয় প্রতীক। ইসলামে কোরবানির অর্থ হল, ‘আল্লাহ তাআলার সন্তষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থায় শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কোন প্রিয় বস্তু আল্লাহ তাআলার দরবারে পেশ করা এবং শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থায় তা ব্যবহার করা’।
আল্লাহ ও তার রাসূলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে কোরবানিতে। ইসলামি শরীয়তে কুরবানীর যে পন্থা ও পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূলসূত্র ‘মিল্লাতে ইবরাহিমী’তে বিদ্যমান ছিল । এজন্য কোরবানিকে ‘সুন্নাতে ইবরাহিমী’ নামে অভিহিত করা হয়। কোন ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য সৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রচলন বেশ পুরোনো। কিন্তু ইসলাম এই ‘সুন্নাতে ইবরাহিমী’কে স্বরণীয় করে রাখার জন্য স্থাপনা নির্মাণের প্রচলনকে বাদ দিয়ে তার সাদৃশ্য অবলম্বন করাকে ইবাদত বানিয়ে দিয়েছে। এ স্মৃতি যা আমলের মাধ্যমে উম্মতের জন্য আবশ্যক করে দেয়া হয়েছে তা কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য এই বার্তা বহন করে যে আল্লাহর জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবজাতির পূর্ণতা ও সফলতা।
যখন এটা জানা থাকবে যে এই কোরবানি ‘সুন্নাতে ইবরাহিমী’র মার্যাদা রাখে, তখন এটাও স্পষ্ট হয়ে যাবে যে পশুর মূল্য সদক্বা করা বা অন্য কোন নেক কাজে ব্যয় করা সেই দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে না।
ঈদুল আযহার দিবস মুসলমানদের জন্য খুশির দিবস। আরাফা দিবসের ব্যাপক মাগফিরাত, আল্লাহর দরবারে কোরবানি পেশ করার সৌভাগ্য এবং কবুল হওয়া কোরবানি থেকে মেহমানদারী অর্জন এই খুশির মূল কারণ। কুরবানীর দিন কিছুটা খুশি ও আনন্দ উদযাপন করা সেই ইবাদতেরই পূর্ণাঙ্গতার স্বরূপ। শরীয়তের যেকোন ইবাদতের ক্ষেত্রে ইখলাসের পাশাপাশি প্রধান লক্ষ্যণীয় বিষয় হল প্রিয়নবীর আদর্শ। তাই আমরা আজ এখানে দেখার চেষ্টা করব যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল আযহার এই মহামান্বিত দিবস কিভাবে অতিবাহিত করতেন।
ক) ঈদুল আযহার দিনের সর্বপ্রথম আমল হল ঈদের নামাজ আদায় করা। হযরত বারা ইবনে আযেব রা. বলেন,
خطبنا النبي صلى الله عليه وسلم يوم النحر، قال: «إن أول ما نبدأ به في يومنا هذا أن نصلي، ثم نرجع، فننحر فمن فعل ذلك فقد أصاب .سنتنا، ومن ذبح قبل أن يصلي، فإنما هو لحم عجله لأهله ليس من النسك في شيء
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিলেন। তাতে বললেন, আমাদের এই দিবসে প্রথম কাজ ঈদের নামায আদায় করা। সুতরাং যে এভাবে করবে তার কাজ আমাদের তরীকা মতো হবে। আর যে আগেই যবেহ করেছে (তার কাজ তরীকা মতো হয়নি) অতএব তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত গোশত, (আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত) কুরবানী নয়।-সহীহ বুখারী ৯৬৮
খ) নামাযের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর পশু যবেহ করতেন। নিজের পশু নিজ হাতেও জবাই করতেন।
عن جابر في حديث طويل… ثم انصرف(النبي صلى الله عليه و سلم) إلى المنحر، فنحر ثلاثا وستين بدنة بيده.
হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, ‘অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর স্থানে এলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি উট নহর করলেন’।-সহীহ মুসলিম ১/৩৯৪
গ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কুরবানী করতেন এবং কুরবানী করার সময় যা পড়তেন।
হযরত আনাস রা. বলেন,
ضحى النبي صلى الله عليه وسلم بكبشين أملحين، فرأيته واضعا قدمه على صفاحهما، يسمي ويكبر، فذبحهما بيده.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি সাদা-কালো বর্ণের (বড় শিং বিশিষ্ট) নর দুম্বা কুরবানী করেছেন। আমি দেখেছি, তিনি দুম্বা দু’টির গর্দানে পা রেখে ‘বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’ বললেন। অতঃপর নিজ হাতে যবেহ করলেন।-সহীহ বুখারী ৫৫৫৮
জাবির রা. থেকে বর্ণিত,
ذبح النبي صلى الله عليه وسلم يوم الذبح كبشين أقرنين أملحين موجأين، فلما وجههما قال: «إني وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض على ملة إبراهيم حنيفا، وما أنا من المشركين، إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين لا شريك له، وبذلك أمرت وأنا من المسلمين، اللهم منك ولك، وعن محمد وأمته باسم الله، والله أكبر» ثم ذبح
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন দু’টি সাদা-কালো, বড় শিং বিশিষ্ট, খাসি দুম্বা যবেহ করেছেন। তিনি যখন তাদের শায়িত করলেন তখন বললেন,
إني وجهت وجهي…
এরপর যবেহ করলেন।-সুনানে আবু দাউদ ২৭৮৮
আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত,
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم أمر بكبش أقرن يطأ في سواد، ويبرك في سواد، وينظر في سواد، فأتي به ليضحي به، فقال لها: «يا عائشة، هلمي المدية»، ثم قال: «اشحذيها بحجر»، ففعلت: ثم أخذها، وأخذ الكبش فأضجعه، ثم ذبحه، ثم قال: «باسم الله، اللهم تقبل من محمد، وآل محمد، ومن أمة محمد» ثم ضحى به.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর জন্য একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা আনতে বললেন। যার পা কালো, পেটের চামড়া কালো এবং চোখ কালো। দুম্বা আনা হলে নবীজী বললেন, আয়েশা, আমাকে ছুরি দাও। এরপর বললেন, একটি পাথরে ঘষে ধারালো করে দাও। তিনি ধারালো করে দিলেন। এরপর তিনি ছুরি হাতে নিলেন এবং দুম্বাটিকে মাটিতে শোয়ালেন। এরপর বিসমিল্লাহ বলে জবাই করলেন এবং বললেন-
اللهم تقبل من محمد، وآل محمد، ومن أمة محمد.
ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মাদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন।-সহীহ মুসলিম১৯৬৭
ঘ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কুরবানীর পাশাপাশি উম্মাহাতুল মুমিনীন, এমনকি নিজ উম্মতের পক্ষ থেকেও কুরবানী করেছেন।
عن عائشة قالت: … وضحى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن نسائه بالبقر.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ হতে গরু দ্বারা কুরবানী করেছেন।-সহীহ বুখারী৫৫৫৯
ঙ) পরিবারবর্গসহ নিজে কুরবানীর পশুর গোশত ভক্ষণ করতেন এবং অন্যদেরকেও খাওয়ানো ও গোশত ছদক্বা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। হযরত আবু রাফে’ রা. বলেন,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا ضحى اشترى كبشين… فإذا خطب وصلى قام في مصلاه فذبح أحد الكبشين… ثم يطعمها جميعا للمساكين ويأكل هو وأهله منها.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কুরবানী করতেন। তখন তার গোশত গরিবদেরকে খাওয়াতেন, পরিবারবর্গসহ নিজেও সেখান থেকে খেতেন। -সুনানে বাইহাক্বী ৯/২৫৯
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত,
…فقال(رسول الله صلى الله عليه وسلم): كلوا، وأطعموا، واحبسوا.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (কুরবানীর গোশত) তোমরা নিজেরাও খাও, অন্যদেরকেও খাওয়াও..।-সহীহ মুসলিম১৯৭৩
চ) অনেক সময় তিনি সাহাবীদের মাঝে সরাসরি কুরবানীর পশুও বন্টন করতেন।
قسم النبي صلى الله عليه وسلم بين أصحابه ضحايا، فصارت لعقبة جذعة، فقلت: يا رسول الله، صارت لي جذعة؟ قال: «ضح بها»
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা নিজ সাহাবীদের মাঝে কুরবানীর পশু বন্টন করলে হযরত উক্ববা রা. ও সেখান থেকে একটি পেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি এটা দিয়েই কুরবানী কর।-বুখারী ৫৫৪৭