।।মুফতি মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান।।
১. আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। - হজ : ৩৪
২. কুরবানীর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তার কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের তাকওয়া। -সূরা হজ-৩৭
৩. যায়েদ ইবনে আরকাম রা. হতে বর্ণিত সাহাবায়ে কেরাম রাসুল সা. জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসুলালাল্লাহ! এই কুরবানী কি? রাসুল সা. বলেন, এটি তোমাদের পিতা ইবরাহীম আ. এর সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম বললেন এতে আমাদের কি সওয়াব রয়েছে, রাসুল সা. বলেন : কুরবানীর পশুর প্রতিটি লোমের পরিবর্তে একটি করে নেকি রয়েছে।
৪. কোন স্বাধীন ও ধনী মুসলমানের নিকট সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার উপর আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কুরবানী করা ওয়াজিব। অর্থাৎ কেউ যদি তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ঘরের আসবাবপত্র ও নিত্য প্রয়োজনীয় খরচাদির অতিরিক্ত ২০০ দিরহাম কিংবা ২০ দিনার বা সমপরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
৫. অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় এবং তার অভিভাবকের জন্য তার সম্পদ থেকে কুরবানী করা জায়েজ নেই। যদি তার সম্পদ থেকে কুরবানী করে তাহলে অভিভাবকের জন্য গোস্ত ভক্ষণ করা ও সদকা করা জায়েজ নেই, তবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান ভক্ষণ করতে পারবে।
৬. কুরবানী মুসলিম ধনাঢ্য ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। কাফেরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, কেননা এটি মহা মনিবের নৈকট্য লাভের মাধ্যম, আর কাফের আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপযুক্ত নয়।
১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত যার উপর কুরবানী ওয়াজিব সে কুরবানী না করলে উক্ত দিনগুলো চলে যাওয়ার পর তার জন্য একটা বকরীর মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।
৭. হারাম পথে উপার্জিত মালের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, কেননা হারাম মাল সদকা করা ওয়াজিব।
৮. উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ছাগল, ভেড়া, নর কিংবা মাদি হোক এই কয় প্রকার গৃহপালিত জন্তু দ্বারা কুরবানী জায়েজ।
৯. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া, নর কিংবা মাদি হোক কমপক্ষে এক বৎসর বয়সের হতে হবে।
১০. যদি ৬ মাস বয়সের ভেড়া ও দুম্বা এত মোটা তাজা হয় যে, দেখতে এক বছরের ভেড়ার মত লাগে অর্থাৎ এক বছরের ভেড়া কিংবা দুম্বার মাঝে ছেড়ে দিলে যদি পার্থক্য দেখা না যায় তাহলে ৬ মাস বয়সী ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ।
১১. গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে নর কিংবা মাদী হোক কমপক্ষে দুই বৎসর পরিপূর্ণ হতে হবে। উটের বয়স ৫ বছর পূর্ণ হওয়া জরুরী।
১২. কুরবানীর পশু সব দোষ ক্রুটি মুক্ত হতে হবে এবং সুস্থ, সবল ও হৃষ্টপুষ্ট হওয়া ভাল।
১৩. অতিশয় দুর্বল জন্তু যে জবেহের স্থান পর্যন্ত হেটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ নয়।
১৪. যে জন্তুর সব দাত নেই। সে খেতে সক্ষম হোক বা না হোক, তা দ্বারা কুরবানী জায়েজ নেই।
১৫. যে পশুর জন্ম সূত্রে কান নেই তা দ্বারা কুরবানী সহিহ হবে না।
১৬. যে জন্তুর এক তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে বেশী দৃষ্টিশক্তি চলে গিয়েছে তা দ্বারা কুরবানী জায়েজ নয়।
১৭. দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে একথা প্রমাণের জন্য চোখের এক দিকে ঘাস রেখে দেখতে হবে, সে ঘাসের দিকে যাচ্ছে কিনা এবং কিভাবে যাচ্ছে যদি ঘাসের দিকে এগিয়ে যায় কিংবা মুখ বাড়ায় তাহলে বুঝতে হবে তার দৃষ্টিশক্তি ঠিক আছে, অন্যথায় নয়।
১৮. বকরী, খাসী, পাঠা, ভেড়া-ভেড়ী ও দুম্বায় একজনের বেশী শরিক হতে পারবেন না, একজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা যাবে।
১৯. একটা উট, গরু, মহিষ ও বলদে একজন থেকে সর্বোচ্চ সাতজন লোক শরিক হতে পারবে।
২০. নর ও মাদী জন্তুর মাঝে যদি উভয়ের মূল্য ও গোশত সমান হয় তাহলে মাদি দ্বারা কুরবানী উত্তম।
২১. কুরবানীকারীর নিয়তকে খালেস করতে হবে, কারণ নিছক গোস্ত ভক্ষণের নিয়তে কুরবানী করলে সহিহ হবে না।
২২. কুরবানী একমাত্র মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে করতে হবে। অংশীদারদের কেউ যদি নিছক গোস্ত ভক্ষণ ও লোক দেখানোর জন্য কুরবানী করে, তাহলে কারো কুরবানী সহিহ হবে না। তাই শরীক নির্বাচনে খু-উ-ব সজাগ হওয়া চাই।
২৩. রাসুলুল্লাাহ (সাঃ), তাঁর স্ত্রীগণ ও বুযুর্গদের পক্ষ থেকেও কুরবানী করা যেতে পারে।
২৪. শরিকদারদের মাঝে যদি কোন ব্যক্তি শিয়া মতাবলম্বী হয় তাহলে কারো কুরবানী সহিহ হবে না।
২৫. কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি কুরবানীর জন্যখাসী বা দুম্বা খরিদ করার পর যদি তা মারা যায়, কিংবা চুরি হয়ে যায় বা কুরবানীর দিনগুলোর মাঝে হারিয়ে যায়। এমতাবস্থায়, ঐ ব্যক্তি উপর অন্য আরেকটি পশু ক্রয় করে কুরবানী করা ওয়াজিব।
২৬. কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি কুরবানীর জন্য একটি ছাগল ক্রয় করার পর ছাগলটি হারিয়ে যায়, অতঃপর সে আরেকটি ছাগল ক্রয় করে, এমতাবস্থায় হারানো ছাগলটি পেয়ে যায় তাহলে ঐ ব্যক্তির জন্য উভয়টা জবেহ করা উত্তম। যদি শুধু প্রথমটা জবেহ করে তাহলেও যথেষ্ট হবে, দ্বিতীয়টি কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। প্রথমটার মূল্য দ্বিতীয়টির চেয়ে কম হোক বা বেশী হোক তাতে কোন সমস্যা নেই।
২৭. যদি কুরবানীর গাভীর দুধ দোহন করা ব্যতীত অন্য কোন উপায় না থাকে তাহলে দুধের স্তনে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দুধ শুকিয়ে দেয়া উচিত, আর যদি না শুকায় এবং গাভীর কষ্ট হয় তাহলে দুধ দোহন করে সদকা করে দিবে।
২৮. কেউ যদি কুরবানীর পশু খরিদ করার পর অন্য ব্যক্তি চুরি করে নিয়ে মালিকের অনুমতি ব্যতীত যবেহ করে দেয় ক্ষেত্রে মালিকের কুরবানী আদায় হবে না।
২৯. কুরবানীর গোস্তের মত আকিকার গোস্তও নিজে খেতে পারবে।
৩০. যদি কোন মহিলা কুরবানীর পশু আল্লাহর নামে যবেহ করে তাহলেও কুরবানী সহিহ হবে।
৩১. মেশিনে যদি শরিয়ত আলোকে আল্লাহর নামে যবেহ করা হয় তথা সুইস বিসমিল্লাহ বলে চালু করা হয় তাহলে জায়েজ হবে, নচেৎ নয়।
৩২. কুরবানীর চামড়া শুকিয়ে বা প্রক্রিয়াজাত করে কুরবানীকারী নিজেও ব্যবহার করতে পারবে।
৩৩. কুরবানীর চামড়ার মূল্য ঈদগাহ মেরামতের কাজে খরচ করা জায়েজ নেই।
৩৪. কুরবানীর পশু ক্রয় করতঃ লাল কাপড়, ফুলের মালা ইত্যাদি পরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বাজারে বাজারে ঘুরিয়ে লোক দেখানোর যে প্রথা আমাদের দেশে প্রচলিত তা শরিয়ত সম্মত নয়। কেননা যশ-খ্যাতি, রিয়া, অহংকার-গর্ব, ক্ষমতা ইত্যাদি প্রকাশ করণার্থে কুরবানী করা কুরআন, সুন্নাহ, হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রের বিধানুযায়ী অকাট্য হারাম।
৩৫. কুরবানীর চামড়ার মূল্য মাদরাসা, মসজিদ, চিকিৎসালয়ের বিল্ডিং নির্মাণে প্রদান করা যাবে না এবং চামড়ার মূল্য উল্লিখিত স্থানে প্রদান করা জায়েজ নেই। কেননা উহা নিঃস্বদের হক।
৩৬. কুরবানীর চামড়ার মূল্য মাদরাসায় পড়–য়া এতিম গরিব ছাত্রদের খাদ্যের ব্যয় বাবদ প্রদান করা জায়েজ।
৩৭. কুরবানীর চামড়া বিক্রি করলে নিজে উহার অর্থ ব্যয় করতে পারবে না, বরং সদকা করে দিতে হবে।
৩৮. কেউ যদি কুরবানীর পশুর মাঝে তিন অংশে আকিকা ও বাকী চার অংশে কুরবানী করে এতেও কুরবানী সহিহ হবে।
৩৯. ৯ জিলহজ সুবহে সাদিক তথা ফজরের পর থেকে ১৩ জিলহজ আসর নামায পর্যন্ত সর্বমোট তেইশ ওয়াক্তে প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর একবার তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব। চাই জামাতে নামায পড়া হোক বা একাকি পড়া হোক।
৪০. কুরবানীর গোস্তকে আইয়ামে তাশরিকের পরও জমা করে রাখা জায়েজ। কেননা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন আমি তোমাদেরকে কুরবানীর গোস্ত জমা করে রাখতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা ভক্ষণ কর ও জমা করে রাখ তাতে কোন সমস্যা নেই।
৪১. কুরবানীর গোস্তকে তিন ভাগ করা উত্তম ও মুস্তাহাব। এক ভাগ গরিব মিসকিনদের জন্য, আরেক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের জন্য, আরেক ভাগ নিজেদের জন্য রাখা উত্তম।
তথ্যসূত্র : রদ্দুল মুহতার : ৯/৪৫৩, ফতহুল কাদির : ৮/৪২৫, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৬, কাযিখান : ৪র্থ খন্ড/৪২৮, আল বাহরুর রায়েক : ৮/১৭৪, হিন্দিয়া : ৫/২৯২, শামি : ৯/৪৫৩, কাযিখান : ৪/৩২৯, বাদায়ে : ৪/১৯৭, আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৪৯৮, কেফায়াতুল মুফতি : ৮/১৯৪, রদ্দুল মুহতার : ৯/৪৫৪, বাদায়ে : ৪/১৯৫, শামি : ৯/৪৫৩ , শামি : ৯/৪৫৭, বাদায়ে : ৪/২০৬, আলমগীরি : ২৯৭/৫, বাদায়ে : ৪/২০৬, হিন্দিয়া : ৫/২৯৭, বাদায়ে : ৪/২০৬, হিন্দিয়া : ৫/২৯৭, নিজামুল ফাতাওয়া : ২/৩৪৭, মাহমুদিয়া : ৪/৩২৬, ২৯৬ , বাদায়ে : ৪/২২৪, মুগনি : ১১/১০১, শামি : খন্ড ৯ম, পৃঃ ৪৭৪।
-কেএল