আ.স.ম আল আমীন।।
যুবকদের নফস খারাপ দিকে ধাবিত করে, অশ্লীলতা তাদের আনন্দ দেয়। আরাম-আয়েশ করার চিন্তা অন্তরে সব সময় লেগেই থাকে। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম যুবকদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, তিনি যখন যুবক বয়সে উপনিত হলেন, তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সুন্দরী ও ধনাঢ্য রমনী যৌন চাহিদা পূরনের প্রস্তাব দেন।
তিনি পূর্ণ বয়সে থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর ভয়ে তা প্রত্যাখান করেন, হযরত ইউসুফ আ. তখন নিজের দেশের বাইরে ছিলেন, সেখানে কেউ তাকে চিনতেন না, তাকে কেউ তিরস্কারও করতেন না। তিনি অবিবাহিত একজন যুবক এবং যৌন চাহিদা পূরনের জন্য কোন স্ত্রীও ছিল না, আর তিনি আযিযের স্ত্রীর অধিনেই ছিলেন, এত সুযোগ থাকা সত্যেও আল্লাহর ভয়ে তা প্রত্যাখান করেন।
আর যখন সে তার পূর্ণ যৌবনে উপনীত হলো, আমি তাকে ফায়সালা করার শক্তি ও জ্ঞান দান করলাম। এভাবে আমি নেক লোকদের প্রতিদান দিয়ে থাকি ( সুরা ইউসুফ: ২২) কুরআনের ভাষায় সাধারণ শব্দের মানে হয় নবুওয়াত দান করা৷ ফায়সালা করার শক্তিকে কোরআনের মূল ভাষ্যে বলা হয়েছে হুকুম।
এ হুকুম অর্থ কর্তৃত্বও হয়। কাজেই আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন বান্দাকে হুকুম দান করার মানে হলো আল্লাহ তায়া’লা তাকে মানবজীবনের বিভিন্ন বিষয়ে ফায়সালা দেওয়ার যোগ্যতা দান করেছেন আবার এ জন্য ক্ষমতা ও অর্পণ করেছেন।
আর জ্ঞান বলতে এমন বিশেষ সত্যজ্ঞান বুঝানো হয়েছে যা নবীদেরকে ওহীর মাধ্যমে সরাসরি দেয়া হয়। ঐ রমনী সকাল সন্ধ্যা তাকে তার দিকে আহবান করেছিলেন।
গোপনে নয় বরং খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ইউসুফ আ. কে আহবান করে বলেছিলো এসোনা। কিন্তু ইউসুফ আ. তার এসকল কিছুকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, আমার রব তো আমাকে ভালোই মর্যাদা দিয়েছেন আর আমি একাজ করবো? এধরনের জালেমরা কখনো কল্যান লাভ করতে পারেনা। (সুরা ইউসুফ ২৩) ঐ রমনী যখন ইউসুফ আ. কে ধোঁকায় ফেলতে ব্যর্থ হলো, তখন সে মহিলাদের সামনে এসে হুমকি স্বরুপ বললো।
সে বললো, দেখলে তো এ হলো সেই ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে তোমরা আমার বিরুদ্ধে নিন্দা করতে। অবশ্যই আমি তাকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সে নিজেকে রক্ষা করেছে। যদি সে আমার কথা না মেনে নেয় তাহলে কারারুদ্ধ হবে এবং নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে। ( সুরা ইউসুফ ৩২)
ইউসুফ বললো, হে আমার রব, এরা আমাকে দিয়ে যে কাজ করাতে চাচ্ছে তার চাইতে কারাগার আমার জন্য অধিক প্রিয় আর! আর যদি এদের চক্রান্ত থেকে আমাকে না বাঁচা ও তাহলে আমি এদের ফাঁদে আটকে যাবো এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হবো। (সুরা ইউসুফ ৩৩)
ইউসুফ আ. এ দুটি পছন্দের মধ্যে একটি বেছে নিতে বাধ্য ছিলেন। একটি ছিল তার দ্বীনের ব্যাপারে ক্ষতি, অপরটি ছিল তার দুনিয়ার ব্যাপারে ক্ষতি। দ্বীনের ব্যাপারে ক্ষতি ছিল সে যিনা করে ফাসেকদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর দুনিয়ার ব্যাপারে ক্ষতি ছিল যে , সে জেলে যাবে এবং অপমানিত হবে। কিন্তু তিনি তার দ্বীন কে দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কে শিক্ষা দিয়েছেন যে, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে মুসিবতে ফেল না । তুমি দুনিয়াকে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় উপলক্ষ বানিয়ে দিওনা , এবং আমাদেরকে জ্ঞানের চুড়ান্ত প্রান্ত সীমায় পৌঁছে দিও না। পৃথিবীতে আরেক যুবক ত্যাগের নাজরানা পেশ করেন, তিনি হলেন ইসমাইল ' যবিহুল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহর রাহে স্বেচ্ছায় জীবন উৎসর্গকারী এবং তিনি হলেন শেষ নবী মোহাম্মদ সা. এর মহান পূর্ব পুরুষ।
তিনি ছিলেন হযরত ইব্রাহিম আ. এর প্রথম পুত্র এবং হাজেরার গর্ভে জন্ম। তিনি মক্কাতেই বড় হন, সেখানেই বসবাস করেন এবং সেখানে মৃত্যু বরণ করেন। কোরবানির মহান ঘটনা মক্কাতেই ঘটে, তিনি কখনো কেনানে আসেননি। পিতা ইব্রাহিম তাকে নিয়ে মক্কায় কাবা গৃহ নির্মাণ করেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন হযরত ইসমাইল যবিহুল্লাহ আ. এর সম্পর্কে উপমা অনেক যুবকের সামনে পেশ করেছেন।
একজন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য কত বড় ত্যাগের নাজরানা পেশ করতে পারেন সেটাই তার বড় দৃষ্টান্ত। কেয়ামত পর্যন্ত যুব সমাজের জন্য প্রেরণা। মহান রাব্বুল আলামিন ইসমাইল আ. সম্পর্কে বর্ননা করেছেন, যিনি মহান আল্লাহর আনুগত্য করতে গিয়ে নিজেকে হাসিমুখে তার রবের সামনে পেশ করেছিলেন।
যখন সে তার পিতার সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে এমন বয়সে এসে উপনীত হলো, তখনই তার পিতা তাকে প্রশ্ন করলেন, হে পুত্র আমি স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে আমি যবেহ করেছি তখন ইসমাইল আ. তার পিতার এ প্রশ্নের জবাবে বললেন, হে আব্বাজান আপনাকে যা হুকুম দেয়া হয়েছে তা করে ফেলুন আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন। ( সুরা সাফফাত ১০২) হযরত ইসমাইল আ. ছিলেন পিতা ইব্রাহিম আ. এর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মা হাজেরার গর্ভজাত একমাত্র সন্তান।
ঐ সময়ে ইবরাহিম আ. বয়স ছিল ৮৬ বছর। শিশু বয়সে তাকে ও তার মাকে পিতা ইব্রাহিম আ. আল্লাহর নির্দেশে মক্কার বিজনভূমিতে রেখে আসেন। সেখানে ইব্রাহিমের দোয়ার বরকতে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে জমজম কুপের সৃষ্টি হয়। অতপর ইয়েমেনের ব্যবসায়ী কাফেলা বনু জুরহুম গোত্র কর্তৃক মা হাজেরার আবেদনক্রমে সেখানে আবাদ শুরু হয়।
১৪ বছর বয়সে আল্লাহর হুকুমে মক্কার অনতি দূরে মিনা প্রান্তরে সংঘটিত হয় বিশ্ব ইতিহাসের বিস্ময়কর ত্যাগ ও কর্মী ঘটনা। পিতা ইব্রাহিম কর্তৃক পুত্র ইসমাঈলকে স্বহস্তে কুরবানির উক্ত ঘটনায় শতবর্ষীয় পিতা ইবরাহিমের ভূমিকা যাই হোক না কেন চৌদ্দ বছরের তরুণ ইসমাঈলের ঈমান ও আত্মত্যাগের একমাত্র নমুনা ছিলেন তিনি নিজেই।
তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে সমর্পণ না করলে পিতার পক্ষে পুত্র কোরবানীর ঘটনা সম্ভব হতো কি- না সন্দেহ। তাই ঐ সময় নবী না হলেও নবি পুত্র ইসমাইলের আল্লাহ ভক্তি ও দৃঢ় ঈমানের পরিচয়, ফুটে উঠেছিল তার কথায় ও কর্মে। এরপর পিতার সহযোগী হিসেবে কাবা গৃহ নির্মানে শরিক হন। এবং কাবা নির্মান শেষে পিতা - পুত্র মিলে যে প্রার্থনা করেন, স্বয়ং আল্লাহ তায়া’লা তাদের এ প্রার্থনা পবিত্র কোরআনে বর্ননা করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। ( সুরা বাকারা ১২৭-১২৯)
নবী ইউসুফ ও ইসমাঈল আ. দু’জন যৌবনে ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা আজো মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে, তেমনি একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মানে তারুণ্যেরা এরকম ত্যাগের নজির স্থাপনের বিকল্প নাই।
লেখক: শিক্ষার্থী, মা' হাদুল ইকতিসাদ ওয়াল ফিকহীল ইসলামী, ঢাকা।