মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দিন আহমদ।। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোনো না কোনো দিন অবশ্যই এমন আছে, যার মধ্যে তারা স্বাভাবিক ভাবে আনন্দ খুশি করে থাকে।উত্তম পোশাক পরিধান করে,ভালো উন্নত মানের খাবার রান্না করে খায়। তাই হাদিসের মধ্যে বর্ণিত আছে,لكل قوم عيد وهذا عيدنا প্রত্যেক জাতির জন্য ঈদ রয়েছে, এটা হলো আমাদের ঈদ।
ইসলাম ধর্ম উৎসবের দু’টি দিন নির্ধারিত করেছে।ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা । এ দু’টি ঈদ মূলত মুসলিম জাতীর ধর্মীয় এবং জাতীয় উৎসবের দিন। এ দুই দিন ছাড়া মুসলমানদের কেউ কেউ আরো যে উৎসব পালন করে থাকেন,তার কোন ধর্মীয় ভিত্তি নেই বরং ইসলামের দৃষ্টিতে সেগুলোর অধিকাংশ কুসংস্কার।
ঈদের রাতের ফজলিত :
হযরত আবূ উমামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সওয়াবের আশায় দুই ঈদের রাতে ইবাদত করবে, তার দিল ( কেয়ামতের কঠিন ) দিনেও মরবে না, যে দিন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কারণে সব দিল মৃত্যুবরণ করবে ।অর্থাৎ যে ব্যক্তি দুই ঈদের দিন নিজ প্রতিপালকের সাথে মিলিয়ে রাখবে, কেয়ামতের দিন সে নিরাপদ ও শান্তিতে থাকবে।
কেউ কেউ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে ইবাদত করবে তার দিল দুনিয়ার মোহে অন্ধ হবে না । এবং সে অপমৃত্যু থেকে নিরাপদ থাকবে । তাই দুই ঈদের রাতে সারারাত এবাদত করা, নফল নামাজ পড়া মুস্তাহাব । ( তারগীব ও তারহীব ২/৩৮৪, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ২/৩৩৫)
ঈদের সংজ্ঞা
ঈদের শাব্দিক অর্থ প্রত্যাবর্তন করা। আনন্দ উৎসবের দিনকে ঈদ বলা হয় । কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় মুসলমানগণ বছরে যে দু’টি দিবসকে আনন্দ উৎসবের দিন হিশেবে পালন করে থাকে তাকে ঈদ বলা হয়।
ঈদের নামাযের হুকুম
ঈদের নামায পড়া ওয়াজিব। তাই যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে যেন ঈদের নামায পড়া যায়।( বাদায়েউস সানায়ে ২/২৩৬)
ঈদের নামাযের শর্ত
ঈদের নামাযের জন্য শর্ত তা’ই, যা জুমআর নামাযের জন্য শর্ত। পার্থক্য শুধু জুমআর নামাযের আগে খুতবা পড়া জরুরি,আর ঈদের নামাযের পর খুতবা পড়া সুন্নত। (বাদায়েউস সানায়ে২/২৩৭)
যাদের উপর ঈদের নামায ওয়াজিব
যে ব্যক্তির উপর জুমআর নামায ওয়াজিব তার উপর ঈদের নামাজও ওয়াজিব। ঈদের নামাযের পর খুতবা দেয়া সুন্নত। ঈদের নামাযের পূর্বে খুতবা পড়ে নিলে মাকরূহের সাথে নামায আদায় হবে।(বাবাদায়েউস সানায়ে২/২৩৭,২৪০,২৪১
আলমগীরী ৩/৬৩,কিতাবুল ফিকহ ১/৫৪৮)
ঈদের সূচনা কাল
রাসূলুল্লাহ সা. যখন হিজরত করে মদিনায় তাশরীফ নিলেন,তখন থেকে মুসলিম জাতীর সামাজিক জীবন শুরু হয়। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা এ দুই ঈদ হিজরতের পর থেকে উদযাপন শুরু হয়।
এব্যাপারে দু’টি অভিমত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, প্রথম হিজরী সনে ঈদের নামাজের বিধান প্রবর্তিত হয়। তবে অধিকাংশ আলেমদের মতে দ্বিতীয় হিজরী সনে তার বিধান প্রবর্তিত হয় । ( আবু দাউদ-মিশকাত শরীফ হাদীস ১/১৩৫৫)
ঈদের নামাযের তারিখ
ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয় রামাজান মাস শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে। আর ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ উদযাপিত হয় যিলহজ্ব মাসের দশ তারিখে।
এবছর বাংলাদেশে ঈদুল আজহা পালন করা হবে ২১ই জুলাই ২০২১ ইংরেজি বুধবার ১০ই জিলহজ্ব ১৪৪২ হিজরী তারিখে ইনশাআল্লাহ।
ঈদের নামাযের সময়
সূর্য এক বা দুই বর্শা পরিমাণ উচ্চতায় উঠা থেকে শুরু করে যাওয়াল তথা সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত বাকি থাকে ।( বাদায়েউস সানায়ে ২/২৪২, মাআরিফুল হাদিস ৩/৪০৩,দুররে মুখতার ১/৭৯১)
ঈদের নামাযের স্থান
ঈদের নামায স্বাভাবিক অবস্থায় খোলা মাঠে পড়ারই বিধান। ঈদের জামাত মাঠে আদায় করা সুন্নত। ওজর ছাড়া মাঠ বর্জন করা সুন্নাতের খেলাফ। তবে কোন ওজরের কারণে মসজিদে আদায় করাতে কোন সমস্যা নেই।
(সহীহ বুখারী হাদীস : ৯৪৬-৯৫৬,মিশকাত শরীফ হাদিস : ১/১৩৪২,উমদাতুল কারী কিতাবুল ঈদাইন ৬/২৮১ ,৫/১৭১,মাযাহেরে হক ২/২৯৪)
ঈদের নামাযের আযান ইকামত
হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রা:) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন,আমি একবার দুইবার নয়,বহুবার রাসূলুল্লাহ(সা:) এর সাথে আযান ইকামত ছাড়া নামায আদায় করেছি । (মাআরিফুল হাদিস :৩/৪০০ সহীহ মুসলিম)
উল্লেখিত হাদিস এবং ফিকহের আলোকে প্রতীয়মাণ হয় যে,ঈদের নামাযে আযান ইকামত নেই। এটিই সুন্নত তরিকা ।( ফাতাওয়া দারুল উলুম ৫/২৩৭)
ঈদের খুতবা
ঈদের খুতবা সুন্নত,শ্রবণ করা ও চুপ থাকা ওয়াজিব।নামাযের পূর্বে বা খুতবার পরে চাদা উঠানো হলে সমস্যা নেই। তবে খুতবা চলাকালীন সময়ে তা বৈধ নয়।(বাহরুর রায়িক ২/২৮৩,ফাতাওয়া রহীমীয়্যাহ ৫/৮৮ কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/৮৫)
খুতবার পর দুআ নেই
ঈদের নামাযের পরে অন্যান্য নামাযের মতো দুআ করা মাসনুন ও মুস্তাহাব। কিন্তু খুতবার পরে দুআ করার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। এবং জায়েয ও নয়।( দারুল উলুম৫/২৩১,২১৯,১২৫,২১৩, ফাতাওয়া উসমানী ১/৫৪৭)
ঈদের নামাযের কাজা
দুই ঈদের নামায ওয়াজিব। কারো থেকে যদি তা ছুটে যায়,তাহলে সম্ভব হলে অন্য কোন ঈদগাহ মাঠে বা মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে শরীক হবে। যদি তাতে সম্ভব না হয় তাহলে কিন্তু পরে এর কাজা করতে পারবেনা । কারণ ঈদের নামাযের কাজা নেই। (হিন্দিয়া ১/১৫২,কিতাবুল ফাতাওয়া৩/৮৬ )
ঈদের জামাত না পেলে করণীয়
ঈদের জামাত জুমআর মতো শর্ত। তা ছুটে গেলে অন্য কোন স্থানে যাওয়া যদি সম্ভব হয় সেখানে গিয়ে শরীক হবে । অন্যথায় ওজরের কারণে অন্য জামাতে শরীক না হতে পারলে, চার রাকাত চাশতের নামায আদায় করে নিবে । তবে তা ঈদের নামায বলে বিবেচিত হবে না । (কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/৮২, হিন্দিয়া ১/১৫২, দুররে মুখতার ১/৭৯৫)
ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীর
ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীরগুলো হলো ওয়াজিব। তাকবীরে তাহরীমা এবং রুকুর তাকবীর ব্যতীত প্রতি রাকাতে তিনটি করে তাকবীর বলা ওয়াজিব। এগুলো বলার সময় উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠানো সুন্নত । (আযীযুল ফাতাওয়া ১/৩০১,৩০৯)
ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর ছুটে গেলে করণীয়
যদি ঈদের অতিরিক্ত তাকবীরের কোন একটি ছুটে যায় তাহলে ওয়াজিব ছুটে যাওয়ার কারণে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হয়। কিন্তু যেহেতু ঈদের এবং জুমআর নামাযে সিজদায়ে সাহু লাযিম হয়না,তাই উক্ত ওয়াজিব ছুটে গেলেও ঈদের নামায সহীহ হয়ে যাবে ।( ফাতাওয়া উসমানী১/৫৫২)
ঈদের নামাযে মাসবুক হলে
যদি কেউ প্রথম রাক’আতে অতিরিক্ত তাকবীরের পর ইমামের ইকতেদা করে তাহলে সে প্রথমে তাকবীরে তাহরীমা বলে অতিরিক্ত তাকবীর তিনটি বলবে। যদি কেউ ইমামকে প্রথম রাক’আতের রুকু অবস্থায় পায়,তাহলে সে ব্যক্তি তাকবীরে তাহরীমা বলার পর অতিরিক্ত তাকবীর বলে রুকুতে যাবে।
আর যদি আশংকা হয় যে,অতিরিক্ত তাকবীর বলতে গেলে ইমামকে রুকুতে পাবেনা,তাহলে সে প্রথমে রুকুতে যাবে । রুকুতে থাকা অবস্থায় রুকুর তাসবীহ পাঠ না করে অতিরিক্ত তাকবীর হাত উঠানো ব্যতীত আদায় করে নিবে।
আর যদি তাকবীরগুলো শেষ করার পূর্বেই ইমাম রুকু থেকে উঠে যায়,তাহলে অবশিষ্ট তাকবীর তার জন্য মাফ হয়ে যাবে।
যদি ঈদের নামাযের দ্বিতীয় রাক’আতে গিয়ে শরীক হয়,তাহলে প্রথমে সে কেরাত পড়বে।এরপর অতিরিক্ত তাকবীরগুলো বলে রুকুতে যাবে।
আর যদি দ্বিতীয় রাক’আতের রুকুতে গিয়ে শরীক হয়,তাহলে প্রথম রাক’আতের রুকুতে মাসবুক হলে যেভাবে নামায আদায় করে সে ভাবেই আদায় করবে। অর্থাৎ রুকুতে যাওয়ার পূর্বে তাকবীরগুলো বলবে তারপর রুকুতে যাবে।
আর যদি কেউ ইমামের সাথে দ্বিতীয় রাক’আতের রুকু শেষ হওয়ার পর সালামের আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে শরীক হয়,তাহলে ইমামের সালাম ফিরানোর পর দাড়িয়ে যাবে এবং ইমামের সাথে যেভাবে নামায আদায় হয়, ঠিক সেভাবেই পূর্ণ নামায আদায় করবে। ( আহসানুল ফাতাওয়া ৪/১৪৩, দুররে মুখতার ১/৫৮৪,৬১৬)
ঈদের দিনে নফল নামায
হযরত ইবনে আব্বাস ( রা:) থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ (সা:) ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত নামায ব্যতীত তার আগে বা পরে অন্য কোন নফল নামায নেই ।(বুখারী – মুসলিম ,মাআরিফুল হাদিস : ৩/৪১)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুই রাকাত [ঈদের নামায] নামায পড়লেন, যার আগে বা পরে কোন [নফল] নামায পড়েননি। [সহীহ বুখারী-১/১৩৫, হাদীস নং-৫৮৮৩]
তাই ঈদগাহে হোক বা অন্য কোন স্থানে হোক হানাফি মাযহাব মতে ঈদের নামাযের পূর্বে নফল নামায পড়া মাকরূহ। ঈদের নামাযের পর ঈদগাহে পড়া মাকরূহ তবে ঘরে পড়া মাকরূহ নয়।( দারুল উলুম ৫/২২৭)
মহিলাদের জন্য ঈদগাহে অংশগ্রহণ
বর্তমান সময়ে ফিতনার আশঙ্কা প্রবল হওয়ার কারণে ফুকাহায়ে কেরাম নারীদের ঈদগাহে ও মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে নিষেধ করেন। তাই তাদের জন্য ঈদগাহে বা মসজিদে গিয়ে জামাতে নামায পড়া মাকরূহ। তবে নামায পড়লে তা আদায় হয়ে যাবে।তাছাড়া নারীদের আসল স্থান হল তাদের বসবাসের ঘর। নারীদের মসজিদে এসে নামায পড়া রাসূল সা. পছন্দ করতেন না।তবে যেহেতু রাসূল(সাঃ)সবার নবী।
আর রাসূল সা. এর কাছে ওহী নাজিল হতো। তাই নারীরা রাসূল সা. এর জমানায় ওহীর বানী শুনার জন্য মসজিদে আসতো। এটি ছিল শুধুই প্রয়োজনের তাগিদে। যে প্রয়োজন রাসূল (সাঃ) ইন্তেকালের দ্বারা বন্ধ হয়ে গেছে। (সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১৬৮৯,ইলাউস সুনান-৩/২৬,কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/৮৮)
ঈদের জামাতে নামায শুরু হয়ে গেছে এমতাবস্থায় যদি প্রবল ধারণা হয় যে,ওযু করতে গেলে নামায ছুটে যাবে তাহলে সে তায়াম্মুম করে নামাযে শরীক হতে পারবে । ( মাসাইলে ঈদ : ৯২)
ঈদের নামাযের আগে বা পরে খাদ্যগ্রহণ
হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরে কিছু না খেয়ে নামাযের জন্য বের হতেন না, আর কুরবানীর ঈদে নামাযের আগে কিছু খেতেন না। (জামে তিরমিযী ১/৭১, হাদীস ৫৪২;)
শাবী রাহ. বলেন, সুন্নত হল, ঈদুল ফিতরের দিন নামাযে যাওয়ার আগে খাওয়া আর ঈদুল আযহার দিন নামায পর্যন্ত খাবারকে বিলম্বিত করা। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৫৬৩৭)
হযরত বুরাইদা রা. বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে বাড়ি থেকে বের হতেন না। আর ঈদুল আজহার নামায আদায় করা পর্যন্ত কিছু খেতেন না।( তিরমিযী- মিশকাত শরীফ ১/১৩৫৬ )
তাই ঈদুল আজহার দিন ঈদাগাহে গমনের পূর্বে তথা নামায আদায় করা পর্যন্ত কিছু না খাওয়া মুস্তাহাব। কোনো কোনো ফকীহের মতে, যে কুরবানী করবে না তার জন্যও ঈদের নামাযের আগে খানা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব।( মাসাইলে ঈদ : ৭৮)
আল্লাহ পাক যেন আমাদের সবাইকে ঈদুল আজহার ফজলিত ও সঠিকভাবে ঈদের হুকুম আহকাম পালন করার তাওফিক দান করেন। আমীন।
লেখক: শিক্ষাসচিব, জামিআ' ফারুকিয়্যাহ সিলেট।
-এটি