।।মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন।।
ইউটিউবে ইসলামী ভিডিও: কত কিছুই ভিত্তিহীন ইউটিউবে কত প্রকারের ভিডিও আপলোড করা হয় তার গণনা সাধ্যের বার। নাচ-গান, নাটক-সিনেমা, রং-তামাশা ইত্যাদি পাপের রকমারি ভিডিও যেমন আছে, তেমনি আছে ওয়াজ-নসীহত, দ্বীনী আলোচনা প্রভৃতি সুশিক্ষামূলক নেকির বহু রকমের ভিডিও।
তাছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিষ্কার, রান্না-রান্না, চিকিৎসা, কারিগরী শিল্প প্রভৃতি আরও কত রকমের ভিডিও। এসব ভিডিওর মধ্যে সব ভিডিওই যে বস্তুনিষ্ঠ তা কিন্তু নয়, বরং প্রচুর ভিডিও এমন আছে যা ভিত্তিহীন, কৃত্রিম।
যেগুলো এডোবি প্রিমিয়ার প্রো, এডোবি আফটার অ্যাফেক্ট প্রভৃতি সফটওয়ারের সাহায্যে অন্য কোন ভিডিও এডিট করে বা সম্পূর্ণ নতুন করে কৃত্রিমভাবে বানানো হয়। বিশেষত চিকিৎসামূলক ভিডিওগুলোতে যেসব হেলথ টিপস দেখানো হয় তার বহু কিছুই আছে ভুয়া কিংবা যা মেডিকেল সাইন্সে স্বীকৃত নয়।
আবিষ্কারমূলক ভিডিওর মধ্যেও প্রচুর এমন আছে যা ঘরে বসে উপরোক্ত সফটওয়ারগুলোর সাহায্যে বানানো কৃত্রিম ও ভুয়া, আদৌ সেগুলো বিজ্ঞানের আবিষ্কার নয়। সেগুলোর বিবরণ প্রদান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এ প্রবন্ধে আমার উদ্দেশ্য শুধু এটা বর্ণনা করা যে, ইসলাম ও ধর্মের আদলে যেসব ভিডিও ছাড়া হয় তার মধ্যেও প্রচুর ভিত্তিহীন ও কৃত্রিম ভিডিও রয়েছে।
তাই ইউটিউবে (তদ্রূপ অনলাইনের অন্য কোন সোশ্যাল মিডিয়ায়) প্রদর্শিত ভিডিওতে কিছু দেখলেই তা বিশ্বাস করে নিতে হবে এবং ধর্মীয় আবেগে সেটা অন্যকে শেয়ার করা আরম্ভ করে দিতে হবে এমন নয়।
তাতে ভুয়া জিনিসে বিশ্বাস স্থাপনের বোকামি হবে, ভুয়া জিনিস প্রচারের দায় বর্তাবে। ইসলাম ও ধর্মের আদলে যেসব ভিডিও ছাড়া হয় তার মধ্যে যে ভিত্তিহীন ও কৃত্রিম ভিডিও রয়েছে তার উদাহরণ প্রচুর। কয়েকটা উদাহরণ পেশ করছি।
(১) বায়তুল্লাহ শরীফে ফেরেশতা অবতরণের ভিডিও। রওযায়ে আতহারে ফেরেশতাদের সালাম করার ভিডিও ইত্যাদি। উল্লেখ্য, এসব ভিডিওতে দৃশ্য কারা কারা দেখেছে, প্রত্যক্ষদর্শী কারা তার কোন ডকুমেন্টারি বর্ণনা থাকে না, কিংবা নির্ভরযোগ্য কোন সূত্রের উল্লেখ থাকে না।
এ ধরনের ভিডিও যে ভুয়া তা স্পষ্ট এ কারণে যে, এ রকম ঘটনা যদি বাস্তবেই ঘটত এবং মানুষ তা দেখে ভিডিও করবে এমন প্রকাশ্যে ঘটত, তাহলে তা সারা বিশ্ব মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার হত, বহু সূত্রে তা বর্ণিত হতো।
(২) কবর থেকে বিভিন্ন মানুষের জীবিত হয়ে উঠে আসা এবং কথা বলার ভিডিও, দুধের শিশুর কথা বলার ভিডিও ইত্যাদি। এসব ভিডিও যে ভুয়া তার প্রমাণ ঐই যা পূর্বের এক নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে।
(৩) কেউ কেউ এক ধরনের ভিডিও দিয়ে কা’বা শরীফকে পৃথিবীর কেন্দ্র প্রমাণ করতে চান। নেটে এ জাতীয় প্রচুর ভিডিও দেখা যায়। এসব ভিডিওতে বিশেষ সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে যা দেখানো হয় তাকে মোটামুটি এভাবে বর্ণনা করা যায় যেন পৃথিবীর গ্লোবকে ক্যামেরার সামনে রাখা হয়।
গ্লোবের যেখানে বাইতুল্লাহ সেই বরাবর স্থানকে ক্যামেরার কেন্দ্র বরাবর রেখে ক্রমান্বয়ে গ্লোবকে বড় করা হয়। আর এক পর্যায়ে গিয়ে বাইতুল্লাহই চোখের সামনে বড় হয়ে শেষ হয়, আর মনে হয় এ-ই তো বাইতুল্লাহই পৃথিবীর মধ্যখান। এই ভিডিও-র জবাব হচ্ছে একটু চিন্তা করলেই যে কেউ বুঝবেন এই ভিডিও একটা ছেলেখেলা!
এভাবে সলিমুদ্দীন কলিমুদ্দীনের গৃহ কিংবা কোন ফকির সন্নাসীর আশ্রমকেও পৃথিবীর কেন্দ্র দেখানো সম্ভব। এখানে আরও একটা কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে। তা হল এই ভিডিও প্রদর্শনের সময় বলা হয়, দেখুন বিজ্ঞান বলছে, কা’বা শরীফ পৃথিবীর কেন্দ্র। কিন্তু এখানে বিজ্ঞানের কী রয়েছে তা তো বোধগম্য নয়।
বিজ্ঞান শব্দ ব্যবহার করলেই কি তা বিজ্ঞানসম্মত হয়ে যায়? কোন্ বৈজ্ঞানিক কী বলেছে তা তো তারা মোটেও উল্লেখ করেন না। আবার এই ভিডিও প্রদর্শনের সময় কখনও কখনও গোল্ডেন রেশিওর কথাও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু গোল্ডেন রেশিও আর কেন্দ্র কি এক জিনিস? কী দেখানো হয় আর কী দাবি করা হয়- এ তো সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলানো।
উল্লেখ্য, গোল্ডেন রেশিও এবং গোল্ডেন রেশিওর ভিত্তিকে কা’বা শরীফকে প্রথিবীর কেন্দ্র দেখানোর যে প্রচেষ্টা সে সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার জন্য নেটে আমার লেখা ‘গোল্ডেন রেশিও এবং কা’বা শরীফ পৃথিবীর নাভি কি না এ প্রসঙ্গ’ দেখে নেয়া যেতে পারে।
(৪) বর্তমানে নেটে জূদী পর্বতের পাশে মাটিতে দেবে থাকা একটি বড় আকারের নৌকার ছবি প্রদর্শন করে বলা হয় এটি নূহ (আ.)-এর নৌকা এবং বৈজ্ঞানিকদের আবিষ্কার বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কেউই পূর্ণাঙ্গ নৌকার এমন চিত্র বা অবস্থা আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভূগোলবিদ, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, কেউ কেউ স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও দেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেউই স্পষ্টত এমন নৌকা দেখেছেন তা বলেননি। কেউ কেউ মাটির তলে নৌকার ভগ্নাবশেষ বা ভাংগা ভাংগা কিছু কাঠের টুকরো থাকার বা পাওয়ার দাবি করলেও এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্বক সম্ভাব্য নূহ (আ.)-এর যুগের হওয়ার দাবি করলেও অন্য অনেকে তা অস্বীকার করেছেন।
বস্তুত নেটে প্রদর্শিত নূহ (আ.)-এর নৌকার পূর্ণাঙ্গ ছবি কাল্পনিক এবং কৃত্রিমভাবে বানানো ছবি। এ রকম আরও বহু ভিত্তিহীন ভিডিও নেটের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যায়। বস্তুত এগুলো মানুষের সস্তা ধর্মীয় আবেগ কুড়ানোর চেষ্টা বৈ আর কিছু বলা যায় না।
আর ধর্মীয় এই সস্তা আবেগ থেকেই এ জাতীয় কথা ও ভিডিও-র বক্তব্যের যথার্থতা যাচাই-বাছাই ছাড়াই একজন থেকে আরেকজন অবলীলায় প্রচার করে যাচ্ছে। আর সহজ সরল বহু মানুষ তা দ্বারা আপ্লুত হচ্ছে। এভাবে আপ্লুত ও ভক্ত হওয়ার পর ভবিষ্যতে যদি কোনদিন সত্যিকারভাবেই শক্ত বিজ্ঞানের ভিত্তিতে এর ব্যতিক্রম প্রমাণিত হয় তাহলে তখন কী হবে? তখন কি একথা প্রমাণিত হবে না যে, মুসলমানরা ভুয়া আবেগে পরিচালিত হয়।
ইসলামের শত্রুরা এমনতর উদ্দেশ্যেও অনেক কিছু প্রচার করে থাকে। তাছাড়া ভুয়া ভিডিও প্রচার ও তাতে বিশ্বাসের প্রবণতাকে অমুসলিমরা হাস্যকর অন্ধবিশ্বাস হিসেবে দেখিয়ে অমুসলানদেরকে মুসলমানদের বিরোধী করে তোলে। মুসলমানদের এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সব ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া উচিত। যাচাই-বাছাই ছাড়া অবলীলায় এগুলো বিশ্বাস না করা উচিত। অন্যকে শেয়ার না করা উচিত। [লেখকের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া]
-কেএল