।।মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন।।
ফেসবুক ইউটিউব প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে ‘লাইক’ ও ‘শেয়ার’ শব্দদু’টো এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক পোস্টেই মানুষ লাইক দেয়, অনেক পোস্ট অন্যকে শেয়ার করে। লাইক দেয় অর্থাৎ সেটাকে পছন্দ করার কথা ঘোষণা দেয়, সেটার অনুকূলে মত প্রদান করে। লাইক (Like) শব্দের অর্থ পছন্দ করা, কোন কিছুর অনুকূলে মত প্রদান করা।
আর কোন পোস্টকে শেয়ার করা অর্থ সেটাকে বিভক্ত করে দেয়া। অর্থাৎ নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যের মধ্যে বিভক্ত তথা বিস্তৃত করে দেয়া। শেয়ার (Shear) শব্দের মূল অর্থই হচ্ছে বিভক্ত করা।
লাইক (পছন্দ) পরিভাষাটি আরবী মহব্বত (ভালবাসা)-এর কাছাকাছি। (কাছাকাছি বললাম এ কারণে যে, পছন্দ ও ভালবাসা শব্দ দু’টো কখনও কখনও সমার্থবোধক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও কখনও কখনও ভিন্ন অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন লাইক বা পছন্দ শব্দটি নির্বাচন ও মনোনয়ন অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে, ভালোবাসা শব্দটি সে অর্থে ব্যবহৃত হয় না।
আবার ভালবাসার মধ্যে আসক্তি ও অনুরক্ততার যে গভীর মাত্রা থাকে সাদামাটা পছন্দের মধ্যে সে মাত্রা থাকে না।) আর কোন কিছু শেয়ার করা শুধু ইনফরমেশন তথা অবগতির জন্যও হতে পারে আবার তাতে দাওয়াত ও তাবলীগের মনোভাবও থাকতে পারে। দ্বিতীয় অবস্থায় শেয়ার পরিভাষাটি হসলামী পরিভাষার দাওয়াত ও তাবলীগ-এর সমার্থবোধক।
ফেসবুক ইউটিউবে লাইক শেয়ার এখন ডাল ভাত। মানে সস্তা ও সহজপ্রাপ্য। বলা যায় অনেকটা বেদামী জিনিস। যখন কোন জিনিসের ভাল-মন্দ, ইতিবাচক নেতিবাচক দিকগুলো যথাযথ বিচার না করেই তাতে অন্য অনেকের দেখাদেখি হুজুগে লাইক দেয়া হয়, শেয়ার করা হয়, তখন সে লাইক শেয়ারের দাম থাকবে কী করে? আর কোন জিনিসের ভাল-মন্দ, ইতিবাচক নেতিবাচক সব দিকগুলো যথাযথ বিচার করার ক্ষমতা ও যোগ্যতাই বা থাকে কয়জনের। লাইক শেয়ার তো হয় হুজুগে, লাইক শেয়ার তো হয় সস্তা আবেগের বশে।
লাইক শেয়ার তো হয় অনুরোধ রক্ষার্থে, কারণ অনেকেই একটা কিছু পোস্ট করেই ‘দয়া করে একটা লাইক দিন, শেয়ার করুন’- এভাবে লাইক শেয়ার খয়রাত চায়, তারপর অর্জিত খয়রাতের (মানে লাইক শেয়ারের) পরিমাণ বা সংখ্যা আবার অন্য কিছু অর্জন করার জন্য এপ্লাই করা হয়।
আদৌ কে বা কারা লাইক দিল, শেয়ার করল তার বিচার করা হয় কি? যারা লাইক শেয়ার অর্জন করে, কীভাবে অর্জন করে- তা কি কেউ বিচার করে দেখে? তাহলে লাইক শেয়ারের দাম থাকবে কী করে? এরকম লাইক শেয়ার দিয়ে কোন কিছুর মূল্যায়ন করা হলে সেই মূল্যায়নের কী মূল্য থাকতে পারে? অথচ অনেকেই এমন লাইক শেয়ার নিয়ে গর্ব বোধ করেন যে, তার অমুক বিষয়ে এত সংখ্যক লাইক পড়েছে, এতটা শেয়ার হয়েছে! এভাবে লাইক শেয়ারের ভিত্তিতে নিজেকে বাস্তবে যতটুকু তার চেয়ে বেশি কিছু ভেবে বসেন, স্ফীত হয়ে ওঠেন। অন্যরাও কোন কিছুতে লাইক শেয়ারের পরিমাণ বেশি দেখে সেটাকে আহামরি কিছু ভাবতে শুরু করে। এটা ভেবে দেখে না যে, এই আহামরির ভিত কতটা শক্তিশালী।
এতো গেল ফেসবুক ইউটিউবের লাইক শেয়ারের মূল্য কতটুকু সে বিষয়। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কোন কিছু লাইক শেয়ারের ক্ষেত্রে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ কি তা বিবেচনায় রাখা। ফেসবুক ইউটিউবে যারা বিভিন্ন কিছুতে লাইক দেন, বিভিন্ন কিছু শেয়ার করেন তাদের অনেকের ভাবগতি দেখে মনে হয় এ বিষয়টিকে তারা মোটেই বিবেচনায় রাখেন না। তাই অবলিলায় এমন সবকিছুতে লাইক দিয়ে যান, অবলিলায় এমন সবকিছু শেয়ার করেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেগুলোর অনেকটা লাইক শেয়ারের যোগ্য নয়।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লাইক শেয়ারের বিষয়টা অনেক শক্ত। কেননা কোন ব্যক্তিকে লাইক দেয়া অর্থ তাকে পছন্দ করার ঘোষণা দেয়া, তাকে ভালবাসার ঘোষণা দেয়া। তার দোসর হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া। আর হাদীছে এসেছে- المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ” অর্থাৎ, যার সঙ্গে যার ভালবাসা পরকালে সে তার সঙ্গে থাকবে। (বোখারী: ৬১৬৯ ও মুসলিম: ২৬৪০) অতএব কোন ব্যক্তিকে লাইক দেয়ার আগে ভেবে নিতে হবে সার্বিক বিবেচনায় তিনি এমন ব্যক্তি কি না যার সঙ্গে পরকালে থাকা কাম্য হতে পারে।
এটা ভেবে দেখতে হবে তাকে ভালবাসার কারণে তার সঙ্গে জাহান্নামে যাওয়া না লাগে। সূরা সাফফাতের ২২-২৩ আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে, (কেয়ামতের দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ হবে-) একত্র কর অনাচারীদেরকে, তাদের দোসরদেরকে এবং সেই উপাস্যদেরকেও তারা যাদের পূজা করত আল্লাহ্কে ছেড়ে। অতঃপর তাদেরকে দোযখের পথ প্রদর্শন কর। (আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করেন।)
এখানে কেউ বলতে পারেন, লাইক অর্থ পছন্দ করা বা অনুকূলে মত প্রদান করা আর হাদীছে কাউকে মহব্বত করলে তথা ভালবাসলে তার সঙ্গে পরকালে থাকার কথা বলা হয়েছে, কাউকে পছন্দ করলে বা কারও অনুকূলে মত প্রদান করলে নয়। ভালবাসা আর পছন্দ করা বা অনুকূলে মত প্রদান করা- পুরোপুরি এক কথা নয়, যা পূর্বেও বলা হয়েছে। এর জওয়াব হল-মহব্বত তথা ভালবাসার যে হুকুম, পছন্দ করা বা কারও অনুকূলে যাওয়ারও সেই হুকুম।
পূর্বে সূরা সাফফাতের যে বর্ণনা পেশ করা হয়েছে যে, “একত্র করো অনাচারীদেরকে ও তাদের দোসরদেরকে … অতঃপর তাদেরকে দোযখের পথ প্রদর্শন কর।”- এখানে লক্ষ্য করুন কাউকে ভালবাসলে যে পরিণাম অর্থাৎ উভয়ের পরকালে একসঙ্গে থাকা, কারও দোসর হলেও সেই পরিণাম-এর কথাই বলা হয়েছে। বুঝা গেল মহব্বত ভালোবাসার যে হুকুম অন্য যেকোনো ভাবে দোসর বা জোড়া হয়ে গেলেও একই হুকুম। আর লাইক করা দ্বারাও কারও সঙ্গে জুড়ে যাওয়াই হয়, তার জোড়া বা দোসর হয়ে যাওয়াই হয়।
তবে এখানে দুটো বিষয়ে একটু বিবরণের প্রয়োজন রয়েছে। (এক) কারও দোসর হলে যে পরকালীন পরিণামের কথা বলা হয়েছে তা কি দ্বীনী বিষয়ে দোসর হলে প্রযোজ্য নাকি পার্থিব বিষয়ে দোসর হলেও প্রযোজ্য? এর জওয়াব হল- দ্বীনী বিষয়ে দোসর হলে প্রযোজ্য, পার্থিব বিষয়ে নয়। কেননা পার্থিব বিষয়ে কাফের বে-দ্বীনের সাথেও এক যোগে কাজ করা যায়। (যদি সে কাজটি অবৈধ না হয়।)
যেমন কোন মুসলমান কোন কাফের মুশরিকের সঙ্গে একসাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে। অতএব কোন পার্থিব বিষয়ে -যে বিষয়ের সাথে দ্বীন ঈমানের কোন টাচ নেই- কাউকে লাইক দিলে তার ক্ষেত্রে কারও দোসর হলে যে পরকালীন পরিণামের কথা বলা হয়েছে তা প্রযোজ্য হবে না।
যেমন: কেউ কোন হাস্যরস মূলক কিছু দেখে তাতে লাইক দিল। কিংবা কারও জাগতিক কোন ভাল আবিষ্কার দেখে তাতে লাইক দিল, কারও উপকারী কোন প্রডাক্ট দেখে তাতে লাইক দিল। বরং উপকারী জিনিস দেখে লাইক দেয়া যদি অন্যের উপকারের নিয়তে হয় তাহলে তা শুধু বৈধই নয় বরং প্রসিদ্ধ হাদীছ إنما الأعمال بالنيات (আমলের ধর্তব্য হয়ে থাকে নিয়তের ভিত্তিতে।)-এর ভিত্তিতে ছওয়াবের হয়ে যাবে। এর বিপরীত গোনাহের চেতনায়, খাহেশাত চর্চায় কোন কিছু লাইক দিলে তা গোনাহের হবে।
(দুই) দ্বীনী বিষয়ে কারও দোসর হলে যে পরকালীন পরিণামের কথা বলা হয়েছে তা কি দ্বীনের সমগ্র বিষয়ে দোসর হলে প্রযোজ্য নাকি বিষয় বিশেষে দোসর হলেও প্রযোজ্য? এর জওয়াব হল- সমগ্র বিষয়ে দোসর হলে যে প্রযোজ্য হবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। রয়ে গেল বিশেষ কোন বিষয়ে দোসর হলে প্রযোজ্য হবে কি না। তো পূর্বে বর্ণিত হাদীছ ও আয়াতে যে ভালবাসা ও দোসর হওয়ার কথা বলা হয়েছে তা মুতলাক (مطلق) তথা শর্ত বন্ধন মুক্ত। অর্থাৎ তাতে সমগ্র ক্ষেত্রে না বিশেষ কোন ক্ষেত্রে- কোন শর্ত বন্ধনের উল্লেখ নেই।
তাই المطلق يجري على إطلاقه (অর্থাৎ শর্ত বন্ধন মুক্ত ভাষ্য শর্ত বন্ধন হীন মুক্ত অর্থেই প্রযোজ্য হয়।) উসূল অনুযায়ী এখানে উভয় সম্ভাবনাই বিদ্যমান। সেমতে এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, সমগ্র ক্ষেত্রে হলে প্রযোজ্য, আবার এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, বিশেষ কোন ক্ষেত্রে হলেও প্রযোজ্য। তাই সতর্কতাই জরুরি। অতএব দ্বীনী কোন বিষয়ে গলতিতে রয়েছে- এমন কাউকে সে বিষয়ে লাইক না দেয়া। হোক না সেটা বিষয় বিশেষ।
এ গেল লাইক বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ। আর শেয়ার যদি দাওয়াত ও তাবলীগ অর্থে হয়, তাহলে শরীয়তের বিচারে ভাল- এমন কোন বিষয় শেয়ার করলে ভাল বিষয়ের দিকে দাওয়াত দেয়ার মত ছওয়াবের হবে। পক্ষান্তরে শরীয়তের বিচারে মন্দ- এমন কোন বিষয় শেয়ার করলে মন্দ বিষয়ের দিকে দাওয়াত দেয়ার মত গোনাহের হবে। অতএব শরীয়তের এই দৃষ্টিকোণ সামনে রেখেই কোন বিষয় শেয়ার করা না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া চাই।
আল্লাহ আমাদের সকলকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ সামনে রেখে সবকিছু করার তাওফীক দান করুন। আমীন! [লেখকের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া।]
-কেএল