হারুন আনসারী তালুকদার
লেখক ও সম্পাদক
মফস্বল শহরের সাংবাদিকতা কতো ঝুুঁকিপূর্ণ তা বোধহয় সবাই অনুধাবন করতে পারেন না। এখানে কাজ করতে হয় বুঝেশুনে। কথায় কথায় হামলা-মামলা, নির্যাতন নেমে আসে এদের উপর। যারা একটু খোঁজখবর রাখেন তারা ভাল বুঝবেন।
উস্কে দিতে পারেন অনেকে। কিন্তু শুধুমাত্র সংবাদ প্রকাশের কারণে যেই সাংবাদিক খুন হলেন বা চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করলেন কিংবা জেল-জুলুমের শিকার হলেন তারাই বুঝেন এর জ্বালা। পরে আর তার খবর রাখেন না কেউ। বলতে পারেন, তাই বলে কি লিখবেন না? কিংবা যদি ভয়ই পান তাহলে কেনো এই পথে এলেন?
আসলে কৈশোরের রঙিন স্বপ্নের মতোই সাংবাদিকতার শুরুটা। নতুন বিয়ের পরে যেমন সারাটি সময়ই হানিমুনের মতো লাগে নববধুকে পাশে পেয়ে, তেমনি প্রথম কোন পত্রিকায় সংবাদ ছাপার পরে একজন সংবাদকর্মীর অনুভূতিও তেমনই।
তার চারপাশে তখন পরিবর্তনের হাতছানি। এই সময়টি খুবই স্পর্শকাতর। একেবারেই প্রসূতি মায়ের মতো। যেনো একটু অসতর্ক হলেই গর্ভের সন্তানটি মারা যাবে কিংবা প্রসূতি মা’ও।
হ্যাঁ, সত্যিই বলছি, বিষয়টি এমনই। যেখানে সমাজের আনাচে-কানাচে অসঙ্গতি, কাইজা-ফ্যাসাদ, হাঙ্গামা, সরকারী দপ্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং এর সাথে যারা জড়িত তাদের পক্ষে রয়েছে ফরমায়েশী কলম; তখন স্রোতের বিপরীতে কলম চালানোটা আত্মঘাতিই বটে।
তাই, একজন নবীন সংবাদকর্মীকে প্রথমেই যে শিক্ষাটা দেয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক কর্মশালায়, সেটি হলো নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়টি। আপনার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোন খবর রয়েছে এবং সেটি প্রকাশ পেলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হবে। এই খবরটি আপনি প্রকাশ করতে চাইছেন। সচেতন সম্পাদক প্রথমেই আপনার কাছে জানতে চাইবে, এই খবর প্রকাশ পেলে আপনার কোন সমস্যা হবে কি না?
যদি তেমন কোন সমস্যা থাকে তাহলে হয়তো সম্পাদক সাহেব পত্রিকা অফিসের সিনিয়র রিপোর্টার দিয়ে সেই রিপোর্ট করান। তাও যেটুকু প্রকাশ করার মতো। আর বর্তমানের ডিজিটাল আইনেতো সাংবাদিকের হাতপা আরো বাঁধা। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তাকে বিনা ওয়ারেন্টেই গ্রেফতার করার অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এজন্য সাম্প্রতিককালে বিভিন্নস্থানে সাংবাদিক নির্যাতন ও গ্রেফতারের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
হয়তো বলবেন, এর ভিতরও দেখি অনেকে খবর করেন। হ্যাঁ, করেন। যখন কোন ইস্যুতে মূলধারার সাংবাদিকেরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন তখন কোন রক্তচক্ষুই বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে না। তবে এই ঐক্য সাময়িক হয়ে থাকে বলে অশুভ শক্তি পার পেয়ে যায়। এজন্য দলমতের উর্দ্ধে প্রকৃত সাংবাদিকদের ঐক্য জরুরি।
এটি একেবারেই সত্যি যে, সুন্দর সমাজ গড়তে চাই সাহসী নেতৃত্ব। এজন্য প্রয়োজন সাহসী গণমাধ্যমকর্মী। সত্য প্রকাশে সাংবাদিকদের পাশাপাশি পাঠকেরও কিছু দ্বায়িত্ব রয়েছে। একটি সংবাদ পাঠের সাথে একজন সচেতন পাঠককে এটিও জানতে হয় যে, এই সংবাদটি কি কারণে প্রকাশ পেলো? এটি কি কোন বিশেষ এজেন্ডা? নাকি সত্যের সন্ধানে কোন সাহসী উচ্চারণ।
আমাদের দেশে এই প্রবণতা নেই বললেই চলে। এখানে ডাহা মিথ্যাকেও গোয়েবলসীয় কায়দায় সত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায়। একারণে যতো দিন যাচ্ছে, মিথ্যার বেসাতি ততোই সংঘবদ্ধভাবে ছড়াচ্ছে। সত্য রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আবডালে। তাকে খুঁজে বের করতে হয়।
তবে এখন নেই বলে যে, কোন সময়েই আর সত্য প্রকাশের পরিবেশ সৃষ্টি হবে না আমি তেমনটি মনে করি না। তবে সাংবাদিকতায় বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকতায় পেশাদার ও প্রশিক্ষিত লোকদের সংখ্যা যতো বাড়বে ততোই সত্য প্রকাশ ত্বরান্বিত হবে। সেই সুন্দর দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
দ্রষ্টব্য: লেখাটির মূল উদ্দেশ্য আসলে পাঠককে তার দ্বায়িত্ব সম্মন্ধে সচেতন করা। যেনো তিনি যেনতেন তথ্যকে আমলে নিয়ে তথ্যের গুরুত্ব হ্রাস করতে ভূমিকা পালন না করেন। কারণ, কোকিলের এই সম্মেলনে এখন কাকের সংখ্যাই বেশি।
লেখক: সম্পাদক, ফরিদপুর টাইমস ও নয়াদিগন্তের ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি
এমডব্লিউ/