।।মুহাম্মদ আল আমিন।।
রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। পবিত্র রমজানের এক মহিমান্বিত রজনীতে লৌহে মাহফুজ থেকে পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ হয় মহাগ্রন্থ আল কোরআন। মহান আল্লাহ আল কোরআনে ইরশাদ করেছেন, রমজান মাস এমন, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে, মানবকুলের জন্য পথপ্রদর্শকরূপে এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনা ও সত্যাসত্যের পার্থক্য নির্ণয়কারী হিসেবে। (সুরা বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫) তাই এ মাসে অপরাপর আমলের তুলনায় কোরআন তিলাওয়াতের রয়েছে সবিশেষ মাহাত্ম্য। রমজানের প্রতি রাতে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি বিশেষভাবে ব্রতি হতেন। বুখারি শরিফে রয়েছে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রমজান এলে প্রতি রাতে নবিজী (সা.) নিকট জীবরাইল (আ.) আগমণ করতেন এবং একে অপরকে কোরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। (বুখারি: ৩৫৫৪)
সহিহ বুখারির বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার ইবনে বাত্তাল (রহ.) বর্ণনা করেন, আব্দুল ওয়াহিদ (রহ.) বলেছেন, কোরআন তিলাওয়াতের জন্য রমজানের প্রতি রাতে জীবরাইল আ. এর আগমণ রমজানে কোরআন তিলাওয়াতের বিশেষ ফজিলতের ব্যাপারে শক্তিশালী দলিল। রমজানে মানুষের ব্যাপকভাবে কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি মনোনিবেশ করা মূলত এখান থেকেই নেওয়া। যেহেতু নবিজী (সা.) করেছেন, তাই তার অনুসরণে উম্মতগণও করে থাকেন। (শরহু ইবনু বাত্তাল: ২৩/৪)
ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনের তিলাওয়াতের মাধ্যমে মুমিনের ঈমান বৃদ্ধি পায়। মহামহিম আল্লাহর সাথে বান্দার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মহান আল্লাহ আল কোরআনে বলেন, নিশ্চয়ই মুমিন হলো তারা আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর বিগলিত হয় এবং তাদের সামনে যখন তাঁর আয়াতসমূহ (কোরআন) তিলাওয়াত করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে। (সুরা আনফাল, আয়াত: ২)
আল কোরআনের প্রতিটি অক্ষর তিলাওয়াতের বিনিময়ে আল্লাহ দশটি করে নেকি দান করেন। হজরত উসমান (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পড়বে, সে একটি নেকি পাবে, আর প্রতিটি নেকি দশ গুণ করে বৃদ্ধি করে দেওয়া হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৯১০)
আর পবিত্র রমজানে রোজাদারের সম্মানে সে সাওয়াবকে আল্লাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ মাসে একটি কল্যাণময় কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করবে, সে অন্য সময়ের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে এবং যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ ইবাদত আদায় করবে সে অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আমলের সওয়াব পাবে। (সহিহ ইবনে খুযাইমা: ১৮৮৭)
তাই ইসলামি ইতিহাসের যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীগণ রমজান এলে হাদিসের পাঠদান, ফিকহ-ফতোয়ার চর্চা, অধ্যায়ন-গবেষণা এমনকি অপরাপর নফল ইবাদত থেকেও নিজেকে মুক্ত করে কোরআন তিলাওয়াতে মনোনিবেশ করতেন।
বিশিষ্ট তাবিয়ী ইবনে শিহাব যুহরি (রহ.) রমজান এলে বলতেন, এটা হলো কোরআন তিলাওয়াত ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করার মাস। (লাতায়িফুল মাআরিফ: ১৭১)
ইমাম ইবনে আব্দুল হাকাম (রহ.) বর্ণনা করেছেন, রমজান এলে মালেকি মাযহাবের পুরোধা ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রহ.) হাদিস অধ্যায়ন-পাঠদান ও জ্ঞানচর্চার মজলিস ছেড়ে কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি মনোনিবেশ করতেন। (লাতায়িফুল মাআরিফ: ১৭১)
হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রের মানিত ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহ.) এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, রমজান এলে তিনি অন্য (নফল) ইবাদত কমিয়ে এনে কোরআন তিলাওয়াতে বিশেষ মনোযোগী হতেন। (লাতায়িফুল মাআরিফ: ১৭১)
আমাদের পূর্বসুরী মনীষীগণ কোরআন নাজিলের এ মাসে এত অত্যাধিক কোরআন তিলাওয়াত করতেন যেÑ কেউ সাত দিনে, কেউ পাঁচ দিনে, কেউ তিন দিনে, এমনকি কেউ দুই দিনে পূর্ণ কোরআন শরিফ খতম করতেন। সুবহানাল্লাহ!
বিশিষ্ট তাবিয়ী আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ (রহ.) অন্য মাসে ছয় দিনে কোরআন খতম করতেন। আর রমজানে মাত্র দু দিনে পূর্ণ কোরআন পড়ে ফেলতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৫১/৪)
হাদিসশাস্ত্রের সম্রাট ইমাম বুখারী (রহ.) রমজানের প্রতিদিন এক খতম এবং প্রতি তিন রাতে নামাজে এক খতম করে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৪৩৯/১২)
উমাইয়া খলিফা, খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালেক (রহ.) রমজানে সতেরো খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩৪৭/৪)
শাফেয়ী মাযহাবের পুরোধা ইমাম শাফিয়ী (রহ.) রমজানে নামাজের বাহিরে ৬০ খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন। ইমামুল আজম ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর ব্যাপারেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। (লাতায়িফুল মাআরিফ: ১৭১)
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (রহ.) বলেন, তিনদিনের কমে কোরআন খতমের ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা এসেছে তা সাধারণ সময়ের জন্য। মর্যাদাপূর্ণ সময়, যেমন রমজান মাস অথবা মর্যাদাপূর্ণ স্থান যেমন মক্কা মুকাররমা, সময় ও স্থানের বিশেষ বরকত লাভের উদ্দেশ্যে এ সময়ে বা স্থানে অধিকহারে কোরআন তিলাওয়াত করতে সমস্যা নেই। এটাই ইমাম আহমদসহ অধিকাংশ ইমামের অভিমত। (লাতায়িফুল মাআরিফ: ১৭১)
আমাদের নিকট অতীতের বরিত মনীষীগণও পবিত্র রমজানে কোরআন তিলাওয়াতের ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করতেন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত ফকিহ হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী (রহ.) বাদ মাগরীব আওয়াবিন নামাজে দু’ পারা এবং তাহাজ্জুদসহ দৈনিক অর্ধ খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন।(আকাবির কা রমজান, পৃ: ২১,২২)
সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ “ফাযায়েলে আমল“-এর রচয়িতা শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া (রহ.) তারাবিতে সোয়া পারা শোনাতেন, সাহরী পর্যন্ত তরজামাসহ তা পড়তেন চার-পাঁচ বার। সে অংশটুকু তাহাজ্জুদের সময় শোনাতেন দু’বার। সেহরি খাওয়ার পর ফজরের নামাজের আগে এবং পরে ঘুমানোর আগে সে অংশটুকু একবার তিলাওয়াত করতেন। সকাল দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠে শীতের মৌসুমে চাশতের নামাজে একবার এবং গরমের মৌসুমে দু’বার তিলাওয়াত করতেন।
জোহরের নামাজের পনের মিনিট আগে দেখে দেখে দু’বার তিলাওয়াত করতেন। জোহরের নামাজের ফরজের আগে সুন্নতে দু’বার, পরের সুন্নতে একবার তিলাওয়াত করতেন। জোহরের নামাজের পর বন্ধুদের কাউকে একবার শোনাতেন। আসরের নামাজের আগে দুইবার বা একবার পড়তেন। আসরের পর বয়স্ক কাউকে একবার শোনাতেন। মাগরীবের নামাজের পর নফল নামাজে সেই সোয়া পারা আরেক বার তিলাওয়াত করতেন। প্রতিদিনের আমল ছিল এভাবে। ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ত্রিশবারে ত্রিশ পারা তিলাওয়াতে জোর দিতেন। (শায়খ যাকারিয়্যা (রহ.) এ আত্মজীবনী হতে সংগৃহীত)
এভাবে কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর এ সকল প্রিয় বান্দাগণ রমজানকে কোরআনময় করে তুলতেন। আল কোরআনের অপার্থিব সৌরভে সুরভিত হয়ে উঠতো মুসলমানদের পরিবার ও সমাজ। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ষিত হত অবারিত রহমাতের ফল্গুধারা।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে রমজানে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াতের তাউফিক দান করুন। আমীন।
-কেএল