মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
সৌদির সেবা কোম্পানির সঙ্গে হজ এজেন্সির চুক্তির নির্দেশনা মহেশখালী থানার বিশেষ অভিযানে পরোয়ানাভুক্ত ১১ জন আসামি গ্রেফতার বৃষ্টির সময় কাবা প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় ওমরা পালনকারীদের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট গ্রাহকদের মূলধন ফেরত পাওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন মাওলানা আতহার আলীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ইতিহাস রচিত হতে পারে না: ধর্ম উপদেষ্টা জরুরি সভা ডাকল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কক্সবাজারে উৎসবমুখর পরিবেশে রোপা আমন ধান কাটা শুরু চাঁদপুর হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় জামিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাহর সাফল্য বগুড়ায় আন্দোলনে নিহত রিপনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত

যাকাতের ফাযায়েল ও কিছু জরুরি মাসায়েল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দীন আহমদ

ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত । কুরআন মাজীদে বহু স্থানে সালাত-যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ।

আদ্দুরুল-মুখতার প্রণেতা বলেন,
الزكوة هو تمليك جزء من مال عينه الشارع لمسلم فقير غير هاشمي ولا مولاه مع قطع المنفعة عن الملك من كل وجه لله سبحانه وتعالى.
যাকাতের সারসংক্ষেপ সংজ্ঞা হল,নিসাব পরিমাণ মালের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এর একটি নির্দিষ্ট অংশ কোন ফকির কিংবা তার অনুরূপ ব্যক্তির মালিকানায় দিয়ে দেওয়াকে যাকাত বলা হয় ।
যাকাতের হুকুম :
যাকাত একটি ফরয বিধান। কুরআন-হাদীস ইজমায়ে উম্মতের দ্বারা যাকাতের ফরজিয়ত প্রমাণিত। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

واقيموا الصلوة واتو الزكوة الخ:(سورة البقرة ٤٣)

অর্থ: তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর । ( সুরা বাকারা ৪৩)

হাদীস শরীফে এসেছ,মহানবী(সা.)বলেন,
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত।
আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল- এতে সাক্ষ্য দেয়া,
নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দেয়া, শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকলে হজ্জ্ব করা এবং রমযান মাসে রোযা রাখা।’’ (বুখারী ও মুসলিম)
ইজমায়ে উম্মত দ্বারা যাকাতের ফরজিয়ত প্রমাণিত এভাবে যে,যাকাত ফরজ হওয়ার উপর সমগ্র উম্মত একমত । তা অস্বীকারকারী কেউ নেই । (বাদায়ে উস সানায়ে ২/৩৭৩)

যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত: মুসলিম,যাকাত সম্পর্কে জ্ঞান,প্রাপ্তবয়স্ক,বিবেকবান, স্বাধীন গুণসম্পন্ন নারী পুরুষের উপর নিম্নে বর্ণিত শর্ত সমুহের ভিত্তিতে যাকাত দেয়া ফরজ । (বাদায়ে উস সানায়ে ২/৩৭৭)
শর্ত সমুহ হল ; (১) নিছাব পরিমাণ সম্পদ থাকা (২) সম্পদের উপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকা । সুতারাং যে সম্পদ মালিকের অধিকার নেই,উপস্থিত সময় এ মালে যাকাত কাম্য নয় (৩) নিছাব মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। (ব্যবহারের মালামাল,নিত্য ব্যবহার্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে যাকাত নেই) (৪) নিছাব করজ মুক্ত হওয়া । অর্থাৎ করজ পরিশোধ করার পর বা করজ পরিমাণ সম্পদ বাদ দেওয়ার পর নিছাব পরিমাণ মাল থাকলে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। (৫) সম্পদ বর্ধনশীল হওয়া। অর্থাৎ এমন সম্পদ যার মধ্যে বৃৃদ্ধি পাওয়ার যোগ্যতা আছে। (এই বৃদ্ধি প্রকৃতগত ভাবে হোক ; যেমন – সোনা , রূপা অথবা কাজের ভিত্তিতে হোক ; যেমন- ব্যবসার মাল , গৃহপালিত পশু ইত্যাদি ।) (বাদায়ে উস সানায়ে ২/৩৭৭-৪০৫ )

যাকাত আদায় কখন ওয়াজিব ? যখন কারো নিকট নিছাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর স্থায়ী থাকে,তখন তার জন্য সে সম্পদের যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। (দুররে মুখতার ৩/১৮৬ ,হিদায়া ১/২০২)

যাকাতের ক্ষেত্রে চন্দ্র না সৌর বর্ষের হিসাব ধর্তব্য ? যাকাত আদায় করা ওয়াজিব হয় চন্দ্র বছরের হিসেবে সৌর বছরের হিশেবে নয় । অর্থাৎ আরবী মাসের যে তারিখে মালিকে নেসাব হবেন,সেই তারিখে প্রতি বছর যাকাতের হিসাব করতে হবে । ( দুররে মুখতার ৩/২৯৪,ফাতাওয়া উসমানী ২/৬৭)
যাকাতের নিছাব কতটুকু ?
সোনার নিছাব সাড়ে সাত তোলা এবং রোপার নিছাব সাড়ে বায়ান্ন তোলা বা এর সমপরিমাণ মূল্য ইত্যাদি । (বাদায়ে উস সানায়ে ২/৪১৭,হিদায়া ১/২১৩)
সোনা রূপা নিছাব থেকে কম হলে ?
যদি সোনা এবং রূপা বা বস্তু মালিকানাধীন থাকে,আর কোন একটির নিছাব পূর্ণ না হয়,তবে উভয়টি মিলিয়ে মূল্য বিবেচনা করতে হবে ।

যদি উভয়টির মূল্য যোগ করলে সোনা বা রূপা কোন একটির নিছাবের সমান হয়,তাহলে যাকাত ফরজ হবে,নতুবা কম হলে ফরজ হবেনা । (হিদায়া ১/২১৩)

মালের কতটুকু অংশ যাকাত দিতে হয় ?
যাকাতযোগ্য সম্পূর্ণ মালের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ তথা শতকরা ২.৫% যাকাত দেওয়া জরুরী । (আল-বাহরুর-রায়িক ২/৩৯৩)
ফিক্সডিপোজিটের উপর যাকাত ?
যারা যে টাকা পয়সা কয়েক বছরের জন্য ব্যংকে ফিক্সডিপোজিট রাখেন,তা যেহেতু নিশ্চিত পাওয়নার পর্যায়ভুক্ত ( دين قوي) যা পরে নির্ধারিত সময়ে পাওয়া নিশ্চিত,তাই জমা রাখা মূল টাকা পাওয়ার পর বিগত বছরগুলো সহ যাকাত ওয়াজিব হবে । যদি তা করজ মুক্ত নিছাব পরিমাণ টাকা থাকে । কিন্তু যে টাকা সুদ মিলবে তা সম্পূর্ণ হারাম । এর উপর যাকাত ওয়াজিব হবেনা ।বরং তা সুদি খাতে ব্যয় করা জরুরি। ( ফাতোয়ায়ে রাহমানীয়া ২/৩৮,ফাতোয়ায়ে উসমানী ২/৪৮,কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/৩২৬-৩২৭)

প্রভিডেন্ট ফান্ডের উপর যাকাত ?
চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা থেকে যে অংশ বাধ্যতা মুলক কর্তন করে জমা করা হয়-যাকে প্রভিডেন্ট ফান্ড বলা হয় । এর উপর যাকাত ওয়াজিব নয় । তবে চাকরি শেষ হওয়ার পর যখন চাকরিজীবী উক্ত টাকা পাবে তখন তার মালিকানাধীন সম্পদ বলে গণ্য হবে। আগামী দিনে নিয়মানুগ যাকাত ওয়াজিব হবে।

বিঃদ্র: উক্ত ফান্ডে টাকা যদি বাধ্যতামুলক কর্তন করা না হয়,বরং চাকরিজীবীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।যখন সে চায় তখন জমাকৃত টাকা খরচ করতে পারে।এরকম টাকার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে যদি তখন নিসাব পরিমাণ হয় । ( ফাতাওয়া উসমানী ২/৫০-৫৬,আহসানুল ফাতাওয়া ৪/২৬০)

হজ্জ্ব ও বাড়ি বানানোর জন্য জমাকৃত টাকা ?
যদি কোন মালিকে নিসাব ব্যক্তি হজ্জ্ব করা কিংবা বাড়ি বানানোর জন্য টাকা জমা করে রাখে আর এই সময়ের মধ্যে বাৎসরিক যাকাত দেয়ার সময় এসে যায়,তাহলে জমাকৃত উক্ত টাকার যাকাত দেয়া তাঁর উপর জরুরী । (ফাতওয়ায়ে শামী ৩/১৭৯, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ৯/৩৩৯)

কারা যাকাত গ্রহণের উপযোগী ?
নিম্নেক্ত লোকদেরকে যাকাত দেয়া যাবেঃ
(১) ফকির অর্থাৎ যার কাছে নিছাব পরিমাণ সম্পদ নেই।
(২)মিসকিন,অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন মালের মালিক নয়।
(৩)ইসলামী রাষ্ট্রের ঐকর্মচারী যে যাকাত ও ওশর ওসূূূূল করার কাজে নিযুক্ত।
(৪) এমন গোলাম যে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাহায্য প্রার্থী। যেহেতু বর্তমানে দাসপ্রথা নেই। তাই এ খাতটি এখন বাকি নেই।
(৫)এমন ঋণগ্রস্হ ব্যক্তি যার ঋণ পরিশোধ করার জন্য নিজস্ব সম্পদ নেই ।
(৬) ইসলামের সেসব যোদ্ধা বা গাজী এবং মুজাহিদ যারা নিজস্ব সাজ-সরঞ্জাম এবং উপায় উপকরণ না থাকার দরুন ইসলামী সৈন্য বাহিনী থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে ।
(৭) এমন মুসাফির যে সফররত হালতে প্রয়োজনগ্রস্হ ও অভাবগ্রস্হ হয়ে পড়েছে। (যদিও তার বাড়িতে ধন-সম্পদ থাকে । কিন্তু প্রয়োজন পূরণ করার জন্য বাড়ি থেকে তাৎক্ষণিক অর্থ-কড়ি যোগাড় করা দুরূহ ।(মারাকিউল ফালাহ ৩৯২; আল বাহরুর রায়িক ২/৪২২,দুররে মুখতার ৩/২৮৩)

প্রকাশ থাকে যে,রাসুলুল্লাহ (সা:) এর যুগে একটি খাত এ-ও ছিল যে,লোকদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য অথবা অভাবগ্রস্হ নওমুসলিমকে ইসলাম এর প্রতি পরিতুষ্ট রাখার জন্য তাদের মন জয় করার উদ্দেশ্যে যাকাত খরচ করা হতো । কিন্তু পরবর্তীতে এ হুকুম রহিত হয়ে গেছে। তাই শুধু নওমুসলিম হওয়ার কারণে কাউকে যাকাত দেওয়া যাবেনা । তবে হ্যা,যদি নওমুসলিম লোক ফকীর বা মিসকিন হয়,তাহলে সে হিশেবে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে । (শামী ৩/২৮৭-২৮৮, বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৭৪ হিদায়া ১/২০৪)

যাকাতের ক্ষেত্রে নিকটাত্নীয়র হক ?
আপন মা-বাবা, দাদা-দাদী,নানা-নানী,সন্তান-সন্ততি,স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্যান্য সকল অভাবগ্রস্ত আত্মীয় যথা ভাই,বোন,চাচা,ফুফু,মামা,ভাগিনা-ভাগিনী প্রমুখকে যাকাত দেওয়া অতি উত্তম । এতে দ্বিগুণ ছাওয়াব। এক হলো যাকাত দেওয়ার ছওয়াব; দ্বিতীয় হলো আত্মীয়তা বজায় রাখার ছওয়াব । (ফাতাওয়া উসমানী(২/১৩৩)

মাদ্রাসায় যাকাত দেওয়ার মধ্যে ৩ গুণ সওয়াব। যাকাতের টাকা মাদ্রাসায় দান করা হলে তিন গুণ সাওয়াব ( অর্থাৎ দান,দ্বীনের সহায়তা ও সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব) পাওয়া যাবে ।

যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবেনা :
যাকাতের টাকা যাকাত দাতার সাথে জন্মের সম্পর্ক যথা মা-বাপ,দাদা-দাদী,নানা-নানী, এবং যাকাতদাতার সাথে যাদের সম্পর্ক যেমন:ছেলে-মেয়ে,নাতী-পোতা ইত্যাদিদেরকে যাকাত দেয়া জায়েজ নয় । এতে যাকাত আদায় হবেনা । এমনিভাবে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে বা ধনীকে বা বিধর্মীকে যাকাত দেয়া জায়েজ নয় । সাইয়্যেদ বা সৈয়দ অর্থাৎ বনু হাশিম তথা রাসুলুল্লাহ (সা:) এর বংশধর এবং তাদের আযাদকৃত দাসদের যাকাত দেয়া জায়েজ নয় । বনু হাশিম গোত্রের লোক হলেন, হযরত আলী (রা:),হযরত আব্বাস (রা:), হযরত জাফর (রা:),হযরত আকীল (রা:) হযরত হারিস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা:) এর সন্তান সন্ততি ও তাদের বংশধর। তবে হ্যা যাকাত ও ওয়াজিব সাদাকাহ ছাড়া নফল দান সাদাকাহ দ্বারা তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা যায়। ( বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৮৩,হিদায়া ১/২০৬,আল-বাহরুর-রায়িক ২/২৪৩,কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/২৮৬,৩০৭)

যাকাতের টাকা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা ?
যাকাতের মাল শুধুমাত্র গরীব আর মিসকিনদের হক । তাদেরকে মালিক বানিয়ে দিলেই যাকাত আদায় হয় ।সুতারাং জনসাধারণের সেবা ও কল্যাণমূলক কাজ যেমন -রাস্তা,পুলপানির ট্যাঙ্কি,চিকিৎসালয় ইত্যাদি নির্মাণে যাকাতের টাকা খরচ করা জায়েজ হবেনা । কারণ এসব ক্ষেত্রে উক্ত যাকাতের মাল কোন ব্যক্তি বিশেষকে মালিক বানিয়ে দেয়া হয় না । তাই এসব ক্ষেত্রে যাকাতের টাকা খরচ করলে যাকাত আদায় হবেনা । ( হিন্দিয়া ১/১৮৮,১৯০,ফাতাওয়া উসমানী ২/১৪২)

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, জামিআ' ফারুকিয়্যাহ সিলেট

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ