ইসমাঈল হাবীব
প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে রমজান। রমজানের সংবাদ পেয়ে মু'মিনের হৃদয় খুশিতে ডগমগ করতে থাকে। মনের সেতারে বাজতে থাকে নাজাত প্রাপ্তির ঘোষণা।চোখের তারায় ভেসে ওঠে চিরসবুজ জান্নাতের ছবি।প্রতিবার রমজানকে ঘিরে প্রতিটি মুমিনের মনোহৃদয় নতুন করে সাজতে থাকে। আকুলপ্রাণে অনেকেই জানতে চায়, আমাদের হৃদয়ের বাদশাহ রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান কেমন কাটাতেন?
আমরাও চাই, আমাদের রমজান সেভাবে কাটাবো, প্রিয় রাসুলের আদর্শে আমরা আর্দশিত হবো।কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন; নিশ্চয় আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে, তোমাদের জন্য উত্তম আর্দশ। (সুরা আহযাব, আয়াত নং ২১)
রমজান এলে অন্যান্য মাসের তুলনায় রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটু আলাদা হয়ে যেতেন। রমজানকে সাদরে বরণ করে নেবার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন। রমজানকে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রাণভরে দুআ' করতেন। সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুমকে বলতেন; নিশ্চয় তোমাদের সামনে এমন একটি মাস আসছে, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, এবং এই মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার রাত, সুতরাং তোমরা এই মাসকে হেলায় কেটে দিয়ো না।এই মাসের প্রতিটি সময়ক্ষণকে সাদরে গ্রহণ করো
কুরআন তেলাওয়াত ও দান দাক্ষিণ্য
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানকে কেন্দ্র করে ইবাদতের পরিমাণ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতেন।হযরত জিবরিল আমীন নবীজির সাথে কুরআন শরীফ ‘দাওর’ করতেন।তাঁরা পরস্পর পরস্পরকে কুরআন শোনাতেন।
রমজানে নবীজি হয়ে ওঠতেন দানশীল। শ্রেষ্ঠ দানশীল।মুক্ত প্রবহমান বাতাসের মতো দান করতেন।অর্থাৎ দু’মুঠো ভরে ভরে তিনি দান করেন, ইয়াতীম দরিদ্রদের মাঝে। হাদীসে শরীফে এসেছে তিনি ছিলেন সবচে’ বড় দানশীল। আর রমজান এলে আরো বড় দানশীল হতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে দেখে সাহাবায়ে কেরামেরও অনুরূপ দান করতেন।তাঁরা অনুসরণে অনুকরণে কেবল রাসূলকে দেখতেন।
কেমন ছিলো সাহরি ও ইফতার
রমযান মাসের বিশেষ সময়গুলোর মাঝে অন্যতম হলো সাহরীর সময়। আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুমকে সাহরী খেতে বলেছেন; তোমরা সকলে মিলে সাহরী খাও, কেননা সাহরীতে রয়েছে অনেক বরকত। (মুসলিম শরীফ হাদীস নং—৩৫০)
নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহরি খেতেন সুবহে সাদিকের আগ মুহূর্তে অর্থাৎ রাতের শেষ ভাগে।এই সময়ে সাহরি খাওয়া নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক পছন্দ করতেন।সাহাবি হযরত যায়েদ বিন সাবেত রা. বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সাহারী খেতাম, এরপর তিনি সালাতের জন্য দাঁড়াতেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফজরের আজান ও সাহরির মাঝে কতটুকু ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, পঞ্চাশ আয়াত (পাঠ করা) পরিমাণ। (বুখারি, হাদিস : ১৯২১)
রমজান মাসে প্রিয় নবীজির আরও আমল ছিলো, যথাসময়ে ইফতার করা। ঘরে, সফরে কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে সবসময়ের জন্য এটি নবীজির আমল ছিল, সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেজুর কিংবা অন্যকোনো খাবারের মাধ্যমে রোজা ভাঙতেন।একবারের ঘটনা, সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রমজান মাসে কোনো এক সফরে আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সফরসঙ্গী ছিলাম।
সন্ধ্যায় সূর্য ডুবে গেলে তিনি আমাদের একজনকে বললেন; হে অমুক! অবতরণ করো এবং আমাদের জন্য ছাতু গুলে আনো। সে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এখনো দিন রয়ে গেছে।তখন পুনরায় তিনি বললেন, অবতরণ করো এবং আমাদের জন্য ছাতুগুলে আনো। তখন সে অবতরণ করলো এবং ছাতুগুলে তাঁর নিকট পেশ করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করলেন এবং হাত দ্বারা ইঙ্গিত করে বললেন, সূর্য এদিক থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং রাত যখন এদিক থেকে ঘনিয়ে আসবে, তখন সিয়াম পালনকারী ইফতার করবে। (মুসলিম, হাদিস : ২৪৪৯)
কেমন ছিলো তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ
তারাবির ফজিলত সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকী লাভের আশায় কিয়ামুল লাইল তথা তারাবিহ আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি ও মুসলিম)
হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার রমজান মাসে রাত্রিবেলায় মসজিদে নববীতে নামাজ তারাবিহ আদায় করলেন।উপস্থিত লোকেরাও তার সঙ্গে নামাজে শরীক হলেন। একইভাবে তারা দ্বিতীয় দিনেও নামাজ আদায় করলেন এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলো। অতঃপর তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও মানুষ একত্রিত হলো।
কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা. হুজরা থেকে বেরিয়ে তাদের কাছে এলেন না। অতঃপর সকাল তিনি বললেন, তোমাদের অপেক্ষা করার বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আমি শুধু এ ভয়ে তোমাদের নিকট আসা থেকে বিরত থেকেছি যে, আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, না জানি তোমাদের ওপর এটা (তারাবি) ফরজ করে দেওয়া হয়। (বুখারি শরিফ)
রমজান মাসে নবীজির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল ছিল তাহাজ্জুদের নামাজ। প্রথম রাতে তারাবি শেষ করে রাতের শেষ অংশে আবার তাহাজ্জুদের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন।
প্রিয় নবীর তাহাজ্জুদ নামাজের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে ও অন্যান্য সব মাসের রাতে এগারো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন। এ চার রাকাত আদায়ের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না।
অতঃপর আরো চার রাকাত সালাত আদায় করতেন।এ চার রাকাতের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিন রাকাত আদায় করতেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি বিতির সালাত আদায়ের পূর্বে ঘুমিয়ে পড়েন? নবী (সা.) বললেন, আমার চোখ ঘুমায়, আমার অন্তর ঘুমায় না। (বুখারি, হাদিস : ৩৫৬৯)
ইতিকাফ ও লাইলাতুল কদর
রমজানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর ধারাবাহিক ও গুরুত্বপূর্ণ আমল ছিল ই'তিকাফ করা। আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই'তিকাফ করতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০৩৩)
এমনকি একবার সফরের কারণে রমজানে তিনি ইতিকাফ করতে পারেননি, তৎপরবর্তী বছর ২০ দিন ইতিকাফ করে তা পূর্ণ করে নিয়েছিলেন। এই মর্মে সাহাবি আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, নবি কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানে দশ দিনের ইতিকাফ করতেন। তিনি যে বছর ইন্তেকাল করেন সে বছরও তিনি বিশ দিনের ই'তিকাফ করেছিলেন। (বুখারি, হাদিস : ২০৪৪)
রমজান মাসে সবচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাত হলো লাইলাতুল কদর অর্থাৎ মহিমান্বিত রজনী। কুরআনে করীমে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় আমি কুরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
(সূরা কদর আয়াত নং ১,২,)
হাদিস শরিফে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় কদরের রাতে নামাজে দণ্ডায়মান থাকবে, তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।(মুসলিম হাদীস নং—৭৬০, বুখারী, হাদীস নং ২০১৪)
সুতরাং কোন ব্যক্তি এই ফযীলত লাভে সচেষ্ট হয়ে অন্তত এশা ও ফজরের নামায যদি জামাতে পড়ে তবু সাড়ারাত নামাজ পড়ার সমান সাওয়াব পাবে।কেননা হাদীস শরীফে এসেছে, যে এশা ও ফজর জামাতের সাথে পড়লো, সে যেন সারারাত দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলো।
লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জামিয়া ইসলামিয়া মুহাম্মদপুর লালমাটিয়া, ঢাকা।
আওয়ার ইসলামে লেখা পাঠাদে মেইল করুন[email protected]
-এটি