মুহাম্মদ বিন ওয়াহিদ
গত বছর মার্চ মাসে করোনাভাইরাস যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, সবাই যখন আতঙ্কিত ও পর্যুদস্ত, তখন বিশ্বের মানুষ ভয়াবহ মারণব্যাধি করোনার সাথে সাথে ভারতীয় কট্টর হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক আচরণের জঘন্য নজির দেখেছিল। ভারতের বিজেপি সরকার করোনা প্রতিরোধে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে করোনাভাইরাস নিয়েও রাজনীতি করেছিল।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে গোটা পৃথিবী যখন মহাসঙ্কটকাল অতিক্রম করে, তখন ভারতীয় এক শ্রেণীর লোকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্বদেশে নতুনকরে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। করোনার প্রতিরোধের চেয়ে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম বিদ্বেষের অসহিষ্ণু আগুন প্রজ্জ্বলিত করা। শতশত মানুষের লাশ আর জীবন বাঁচানোর আহাজারি তাদেরকে নিবৃত্ত রাখতে পারেনি ধর্মের লড়াই থেকে। তাই একেরপর এক অপবাদ চাপিয়ে দিচ্ছিল তারা মুসলমানদের ওপরে।
এই স্বার্থান্বেষী লোকদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিল ভারতীয় অসাধু কিছু সংবাদমাধ্যম। মদদ জোগাচ্ছিল দুষ্টচরিত্রের কতিপয় রাজনীতিকও। মুসলিম মাত্রই করোনা বহনকারী। কোনো হিন্দু তাদের সংস্পর্শে গেলে সেও সংক্রমিত হবে। ভারতীয় জনসাধারণের মনের মধ্যে এই ধারণা তারা বদ্ধমূল করে দিয়েছিল।
এই বিশ্বাস থেকেই ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে ক্ষণেক্ষণে মুসলমানদের লাঞ্চিত করা হয়। করা হয় এলাকা থেকে অবাঞ্চিত ঘোষণা। গত ১৫ মার্চ ২০২০ দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে তাবলীগ জামাতের এক জমায়েতকে কেন্দ্রকরে আরও নানা ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করা হতে থাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয় ওই মারকাজেও। তরান্বিত হয় মুসলিম বিদ্বেষ।
গত বছর ১৫ মার্চ মুহাম্মদ দিলশাদ ( ৩৭) নামে এক মুসলমান যুবক দিল্লির ওই ইজতেমায় যোগ দেয়ার পর করোনা নেগেটিভ থাকা সত্ত্বেও ১৪ দিন হোম কোয়ারান্টাইন পালন করেও সে নিস্তার পায়নি নিজ গ্রামের হিন্দুদের থেকে। তারা দিলশাদের ওপর নানারকম অত্যাচার ও নিপিড়ন চালাতে থাকলে নিরুপায় দিলশাদ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।
রাজস্থানের ইরফান খান নামের এক যুবক তার প্রসূতি স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে গেলে চিকিৎসকরা যখন জানতে পারে সে মুসলমান তখন আর চিকিৎসাসেবা দেয়নি। ফলে প্রসূতি নারীটি সন্তান জন্ম দিয়েছিল পথেই। ধর্মে একজন মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের সঙ্গে এমন আচরণ কতটুকু যুক্তিসঙ্গত ছিল আমার জানা নেই।
ভারতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার অজুহাতে মাহবুব আলী নামের এক মুসলমান যুবককে যেসব হিন্দুরা মারধর করেছিল গত বছর, তারা অত্যন্ত নির্দয়তার পরিচয় দিয়েছিল। তাদের আচরণে মানবিকতার লেশমাত্র দেখা যায়নি। বিশ্ব যখন করোনার প্রাদুর্ভাবে পর্যুদস্ত, তখন ভারত সরকার মুসলমানদেরকে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক গণ্য করে এই ভয়াবহ ইস্যুকেও রাজনৈতিক রূপায়ণে ব্যতিব্যস্ত ছিল।
উত্তর-পশ্চিম দিল্লির প্রান্তে হেরেওয়ালি গ্রামে মাহবুব আলীকে একটি মাঠের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় প্রথমে। হিন্দুদের একটি সঙ্গবদ্ধ দল তাঁর নাক এবং কান থেকে রক্ত পড়ার আগ পর্যন্ত লাঠি ও জুতো দিয়ে আঘাত করতে থাকে।
আলী গত ১৫ মার্চ দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে অনুষ্ঠিত তাবলীগ জামাতের একটি সমাবেশ থেকে নিজ গ্রামে ফিরে গেলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনে করতে থাকে সে দেশব্যাপী করোনভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার তথাকথিত ইসলামী ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসেবে কাজ করছে।
যারা তাকে মারধর করেছিল তাদের ইচ্ছে ছিল, ২২ বছর বয়সী ধর্মপরায়ণ এই মুসলিম যুবককে করোনার জিহাদ চালানোর আগেই তার উপযুক্ত শাস্তি তাকে বুঝিয়ে দিতে। তার ওপর উত্থাপিত অভিযোগগুলো ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।
আলীর কাছে তারা প্রহার করা অবস্থায় জানতে চাইছিল, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে আর কারও হাত আছে কিনা! অতঃপর তাকে নিকটবর্তী একটি হিন্দু মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে হাসপাতালে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার আগেই ইসলাম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তকরণের কথা বলা হয়। কিন্তু, তার আগেই সে মৃত্যু বরণ করে।
মোদি সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নিজেদের ব্যর্থতা ধামাচাপা দিতে গিয়ে জনগণের মনোযোগ সরানোর জন্যই মুসলমানদের টার্গেটে পরিণত করছে বলে ওই সময় অভিযোগ করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি বলেছিলেন, ইহুদিদের বিরুদ্ধে জার্মানিরা যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, মোদি সরকার ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
ইমরান খান আরও বলেছিলেন, ভারত সরকার করোনা পরিস্থিতিতে মুসলমানদের সঙ্গে গণহত্যার আচরণ করছে। করোনায় আক্রান্ত মুসলমানদেরকে হিন্দু রোগী থেকে আলাদা করে ফেলছে। ওই সময় ভারতীয় সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন অরুন্ধতী রায়, আসাদুদ্দীন ওআইসি, দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার মুহতামিম আবুল কাসিম নোমানী ও মুসলিমবিশ্ব ভিত্তিক সংগঠন ওআইসি।
গত বছর এ সময় ভারতীয় মুসলমানরা বর্ণনাতীত সঙ্কট ও আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। রমজানে তাদের মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়। মাইকে আজান নিষিদ্ধ করা হয়। দারুল উলুম দেওবন্দসহ ভারতের সমস্ত মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ছাড়াও বিজেপি সরকার, ভারতীয় কুচক্রী মিডিয়া ও কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের অব্যাহত মিথ্যা অভিযোগে ভারতীয় মুসলমানদের জীবন তখন নাকাল হয়ে গিয়েছিল।
অবস্থার পরিবর্তন কত তাড়াতাড়ি হয়েগেল। যেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভারতীয় হিন্দুরা করোনাভাইরাস ছড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ করেছিল, অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করেছিল, মসজিদ মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছিল, হাজারের বেশি মুসলমানকে গ্রেপ্তার করেছিল, আজকে তারাই নিজেদের জীবন বাজি রেখে হিন্দুদের প্রাণ বাঁচাতে ঝাপিয়ে পড়ছে। গত বছর যে মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল, আজকে সে মসজিদেই তারা ফ্রী সেবা নিচ্ছে। এটাই ইসলাম। এটাই মানবতা। মুসলমানরা বিনিময় এভাবেই দেয়। সাম্প্রদায়িক ভারতে মানবিক মুসলমানদের আচরণ দেখছে গোটা বিশ্ব।
যে পাকিস্তানকে ঘুমের ঘোরেও ভারত শত্রু ভাবে, তারাও আজ ভারতের পাশে। পাকিস্তানের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে ক্রিকেটার শোয়েব আখতারও ভারতের দিকে মানবিক হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কথা হলো, করোনা পরবর্তী সময়ে ভারত কি এসব মনে রাখবে? নাকি করোনাভাইরাসের মত তাদের জঘন্য সাম্প্রদায়িকাতা আবারো বিষবাষ্প ছড়াবে?
-এটি