মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
সৌদির সেবা কোম্পানির সঙ্গে হজ এজেন্সির চুক্তির নির্দেশনা মহেশখালী থানার বিশেষ অভিযানে পরোয়ানাভুক্ত ১১ জন আসামি গ্রেফতার বৃষ্টির সময় কাবা প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় ওমরা পালনকারীদের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট গ্রাহকদের মূলধন ফেরত পাওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন মাওলানা আতহার আলীকে বাদ দিয়ে জাতীয় ইতিহাস রচিত হতে পারে না: ধর্ম উপদেষ্টা জরুরি সভা ডাকল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কক্সবাজারে উৎসবমুখর পরিবেশে রোপা আমন ধান কাটা শুরু চাঁদপুর হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় জামিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাহর সাফল্য বগুড়ায় আন্দোলনে নিহত রিপনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত

জাকাতের গুরুত্ব, বিধান ও উপকারিতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নূর মুহাম্মদ রাহমানী

জাকাত ইসলামের ফরজ বিধান। ইসলামের তৃতীয় ভিত্তি বা রুকন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। তার মধ্যে একটি জাকাত দেওয়া। অর্থনৈতিক ইবাদতের মধ্যে এটি অন্যতম। ২য় হিজরিতে জাকাত ফরজ হয়। জাকাত ফরজ হওয়া পবিত্র কোরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত দাও।’ (সুরা বাকারা : ৪৩)। নামাজের পরে জাকাতেরই স্তর। কোরআনে ঈমানের পর নামাজ এবং সঙ্গে সঙ্গেই জাকাতের আলোচনা করা হয়েছে। নামাজ ও জাকাত একসঙ্গে কোরআনে ২৮ বার আলোচিত হয়েছে। (ফাতাওয়া শামি : ২/২৫৬)।

জাকাতের বিধান: প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নার-নারী; যার মালিকানায় ঋণ ব্যতীত নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ তথা কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমতুল্য সম্পদ বা অর্থ। ওই পরিমাণ সম্পদ কারও কাছে পূর্ণ এক চন্দ্র বছর অতিবাহিত হলে, তার ওপর জাকাত আদায় করা ফরজ। জাকাত দিতে হয় ৪০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ শতকারা ২.৫%।

চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষ এবং অন্যান্য আরও হারাম উপায়ে উপার্জিত সম্পদ জাকাত দিলে কোনো ফায়েদা বয়ে আনবে না। শুধু হালাল উপায়ে উপার্জিত সম্পদ জাকাতই গ্রহণযোগ্য।

জাকাত যেহেতু ফরজ বিধান, তাই এর অস্বীকারকারী কাফের। কোরআনে জাকাত না দেওয়ার অনেক কঠোর শাস্তি বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ধন-সম্পদের যাকাত না দিলে বৃষ্টি হবে না। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার মহানবী (সা.) আমাদের কাছে আসলেন। অতঃপর বললেন, যারা নিজের ধন-সম্পদের যাকাত বন্ধ করে দেবে, তাদের জন্য আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ রাখা হবে। এমনকি চতুষ্পদ জন্তু না থাকলে আদৌ বৃষ্টি হবে না।’ (ইবনে মাজাহ : ৪০১৯)।

জাকাত আদায়ের সময়: বছরের যেকোনো সময় জাকাত দেওয়া যায়। তবে রমজান মাস জাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। এ মাসে দান-সদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি নেকি হয়। আর এখন তো করোনা মহামারির কারণে সমাজের অসহায় মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। তাই একে তো রমজান দ্বিতীয়ত মানুষের এখন অভাবের সময় তাই জাকাত আদায়ের এখনই মোক্ষম সময়। তাই এ সময় জাকাত আদায় করলে গরিব-অসহায় মানুষ সাহরি-ইফতারের জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে পারবেন। এতে করে তাদের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে।

জাকাতযোগ্য সম্পদ: জাকাতের সম্পদ মোট চার প্রকার : ১. ক. স্বর্ণের জাকাত : ৮৭.৪৮ গ্রাম অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণে জাকাত ওয়াজিব। খ. রুপার জাকাত : ৬১২.৩৬ গ্রাম তথা সাড়ে ৫২ তোলা রুপায় জাকাত ওয়াজিব। এর চেয়ে কমে জাকাত ওয়াজিব হবে না। স্বর্ণ ও রুপা এ দুটো চাই ব্যবহৃত হোক বা কোথাও সংরক্ষিত থাকুক সর্বাবস্থায় জাকাত ওয়াজিব। জাকাত মূল্য হিসাব করে দেওয়া হোক কিংবা ওজন হিসেবে দেওয়া হোক শতকারা আড়াই ভাগ জাকাত দিতে হবে। যদি নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে (স্বর্ণ ও রুপা) আলাদা আলাদা কম থাকে, তবে দুটির অর্থ একত্রে রুপা বা স্বর্ণের নির্ধারিত পরিমাণ অনুযায়ী হয়, তাহলে জাকাত দিতে হবে।

২. যেসব পশু বছরের অধিকাংশ সময় চড়ে ঘাস-পানি খায়। তেমন কোনো খরচ থাকে না। পশুগুলো নির্ধারিত পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হয়।

৩. নগদ-নগদায়নযোগ্য টাকা : যেকোনো মুদ্রায়, যেকোনো পদ্ধতিতে, যেকোনো উদ্দেশ্যে, যেকোনো স্থানে জমাকৃত অর্থ তথা ব্যাংক একাউন্ট, চেক, বন্ড, ডেবিট কার্ড ইত্যাদিতে জাকাত ওয়াজিব। এ ছাড়াও বাকিতে বিক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য ও পাওনা টাকা যা প্রাপ্তির আশা আছে, ঐচ্ছিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের সমুদয় অর্থ, বাধ্যতামূলক প্রভিডেন্ট ফান্ডের সাথে স্বেচ্ছা প্রদত্ত অতিরিক্ত অংশ, সিকিউরিটি কিংবা এডভান্স হিসাবে ফেরতযোগ্য অর্থ এ সবগুলোতে জাকাত ওয়াজিব।

৪. ব্যবসায়ের সম্পদ প্রবৃদ্ধি বা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে নেওয়া ঋণ অথবা ব্যক্তিগত অর্থ দ্বারা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পণ্য যেকোনো স্থানে যেকোনো পদ্ধতিতে থাকুক তাতে জাকাত ওয়াজিব। মুজারাবা কিংবা অংশীদারী কারবারে বিনিয়োগকৃত অর্থের নগদ অংশ, তা দ্বারা খরিদকৃত ব্যবসায় পণ্য, ক্যাপিটাল গেইন এর উদ্দেশ্যে কেনা শেয়ার এবং লাভের উদ্দেশ্যে কেনা শেয়ারের জাকাতযোগ্য সম্পদের মূল্য এগুলোতেও জাকাত ওয়াজিব।

যেসব পণ্যে জাকাত নেই: বাহনজন্তু, গাড়ি, প্রাইভেটকার, বসবাসের ঘর-বাড়ি, দোকান, কোম্পানির মেশিন ইত্যাদিতে জাকাত নেই। এগুলো ভাড়ায় দিলে এর আয় নেসাব পরিমাণ হয়ে বছর পূর্ণ হলে জাকাত আসবে।

জাকাতের উপকারিতা : ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে জাকাত আদায়ের উপকারিতা অগণিত অসংখ্য। জাকাতের আভিধানিক অর্থ পবিত্র হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। জাকাত দিলে সম্পদ পবিত্র হয়। সম্পদ বৃদ্ধি পায়। জাকাত ধন-সম্পদের পবিত্রতা সাধন করে। সম্পদের মধ্যে অপরের সম্পদ মিশে থাকলে তা কলুষিত হয়। সে অপরের সম্পদ তা হতে বের করে না দেওয়া পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারে না। এ কারণে প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যখন তোমার সম্পদের জাকাত দিয়ে দিলে, তখন তুমি তা হতে (তোমার পক্ষে) খারাপটা দূর করে দিলে।’ অর্থাৎ গরিব-মিসকিনের যে ভাগটা তোমার সম্পদের সাথে ছিল তা সরিয়ে দিয়ে নিজের সম্পদকে পবিত্র করলে। জাকাত ধন-সম্পদে প্রবৃদ্ধি ঘটায় এর অর্থ হলো এতে সম্পদে বরকত হয়। বাহ্যত সম্পদ কমে যেতে দেখলেও প্রকৃতপক্ষে তাতে বৃদ্ধি ঘটে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তোমরা যে জাকাত দাও, প্রকৃতপক্ষে সেই জাকাত তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে।’ (সুরা রোম : ৩৯)।

জাকাত একটি আর্থসামাজিক ইবাদত। তবে এটি শুধু গরিব-অসহায়দের দায়িত্বগ্রহণ এবং অর্থকড়ির বণ্টণের একটি ভারসাম্য কার্যক্রমই নয়; বরং এটি এমন ইবাদত যা অন্তর ও রুহের কদর্যতাও পরিষ্কার করে। মানুষকে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হিসেবে গড়ে তুলে। সঙ্গে সঙ্গে জাকাত আল্লাহ প্রদত্ত অগণিত অসংখ্য নিয়ামতের স্বীকৃতি এবং এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উত্তম মাধ্যম। জাকাত আদায় গুনাহের কাফফারা এবং মর্যাদা বৃদ্ধির অনেক বড় মাধ্যম। জাকাত দিলে মানুষের প্রিয় হওয়া যায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘দাতা আল্লাহর কাছে প্রিয়। মানুষের কাছে প্রিয়। জান্নাতের নিকটতম। জাহান্নাম থেকে দূরে। সাধারণ দাতা অধিক ইবাদতকারী কৃপণ অপেক্ষা আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়।’ (তিরমিজি : ১৯৬১)। জাকাত দারিদ্র বিমোচন করে ও সম্পদের প্রবাহ তৈরি করে। ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করে। আল্লাহ বলেন, ‘যাতে তোমাদের বিত্তবানদের মাঝেই শুধু সম্পদ আবর্তন না করে।’ (সুরা হাশর : ০৭)।

জাকাত দেওয়া যাবে যাদের : কোরআনে জাকাতের আটটি খাত উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘মূলত সদকা হলো ফকির, মিসকিন, জাকাতকর্মী, অনুরক্ত ব্যক্তি ও নওমুসলিম, কৃতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদ ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফির ও পথ সন্তানদের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।’ (সুরা তওবা : ৬০)।

হিসাব করে জাকাত প্রদান : সমুদয় সম্পদের সঠিক হিসাব অনুযায়ী জাকাত প্রদান করা হলেই জাকাত আদায় হবে এবং পুরো সম্পত্তি হালাল হবে। সম্পদের হিসাব-নিকাশ ছাড়া নামে মাত্র কিছু শাড়ি আর লুঙ্গি দিয়ে দিলে জাকাত আদায় হবে না। জাকাত হিসেবে নগদ অর্থ দেওয়াই ভালো। এতে করে গরিব-অসহায় মানুষ সত্যিকারভাবে উপকৃত হবেন। নিজেদের প্রয়োজনীয় খাতে খরচ করতে পারবেন।

লেখক: শিক্ষক, হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

আওয়ার ইসলামে লেখা পাঠাতে ইমেইল করুন[email protected]

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ