শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

আমি দ্বীনিয়াতের কাছে ঋণী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ আইয়ুব।।

আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় মু'জিযা হচ্ছে আল কুরআন। পৃথিবীর সবদেশে সমানভাবে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত, পঠিতও এই আল কুরআন। বিশ্ব ইতিহাসে কোন গ্রন্থ আল কুরআনের মর্যাদা ছোঁয়া তো দূরের কথা তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষারও দুঃসাহস দেখাতে পারেনি। বড় সৌভাগ্যবান সে সকল মহান মানুষ যারা কুরআনকে নিজেদের ধ্যান জ্ঞানে পরিণত করেছেন। জীবন দিয়ে মহিমান্বিত কুরআনকে বুকে আগলে রেখেছেন। নাজিল হওয়ার পর থেকে কুরআন মুখস্থ করা, পঠন-পাঠন, গবেষণা, চিন্তা-ভাবনা, ফিকির সবকিছুই চলছে সমানতালে ধারাবাহিকভাবে। উম্মতের সর্বজন শ্রদ্ধেয়, মান্যবর উলামায়ে কেরাম সদা সর্বদা নিজেদেরকে এই কুরআনের মাঝে ডুবিয়ে রেখেই মহান হয়েছেন, সম্মানিত স্মরণীয় বরণীয় হয়েছে। তারা উম্মতের মাঝে কুরআনী শিক্ষার প্রসার ও সহজতার জন্য আমৃত্যু ফিকির করেছেন।

রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ নিসৃত বাণী ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’ পড়ে কুরআনের পিছনেই জীবন দেয়ার ভাবনা সেই শৈশব থেকেই লালিত।

কুরআনের খেদমতে

দেওবন্দে থাকাকালীন সময়ে মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম দেশে ফিরে কুরআনের খেদমতে নিজেকে ওয়াকফ করে দিব। তবে দেশে ফিরে খেদমত হল মসজিদে। তবে থেমে রইলাম না। মসজিদ ভিত্তিক কুরআনের প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে মক্তব ও বয়স্ক কুরআন শিক্ষা কোর্স চালু করলাম। কিন্তু আফসোস, নিজের অলসতা, অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতা ও আদর্শ সিলেবাসের অভাবে এ যাত্রায় বেশি দূর এগোতে পারলাম না। দুই বছর মসজিদের খেদমতে করেও ফলাফল শূন্য। এরই মাঝে একটু আধটু দুনিয়াবী চিন্তা মাথায় ঢুকে কুরআনী জজবায় ভাটা পড়ল।

দীনিয়াতের ট্রেনিংয়ে

মাস দেড়েক আগের কথা। উস্তাযে মুহতারাম শায়খ মাকনুন সাহেবের কল্যানে সন্ধান পেলাম দীনিয়াত নামের একটি কুরআনী শিক্ষার মুনাজজাম সিস্টেমের। তাদের ছয়দিন ব্যাপী একটি ট্রেনিং আমাকে ভীষনভাবে নাড়া দিল। সহজে কুরআন শিক্ষাদানের পদ্ধতি দেখে আমি রীতিমতো অবাক। দীনিয়াতের সন্ধান আগে কেন পেলাম না ভেবে নিজেকে নিজেকে তিরস্কার করলাম।

কি আছে দীনিয়াতে?

দীনিয়াতের সিলেবাসটা এত চমৎকার ভাবে বিন্যস্ত যে, ছেলে মেয়ে, বুড়ো গুড়ো, তরুণ কিশোর, যুবকসহ সব বয়সী মানুষ কুরআন সহ দ্বীনের মৌলিক বিষয় শিক্ষার আগ্রহের পিছেনে না পড়ে পারে না। দীনিয়াত তার দূরদর্শিতার মাধ্যমে একটা শুধু একটি শিশুকে দ্বীন শিখাবে তা নয় বরং কৌশলে তার পুরো পরিবারকেই দ্বীন শিখিয়ে দিবে।

দীনিয়াত একদিকে তালিবুল ইলমকে আদর্শ নাগরিক ও খাঁটি আল্লাহর বান্দায় পরিণত করে অপরদিকে তার পুরো পরিবারকে এই নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসে। দলমত নির্বিশেষে সমাজ ও রাষ্ট্রে সুনাগরিক তৈরীর চমৎকার পরিকল্পনা দীনিয়াত করে যাচ্ছে। মাশাআল্লাহ ।

দীনিয়াতের প্রশিক্ষণের একটি অংশ জুড়ে ছিল মনোবিজ্ঞান। আমার মনে হয় কওমি অঙ্গন বা কুরআন শিক্ষা কোর্সে মনোবিজ্ঞানের প্রশিক্ষণ বাংলাদেশে এই প্রথম।মনোবিজ্ঞানের ক্লাস করিয়েছেন দীনিয়াত বাংলাদেশের প্রধান আলহাজ্ব মুফতি সালমান দা.। উম্মতের দ্বীনি তা'লিম প্রদানের ভাবনায় বিভোর চিন্তাশীল মানুষটি আমাদেরকে কুরআন হাদিসের আলোকে সাবলীলভাবে চমৎকার উপস্থাপনায় বাচ্চাদের মনোবিজ্ঞান বিষয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করেন।তিনি বুঝালেন বাচ্চারা হচ্ছে ফুলের মতন। ফুল যেমন কেউ পা দিয়ে মাড়ায় না ঠিক তদ্রূপ বাচ্চাদেরকে অহেতুক গরুর মতো পিটানো যায়না।এদেরকে আদর স্নেহ, সোহাগ ভালোবাসা,উৎসাহ ও পুরষ্কার দিয়ে পড়া আদায় করতে হয়।

দীনিয়াতের প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি আমার বাচ্চাদের মনোবিজ্ঞানের আলোকে পড়াচ্ছি।আলহামদুলিল্লাহ যে বাচ্চাটা দুইমাস যাবত মক্তবে একটি অক্ষরও আমার কাছে শুনায়নি আজ সেও পড়া বলার জন্য সিরিয়ালে বসে থাকে।

দীনিয়াতের উসিলায় আজ অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। আমরা ঐ ট্রেনিংয়ে মোট ৩৬ জন অংশগ্রহণ করেছিলাম।মনোবিজ্ঞান ক্লাসের মধ্যে আমি অনেককে তার অতীত জীবনের জন্য আফসোস করতে দেখেছি যে,হায় হায়! বাচ্চাদের যদি ঐভাবে না পড়িয়ে এভাবে পড়াতাম! তাহলে হয়ত অনেক বাচ্চা হয়ত অকালে ঝরে পড়ত না।

অথচ গত দুই বছর ধরে আমি মসজিদে মক্তব পড়াই।আমার রুটিন ছিল ফজরের নামাজ পড়ে মাইকে বাচ্চাদের একটু ডাকা তারপর নাক ডাকা এক ঘুম। মক্তবে আসা বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড়, মারামারি, কিলাকিলির আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙত।কাঁচা ঘুম নিয়ে যখন ক্লাসে বসতাম তখন আসা শুরু হত এর বিচার,ওর বিচার।

কাঁচা ঘুমের হিংস্রতায় শুরু হত এজলাসের বিচার। বিচার পর্ব শেষ করে ঢুলুঢুলু চোখে শুরু হল পড়ানো পর্ব।বিশ পঁচিশ মিনিট একই আলিফ, বা, তা, সা’র হৈচৈ মার্কা মশক তারপর সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বি হামদিকা...। এ্যাই! যাও, তোমাদের ছুটি। ইন্না-লিল্লাহ। উম্মতের অবুঝ শিশুদের নিয়ে কি ভয়ানক খেয়ানত! সেসব দিনের কথা মনে পড়ে আজ নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনা।আহা! নিষ্পাপ বাচ্চাদের অমূল্য জীবন!

কিন্তু দীনিয়াতের প্রশিক্ষণের পর আমার এলাকায় এখন কুরআন শিক্ষার ছোটখাটো একটি বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। মক্তব শুরু হয় সকাল সাড়ে ছয়টায়। এখন আর বাচ্চাদের ডাকা লাগেনা বরং এরাই অন্যদের ডেকে আনে।একসময় আমি আর আমার ছাত্ররা ছুটির জন্য ছটফট করতাম আর এখন ছুটির সময় যতই ঘনিয়ে আসে ততই আমাদের মন খারাপ হয়। আগে কাউকে কোনভাবেই নামাজ পড়াতে পারিনি আর এখন দীনিয়াতের মুনাজজাম সিলেবাসের কারণে শীতের সকালেও বড়, ছোট,তরুণ,যুবা এমনকি বাচ্চারা পর্যন্ত ঘুম থেকে উঠে ফজরের কাতারে শামিল হয়! আগে মক্তব ফাঁকি দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলত।

আর দীনিয়াতের উসিলায় বাচ্চারা কুরআন পড়ায় এত মজা পেয়েছে যে,এখন কে কার আগে মক্তবে এসে কাঙ্ক্ষিত জায়গাটা দখল করবে সেই ভাবনায় বিভোর থাকে। দীনিয়াত মক্তব চালুর আগে ছেলে মেয়েরা মক্তব শিখত শুধু কুরআন শরীফ আর এখন বাচ্চা- বুড়ো, যুবা তরুণরা কুরআনের সাথে সাথে হাদীস, আকাইদ ও মাসাইল, ইসলামি তারবিয়ত এবং আরবি ভাষা শিখছে। পূর্বে ভাবতাম পড়া শিখানোর জন্য মারামারি শেষ সমাধান আর এখন আমি শেষ সমাধান আবিষ্কার করেছি বাহারি পুরষ্কার ও উৎসাহ মূলক কথা। আগে যেখানে পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের গলা ফাটিয়ে ডাকতে হত আর এখন কাকে রেখে কার পড়াটা আগে নিব এই ভেবে হিমশিম খাই।

ডাক দিয়ে যাই দীনিয়াতের

যেহুতু দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমি দীনিয়াতের মাধ্যমে নতুন পথের সন্ধান পেয়েছি। একটি অজপাড়াগাঁয়ের এলাকার শিশু, যুবক, বৃদ্ধদের কুরআনের স্বাদ পাইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি তাহলে আপনি কেন পারবেন না? উঠুন, মুসলিম উম্মাহের সোনামনিদের নিয়ে ভাবুন। কিয়ামতে আল্লাহ পাকের সামনে কি নিয়ে দাঁড়াবেন সেকথা একটু ভাবুন। এই উম্মত উলামায়ে কেরামের কাছে আমানত।আমানতের হিসাব না দিয়ে কিন্তু পরকালে পার পাওয়া যাবে না। মুফতি সালমান সাহেব আমাদের প্রশিক্ষণের মাঝে বড় দরদ নিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম যদি এই উম্মতের পিছনে মাত্র চল্লিশ দিন সময় দেয় তাহলে উম্মতের ৭৮% মানুষ বিশুদ্ধ দ্বীন শিখে যাবে ইনশাআল্লাহ।

জাতির কাণ্ডারি উলামায়ে কেরাম! এখনো কি অসহায় উম্মতের হাত ধরার সময় হয়নি?

লেখক: গোপালগঞ্জ সদরের উলপুর জুম্মাবাড়ি জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব, গোপালগঞ্জ সদরের খাদিজাতুল কুবরা রা. আদর্শ মহিলা মাদ্রাসা বনগ্রামের প্রিন্সিপাল।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ