সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


রমজানে পুণ্যবান মনীষীদের কুরআন প্রেম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।

রমজান এবং কুরআন একটি অপরটির সাথে গভীর এবং অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ইমাম রাজি (রহ.) বলেন, রোজা এবং কুরআন নাজিলের মধ্যে গভীর সম্পর্ক। যখন এই ফজিলতপূর্ণ মাসটিকে কুরআন নাজিলের সাথে খাস করা হলো তখন জরুরি ছিল এই মাসটি রোজার সাথেও খাস হবে। (তাফসিরে কাবির ৩/৯৮)

নবী হজরত মুসা (আ.)-কে যখন আল্লাহ তায়ালা আসমানি কিতাব প্রদানের ইচ্ছা করলেন তখন তাঁকে এক মাস পর্যন্ত রোজা রাখার আদেশ দিয়েছেন। এরপরে দশদিন বৃদ্ধি করেন। তারপরে গিয়ে কালামে ইলাহি প্রদান করা হয়।

এইজন্য অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজানে নবীজি (সা.) দীর্ঘ কেরাত পড়তেন। রমজানের এক রাতে নবীজির কুরআন তিলাওয়াত: নবীজি (সা.) অনেক বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। নামাজেও দীর্ঘ দীর্ঘ সূরা পড়তেন। একবার সাহাবি হজরত হুজাইফা (রা.) নবীজি (সা.) এর পিছনে নামাজে দাঁড়ালেন। নবীজি (সা.) সূরা বাকারা পড়লেন। অতঃপর সূরা নিসা পড়লেন। অতঃপর সূরা আলে ইমরান পড়লেন। তিলাওয়াতে আজাবের আয়াত আসলে থামতেন। মাত্র দুই রাকাত নামাজে নবীজি (সা.) এই দীর্ঘ কেরাত পড়েছেন। অতঃপর হজরত বেলাল (রা.) এসে ফজরের নামাজের জন্য আজান দিলেন।’ (মুসনাদে আহমদ) ইমাম নাসায়ি (রহ.) বর্ণনা করেছেন, নবীজি (সা.) এর ঐ নামাজ ছিল চার রাকাতবিশিষ্ট।

মনীষীদের কুরআন তিলাওয়াতের আধিক্য:

নবীজির নামাজে কুরআন তিলাওয়াতের এই গুরুত্বারোপকে অনুসরণ করেছেন মহামনীষীগণ। এইজন্য দেখা যায়, পুণ্যবান মনীষীগণ রমজান এলে তাদের দরস বা পাঠদান বন্ধ করে দিতেন। নিজের ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ করতেন। কুরআন নিয়ে মশগুল থাকতেন। তাদের আমল ও কর্ম আমাদের জন্য অনুসরণীয়। মনীষীদের কেউ কেউ রমজানের মাত্র তিন রাতে পুরা কুরআন খতম করেছেন। কেউ কেউ আবার সপ্তাহে এক খতম করেছেন। আবার কেউ কেউ দশদিনে এক খতম করেছেন। (লাতাইফুল মাআরিফ ১/১১)

কোনো কোনো মহামনীষীদের কুরআন তিলাওয়াতের পরিধি এত অধিক যে রীতিমতো আশ্চর্য হতে হয়। মহা গ্রন্থ কুরআন তিলাওয়াত বেশি বেশি করার আগ্রহ যাতে আমাদের সৃষ্টি হয় এজন্য ইতিহাসের পাতা থেকে এখানে কয়েকজন মহামনীষীর রমজানে কুরআন তিলাওয়াতের ঘটনা উল্লেখ করা হলো।

ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি রমজান মাসে ৬১ খতম তিলাওয়াত করতেন।

হাদিসের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বুখারি গ্রন্থকার ইমাম বুখারি (রহ.) সাথীদেরকে একত্রিত করতেন। তিনি সবার ইমামতি করতেন। প্রত্যেক রাকাতে বিশ আয়াত তিলাওয়াত করতেন। এভাবে সমগ্র কুরআন খতম করতেন। প্রত্যেক দিন সেহরি পর্যন্ত কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতেন। এভাবে তিন রাতে কুরআন খতম করতেন। রমজানের প্রতি দিনে একবার কুরআন খতম করতেন। কুরআনের এই খতম শেষ হতো ইফতারের সময়। প্রত্যেক খতম শেষে দোয়া-মুনাজাতের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। (ফাতহুল বারি ১/৪৮১)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) দিন-রাতে একশত রাকাত নামাজ পড়তেন। মাসয়ালাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব বাদশাহ কর্র্তৃক চাবুকের আঘাতে যখন দূর্বল হয়ে যান তখন দিন-রাতে দেড়শত রাকাত নফল নামাজ পড়তেন। অথচ তখন তার বয়স ছিল প্রায় আশি বছরের কাছাকাছি। প্রত্যেক সাত দিনে এক খতম দিতেন। প্রতি সাত রাতে এক খতম দিতেন। এশার নামাজের পর অল্পক্ষণ আরাম করতেন। অতঃপর সকাল পর্যন্ত দোয়া-নামাজে থাকতেন। ইমাম আহমদ (রহ.) পাঁচবার হজব্রত পালন করেছেন। (সিফাতুস সাফওয়া ১/৪৮৪)

জুহাইর ইবনে মুহাম্মদ রমজানের রাত-দিন মিলিয়ে তিন খতম কুরআন পড়তেন। পুরা রমজানে ৯০ বার কুরআন খতম করতেন। (সিফাতুস সাফওয়া ১/৫১০)

আবুল আব্বাস ইবনে আতা প্রতিদিন পুরা কুরআন খতম করতেন। রমজানে ২৪ ঘণ্টায় তিন খতম কুরআনুল কারিম পড়তেন। (প্রাগুক্ত ১/৫৩৩; আল বিদায়া ১১/১৬৪)

আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আলী কিনানি তিনি তওয়াফের মাঝে ১২ হাজার বার কুরআনুল কারিমের তিলাওয়াত করতেন। (প্রাগুক্ত ১/৫৩৯)
কুতুবে আলম হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী (রহ.) বাদ মাগরিব আওয়াবিনে দু’পারা ও তাহাজ্জুদসহ দৈনিক অর্ধ খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন।

আল্লামা কাসেম নাতুতুবী (রহ.) ১২৭৭ হিজরিতে মক্কা-মদিনা সফরকালে রমজান মাসে কুরআন পাক মুখস্ত করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। একবার তিনি এক রাকাতে সাতাশ পারা তিলাওয়াত করেছিলেন।

হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মাক্কী (রহ.) সারা রাত বিভিন্ন হাফেজদের থেকে পালাক্রমে নামাজে তিলাওয়াত শুনতেন।

হজরত শাহ আবদুর রহিম রায়পুরী (রহ.) হাফেজে কুরআন ছিলেন। প্রায় সারা রাত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। চব্বিশ ঘণ্টায় তিনি শুধু এক ঘণ্টা ঘুমাতেন।

শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি (রহ.) হাফেজ ডেকে নামাজে সারারাত কুরআনুল কারিম শুনতেন। তারাবিতে কখনও ছয় পারা, কখনও দশ পারা পড়া হতো।

শাইখুল ইসলাম হজরত হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) বাদ আসর দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষক হাফেজ মাওলানা আব্দুল জলিল (রহ.) এর সঙ্গে শোয়া পারা দাওর করতেন, অর্থাৎ পরষ্পর শোনাতেন।

শাইখুল হাদিস হজরত জাকারিয়া (রহ.) এর আব্বা হজরত মাওলানা ইয়াহইয়া কান্দলুভি (রহ.) রমজান মাসে দৈনিক চল্লিশ পারা তিলাওয়াত করতেন।

আল্লাহ পাক আমাদেরকে রহমত বরকত নাজাতের মাসে বেশি বেমি কুরআন তিলাওয়াত করার তাওফিক দান করুন। এ কুরআনকে জীবনে ধারন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ