রিদওয়ান হাসান ।।
মাওলানা আতহার আলী রহ. ছিলেন উপমহাদেশের একজন নন্দিত পুরোধা ব্যক্তিত্ব। রাজনীতি, সমাজসেবা, মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা থেকে নিয়ে ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিলেন একজন একনিষ্ঠ বুজুর্গব্যক্তি। তেমনি পাক-ভারতবর্ষে ইসলামি আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর অসামান্য অবদান ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। জন্মগতভাবে সিলেটি হলেও গোটাজীবন অতিবাহিত করেছেন বৃহত্তর ময়মনসিংহে।
কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়া এবং শহীদী মসজিদ তার অমর কীর্তি। এছাড়া বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া তাঁর জীবনের আরেক কীর্তিমান অধ্যায়। বিশাল এই জামিয়ার চারদেয়ালের ভেতরেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ইলমে ওহী থেকে শুরু করে সাহিত্য-সাংবাদিকতাসহ সকল ক্ষেত্রেই এই মহান মনীষী ব্যাপক সেবা দিয়ে গেছেন।
শেষ রাতে মহান আল্লাহর দরবারে রোনাজারির পাশাপাশী রাজনৈতিক ময়দানেও তিনি ছিলেন আকাবীরদের এক উজ্বল নমুনা। শুধু মসজিদ-মাদরাসার চার দেয়ালের আঙ্গিনায় নয়, তিনি একজন সফল পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কথা বলে গেছেন।
মহান এই সংগ্রামী পুরুষের যোগ্য উত্তরসুরী হলেন আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ। বলতে খুব কষ্ট হলেও এটাই চিরন্তন সত্য, তিনিও আজ ইহলোকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচ্চমকাম দান করুন।
আল্লামা আনওয়ার শাহ রহ. ছিলেন কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রিন্সিপাল। সেই সাথে বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহসভাপতি এবং কিশোরগঞ্জ শহীদী মসজিদের খতীব। তিনি একজন বরেণ্য সুবক্তা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। তার শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার ভঙ্গি এবং সুরম্য মিনারের মতো কোরআন তেলাওয়াতের সুর আজও কানে ভাসে।
তিনি শত ব্যস্ততা থাকলেও মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতেন। তিনি মুহিউস সুন্নাহ শাহ আবরারুল হক হারদুয়ী রহ. এর খলিফা ছিলেন। এছাড়াও তিনি আরো চার মনীষী থেকে খেলাফত লাভ করেছিলেন যদিও। তবে তিনি দাওয়াতুল হকের নিসবতেই কাজ করতেন বেশি।
তিনি মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় দায়িত্বের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেই সুবাদে ইশকে রাসূলের শরাব পান করে তিনি দেশের আনাচে কানাচে সুন্নতের পয়গাম নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন।
বাবা আতহার আলী রহ. রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব হলেও তিনি কখনো রাজনৈতিক তৎপরতায় জড়াতে পছন্দ করেননি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আনওয়ার শাহ রহ. বলতেন, ‘আমার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, আপনারা জানেন আমার বাবা ছিলেন ইসলামি রাজনীতির কেন্দ্রস্বর এবং এ দেশের আলেমদের রাজনীতির ময়দানে তিনিই নামিয়েছেন। তিনি তার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং দুটি বিশেষ কারণে আমাকে রাজনীতি করতে নিষেধ করেছেন। দুটি কারণের একটি হলো, আমাদের এসময়ের রাজনীতিবিদদের মাঝে সেই ইখলাস বা একনিষ্ঠতা নেই। দ্বিতীয়টি হলো, এ ধরনের রাজনীতিতে নিজের লোকেরাই অনেক সময় গাদ্দারি করে থাকে।’
তবে ইসলামের জন্য সংগ্রামী অবস্থানের প্রয়োজন সামনে এলে তিনি দায়িত্ব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িছিলেন, মোটেই পিছপা হননি। উত্তাপমুখর বহু সময়েই তিনি দলীয় রাজনীতির ব্যানারে না থেকেও শরয়ি আন্দাজে যখন যা বলা ও করা দরকার ছিল, তা তিনি শহীদী মসজিদের খেতাবতে বলে গেছেন। প্রয়োজনে রাস্তায় নেমেও দরকারি ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
সুচারু বাগ্মিতা আর প্রখর ধীসম্পন্ন এই দিশারী আলেম ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ওপর যে কোনো আঘাতের প্রতিবাদে সবার আগে গর্জে উঠতেন। ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙা, আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা, কাশ্মির, ইরাক, বসনিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও উইঘুর ও রোহিঙ্গা মজলুম মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী কথার সাক্ষী শহীদী মসজিদের দেয়াল। তার কথার প্র্রাণাবন্ত জোয়ারে মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেত হারানো চেতনা। এরকম অসংখ্য রাহনুমায়ি কার্যক্রমের সাথে আমরা পরিচিত।
তারই ধারাবাহিকতায় কিশোরগঞ্জের ইমাম-ওলামা পরিষদ নামে একটি সংগঠনের সভাপতি ছিলেন তিনি। ইমামদের মাধ্যমে সমাজের মানুষদের নানা সমস্যা সম্পর্কে সতর্ক করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন তিনি। সম্প্রতি তাবলিগি সংকট ও সমস্যার বিরুদ্ধেও প্রবল নেতৃত্ব এবং সঠিক নির্দেশনা দিয়ে আসছিলেন সেই শুরু থেকেই।
কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির ব্যাপারেও নানা সময়ে তার জোরালো ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও দুরদর্শিতার পরিচায়ক। কিছুদিন আগেও হাইয়াতুল উলইয়ার প্রশ্নফাঁসের সময়ে তার প্রস্তাবনাতেই পরীক্ষার মারকাজগুলোতে ই-মেইলের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পাঠানো এবং সেখান থেকে প্রিন্ট দিয়ে প্রশ্নপত্র বিলি করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
এবং এর কারণে বেফাকের প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে বোর্ডটি সফল হয়। বেফাক ছাড়াও তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের ‘তানযিমুল মাদারিসিল কওমিয়া’ নামে একটি আঞ্চলিক বোর্ডের পরিচালনাতেও বেশ সফলভাবে গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন।
আমরা যা হারালাম তা কখনোই পূরণ হবার নয়। দেশের অন্যতম শীর্ষ আলেমে দীন, দীন-মিল্লাতের অতন্দ্রপ্রহরী, প্রখ্যাত ও শীর্ষ ইসলামী চিন্তাবিদ, আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, ঈমানী আন্দোলনের নন্দিত পুরোধা ব্যক্তিত্ব আল্লামা আযহার আলী আনওয়ার শাহ সাহেব রহ. এর ইন্তেকালে আমি গভীরভাবে শোকাহত। আমার মন ভেঙে গেছে এই খবর শুনে। আমি তাঁর মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার, আত্মীয়,স্বজন, তাঁর ছাত্র এবং শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমাবেদনা জানাচ্ছি।
আসলে আল্লাহর ওলিরা যখন পৃথিবীতে আসে তখন পাখির মতো আসে আর যখন চলে যায় তখন পাখির মতোই চলে যায়। বছর শুরু হতে না হতেই যেন বরেণ্য আলেমদের বিদায়ের সুর উঠে গেছে, আল্লামা আশরাফ আলী রহ. তার কিছুদিন পর আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রহ. এবং এই ধারাবাহিকতায় এবার নিভে গেলো কালের আরেক প্রোজ্জ্বল পিদিম। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচ্চ মকাম দান করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষক , জামিয়া মাদানিয়া দারুল উলুম যাত্রাবাড়ী মাদরাসা, ঢাকা।
আরেএম/