শাইখুল হাদীস মুফতি মনসূরুল হক ।।
১. নামাজের জামাতের সময় ফোন না দেওয়া। কেননা, এতে তার নামাজের একাগ্রতায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে জামাতের নামাজে অন্য মুসল্লিদের নামাজও বিঘ্ন ঘটতে পারে। উপরন্তু যদি মোবাইল সাইলেন্ট করা থাকে, তবে ফোনকারী ব্যক্তি নিজেও পেরেশান হবে যে, কেনো ফোন ধরা হচ্ছে না! (সুনানে তিরমিজী; হা.নং৩৪৬, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক; হা.নং ৩৭২০)
২. একান্ত অপারগতা বা বিপদ-আপদ ব্যতিত স্বাভাবিক অবস্থায় বিশ্রাম/ঘুমের সময় ফোন না দেওয়া। এতে করে অহেতুক মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয়। (বুখারী; হা.নং ১০)
৩. প্রথমবার কল করার পর দ্বিতীয়বার কল করার জন্য এতটুকু সময় বিরতি দেওয়া, যাতে করে কল রিসিভকারী নামাজে, খানায় কিংবা টয়লেটে অথবা এ জাতীয় কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে থাকলে তা সেরে এসে ফোন ধরতে পারে।
কাজেই লাগাতার ফোন দিতে না থাকা। নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রয়োজন সাপেক্ষে সর্বোচ্চ তিনবার ফোন দেওয়া যেতে পারে। এরপরও যদি রিসিভকারী ফোন রিসিভ না করে, তবে আর ফোন দেওয়া উচিত নয়। পরবর্তীতে চেষ্টা করা যেতে পারে।
অনেকে লাগাতার ফোন দিতেই থাকেন আর ফোন রিসিভ না হওয়ায় বিরক্ত হতে থাকেন। অথচ চিন্তা করা উচিত যে, যাকে ফোন দিচ্ছি, আমার প্রয়োজনের চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে সে ব্যস্ত থাকতে পারে। কাজেই এমনটা না করা চাই। (সূরায়ে নূর; আয়াত ২৭, বুখারী; হা.নং ৬২৫০)
৪. ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে আগে আগে সালাম প্রদানে উভয়পক্ষেরই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকা উচিত। অন্যথায় যার আগে কথা বলার সুযোগ হবে, তিনি সালামের মাধ্যমে কথা শুরু করবেন। অনেক সময় রিসিভকারী ‘হ্যালো’ বলে চুপ করে থাকেন, এমনটা ঠিক নয়। (মুসলিম; হা.নং ৯৩, তিরমিজী; হা.নং ২৬৯৯)
৫. বারবার ফোন করার প্রয়োজন হলে প্রতিবারই সালাম দেওয়া উচিত। হাদিস শরিফে নবীজি সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালামের ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন- “কেউ যদি তার মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে তাহলে যেন তাকে সালাম দেয়।
অতঃপর যদি কোনো গাছ বা পাথর (অল্প সময়ের জন্য হলেও) দু’জনের মাঝে আড়াল সৃষ্টি করার পর পুনরায় তাদের সাক্ষাৎ হয় তাহলে যেন আবার সালাম দেয়।” (সুনানে
আবূ দাউদ; হা.নং ৫২০০)
৬. ফোন রিসিভ হওয়ার পর ফোনকারী সর্বপ্রথম নিজের পরিচয় দিবেন। এরপর ফোন রিসিভকারী উদ্দিশ্য ব্যক্তি কি না? এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া চাই। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর ফোনকারী নিজের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করবেন।
অনেকে নিজের পরিচয় না দিয়ে কিংবা রিসিভকারীর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কথা বলা শুরু করেন। এ কারণে অনেক সময় উভয়েরই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। (বুখারী; হা. নং ৬২৫০)
৭. শরী‘আতে গাইরে মাহরাম নারী/পুরুষের সাথে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সঠিক পর্দা রক্ষা করে প্রয়োজন পরিমাণ কথা বলার অবকাশ দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আকর্ষণ সৃষ্টিকারী কোনো আচরণ কিংবা উচ্চারণ সম্পূর্ণ হারাম। কাজেই কোনো গাইরে মাহরাম মহিলা কিংবা পুরুষকে ফোন করতে হলে এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ৩০৪৯, ফতোয়ায়ে শামী; ৬/৩৬৯)
৮. মোবাইলে কথা বলার প্রয়োজনে গাইরে মাহরাম নারী/পুরুষের মাঝে সালামের আদান-প্রদানও বৈধ হবে। তবে যদি ফেতনার আশঙ্কা থাকে, তাহলে এ জাতীয় ‘আন্তরিকতাপূর্ণ সম্ভাষণ’ বৈধ হবে না। (ফতোয়ায়ে শামী; ৬/৩৬৯)
৯. মোবাইলে কথা বলার সময় অনেকেই ‘আপনি এখন কোথায় আছেন’? এ প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যা বলে থাকে। অথচ (ক্ষতির আশংকা না থাকলে) মিথ্যা কথা বলা কবিরাহ গোনাহ! কাজেই এ বিষয়ে সতর্ক থাকা আবশ্যক। (বুখারী; হা.নং ৩৩)
১০. একটি পরামর্শ : মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ যাতে না হয়, এ জন্য অনেক ভাই মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখেন। তাদের জন্য পরামর্শ হলো, প্রয়োজনে মোবাইল বন্ধ করে মিসড কল এলার্ট দিয়ে রাখতে পারেন। এতে করে ফোনকারী অযথা বিরক্ত কিংবা চিন্তিত হয় না যে, কেন ফোন ধরছে না! উপরন্তু জরুরী ফোন হলে রিসিভকারী পুনরায় কলব্যাক করতে পারবে।
১১. অনেক সময় দেখা যায়ে যে, কোনো মুফতী সাহেবের কাছে মাসআলা জানার জন্য ফোন দেওয়া হয়, কিন্তু তার এখন মাসআলা বলার সময় আছে কি না?- তা না জেনেই মাসআলা জিজ্ঞাসা করা শুরু করা হয়, যা খুবই বিরক্তকর।
কাজেই কথা দীর্ঘ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ হলে ফোন রিসিভকারী এখন কথা বলার মত অবস্থায় আছেন কি না?- তা জেনে নেওয়া আবশ্যক। এখন সময় না থাকলে পরবর্তীতে তিনি কখন সময় দিতে পারবেন- তা জেনে নেওয়া চাই। (সূরা নূর; আয়াত ২৭, ফতাওয়ায়ে শামী ৫/৫০৯)
১২. মোবাইলে কথা শেষ হওয়ার পর সালামের আদান-প্রদান শেষ হওয়ার আগেই লাইন কেটে দেওয়া ঠিক নয়। কেননা, সালামের জবাব পারতপক্ষে শুনিয়ে দেওয়া ওয়াজিব। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৫২০৮, ফাতাওয়ায়ে শামী; ৬/৪১৩)
১৩. অনেক দীনদার ভাই মাসআলা জানার উদ্দেশ্যে মুফতী সাহেবানদের কাছে ফোন করে থাকেন। ব্যক্তিগত কিংবা দীনী ব্যস্ততার কারণে তাৎক্ষণিক ফোন রিসিভ করতে না পেরে স্ক্রীনে মিসড কল দেখে যদি মুফতি সাহেব কল ব্যাক করেন, তবে অনেকক্ষেত্রে সেই কল রিসিভ করেই উক্ত ফোনকারী ব্যক্তি তার মাসআলা জিজ্ঞাসা করা শুরু করেন। এটা উচিত নয়।
প্রয়োজন যার, তিনিই পয়সা খরচ করে ফোন করবেন- এটাই সুস্থ নীতি হওয়া উচিত। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ৩৫০৮, আল আশবাহ লি- ইবনে নুজাইম; ১/৩৭৭)
১৪. বাস/ট্রেন কিংবা জনবহুল স্থানে কথা বলার ক্ষেত্রে অনেকে উচ্চ আওয়াজে কথা বলে থাকেন। এমনটা ঠিক নয়। কেননা, এতে অকারণে অন্যের বিরক্তি সৃষ্টি করা হয় অসুস্থ কিংবা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অথবা কোনো পরীক্ষার্থীকে অনর্থক কষ্ট দেওয়া হয়।
কাজেই এ জাতীয় স্থানে নিম্নস্বরে কথা বলা আবশ্যক। উপরন্তু নিচু আওয়াজে কথা বললে নিজের গোপনীয়তাও বজায় থাকে। (সূরা লুকমান; আয়াত ১৯, বুখারী; হা.নং ১০)
১৫. গাড়ির চালক অনেক সময় গাড়ি চালানোর সময় কথা বলে থাকেন। দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকায় এমনিতেই এ ধরণের আচরণ আইনত দ-নীয়। উপরন্তু শরী‘আতের দৃষ্টিতেও তা অবশ্য পরিত্যাজ্য। একান্ত প্রয়োজন হলে গাড়ি থামিয়ে কথা বলা উচিত। (সূরা বাকারা; আয়াত ১৯৫, বুহুস ফি কাযায়া; ১/৩১০)
১৬. ফ্রি-মিনিট পেয়ে অনেকে অনর্থক কথাবার্তা বলতে থাকে। এটা উচিত নয়। কেননা, হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে- مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ
যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং কিয়ামাত দিবসের উপর ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে।
অথবা চুপ থাকে। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ৭৬২৬)
লেখক: প্রধান মুফতি ও শাইখুল হাদীস, জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া, আলী অ্যান্ড নূর রিয়েল এস্টেট, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা।
আরএম/