মাহফুয আহমাদ।।
বাংলাদেশের স্বীকৃত একজন হাদিস বিশারদ ছিলেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জি। হবিগঞ্জের মুহাদ্দিস সাহেব হিসেবে তিনি ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ।
যেসব আলেম ওয়াইজের ওয়াজ সরাসরি কিংবা ক্যাসেট থেকে শুনে শুনে আমাদের শৈশব কেটেছে তাঁদের অন্যতম হলেন আল্লামা হবিগঞ্জি। তাঁর সুমধুর কণ্ঠ, আর কথা বলার অভিনব পদ্ধতি আমাদের আকৃষ্ট করত।
ধীরে ধীরে তাঁর কথাগুলোর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে শুরু করি। বস্তুত মুহাদ্দিস সাহেবের বয়ানে যেমন ছিলো সাধারণ মানুষের জন্য নসিহত, তেমনি আলিম ও তালিবুলইলম সমাজের জন্য ছিলো ইলমি খাজানা। বিভিন্ন ইস্যুতে হযরত দেশ ও জাতি নিয়েও তেজস্বী বক্তব্য দিয়ে থাকতেন। সেসব শুনে মানুষের ঈমানি চেতনা উজ্জীবিত হত।
হাফিযে কোরআন হওয়ায় সময় ও বিষয় উপযোগী আয়াত নির্বাচন করতেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। বয়ানে থাকত প্রচুর হাদিসের বর্ণনা। আকাবিরে দেওবন্দের প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ ভক্তি ও অকৃত্রিম ভালোবাসা। সেজন্য প্রায় সকল বয়ানেই আকাবিরের জীবনী থেকে কিছু অংশ আলোচনা করে সেটা থেকে শিক্ষার উপকরণ কী- তাও বলে দিতেন। আর হাদিসের দারস হলে তো কথাই নেই; সেখানে ইলমে হাদিস সংক্রান্ত কত দুর্লভ তথ্য পেশ করতেন তার হিসাব কে রাখে। সেসময় তাঁর মুখ থেকে যেন অবিরত মণিমুক্তা ঝরতে থাকত।
এই বান্দা হযরত মুহাদ্দিসে হবিগঞ্জি রাহিমাহুল্লাহকে একাধিকবার দেখার সুযোগ হয়েছে। আঙ্গুরায়, আলিয়া মাঠে কিংবা ভিন্ন কোনো মাহফিলে। তবে দেশে থাকতে কখনো কাছে যাওয়া হয়নি। লন্ডন আসার পর দুইবার হযরতের কিছুটা সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। সেই দুটো স্মৃতি তখনই নোট করে রেখেছিলাম। এখানে তা পেশ করা হলো:
এক. ২০১৬ সনের ২৮ আগস্ট লন্ডন জমিয়তের উদ্যোগে একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জি। তাঁর আগে অধম বান্দাকে "অমুসলিমদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন হওয়া চাই" বিষয়ে আলোচনা করতে বলা হয়। আর সেটাই ছিলো হবিগঞ্জি হুজুরের পাশে বসে অধমের প্রথম আলোচনা। কথা শেষ হলে হযরত কানেকানে "মাশাআল্লাহ" বলে স্বভাবজাত উপায়ে অধমকে উৎসাহিত করেন। বস্তুত বড়দের উৎসাহ ছোটদের অনুপ্রাণিত করে, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়।
দুই. ১৯ জুন ২০১৯ এর কথা। ওইদিন দুপুরে জামিয়া দারুস সুন্নাহ লন্ডনে তাশরিফ এনেছিলেন শায়খুল হাদিস মাওলানা তাফাজ্জুল হক সাহেব হবিগঞ্জি। বাংলাদেশের বয়োবৃদ্ধ এই প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস সেদিন আমাদেরকে হাদিসের বিশেষ দারস প্রদান করেন। সহিহ বোখারির প্রথম হাদিসটি পাঠ করত তিনি সারগর্ভ আলোচনা পেশ করেন। হাদিস সংকলনে মুহাদ্দিসগণের বিবিধ মানহাজ বা পদ্ধতির ব্যাখ্যা দিলেন। প্রসঙ্গত তিনি দূর অতীত এবং নিকট অতীতের একাধিক মনীষীর উদ্ধৃতি টানলেন, স্মৃতিচারণ করলেন।
পরিশেষে উপস্থিত আহলে ইলমকে তিনি নিজ সনদের ইজাযতও প্রদান করলেন। বস্তুত শায়খে হবিগঞ্জি হাফিযাহুল্লাহ পুরো সহিহ বোখারি দুই মাদরাসায় দুবার পড়েছেন। বাংলাদেশের হাটহাজারি মাদরাসায় শায়খ আবদুল কাইয়্যুম রাহিমাহুল্লাহ এর নিকট এবং পাকিস্তানের লাহোরে আল্লামা ইদরিস কান্ধলবি রাহিমাহুল্লাহ এর নিকট। তাছাড়া কিছু অংশ পাঠ করে সনদ লাভ করেছেন আল্লামা সায়্যিদ ইউসুফ বিন্নুরি (বানুরি), শায়খুল হাদিস যাকারিয়্যা, আল্লামা ইবরাহিম বিলয়াওয়ি, আল্লামা ফখরুদ্দিন আহমদ রাহিমাহুমুল্লাহ এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের কাছ থেকে।
দোয়া করি, আল্লাহ তায়ালা হযরত হবিগঞ্জিকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। পরিবারপরিজন এবং ভক্ত ও শিষ্যদেরকে সবরে জামিলের তাওফিক দান করুন। তাঁর মৃত্যুতে ইলমি অঙ্গনে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, আল্লাহ যেন তা পূরণ করে দেন। আমীন।- লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া।
আরএম/