মুফতি মনসুরুল হক ।।
আমাদের সমাজে ইসলামি দিবসের শিরোনামে ‘আখেরী চাহার শোম্বা’ নামে একটি দিবস পালিত হয়ে থাকে। এক শ্রেণির ভাইয়েরা অজ্ঞতাবশত এ দিবসকে ইসলামি দিবস মনে করে একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আমলও করে থাকেন।
এ দিবস এবং দিবস সংক্রান্ত আমলগুলো ‘মুকসূদুল মুমিনীন’ কিংবা এ জাতীয় শিরোনামের কিছু ইসলামি বই-পুস্তকে পাওয়া যায়। অথচ এ গ্রন্থগুলো নির্ভরযোগ্যতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ তো নয়ই; বরং এগুলো মূলত মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যবসার পণ্য মাত্র!
পরিতাপের বিষয় হলো- এ সকল অনির্ভরযোগ্য গ্রন্থ এবং অজ্ঞ ও মূর্খ লোকদের প্রচলনকে ভিত্তি করে আমাদের দেশের অনেক জাতীয় দৈনিকেও এ দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লেখা ছাপা হয় এবং মানুষকে এ দিবসের পবিত্রতা সম্পর্কে জানানো হয়। অথচ শরীআতের মানদন্ডে এ দিবসের যেমন কোনো ভিত্তি নেই, তেমনি এ দিবসের আমলেরও কোনো ভিত্তি নেই।
‘আখেরী চাহার শোম্বা’ কী?
‘আখেরী চাহার শোম্বা’ অর্থ হলো ‘শেষ বুধবার’। উদ্দেশ্য হলো আরবী বৎসরের দ্বিতীয় মাস তথা ‘সফর মাসের শেষ বুধবার’। অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনা এবং দিবসপালনকারীদের প্রচলিত আকীদামতে এ দিবস পালনের প্রেক্ষাপট হলো –
‘‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক ইয়াহুদী জাদু করেছিলো। ফলে নবীজী অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যদ্দরুন নবীজী মসজিদে যেতে পারেননি। সফর মাসের শেষ বুধবার নবীজী গোসল করেন এবং সুস্থ হয়ে মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করেন। এ গোসলই নবীজীর জীবনের শেষ গোসল। নবীজীর সুস্থতার প্রেক্ষিতে সাহাবায়ে কেরাম খুশি হয়ে এ দিন রোযা রেখেছিলেন এবং নফল নামায আদায় করেছিলেন। কাজেই উম্মাতের জন্যও এ দিন গোসল করে রোযা রেখে নফল নামায পড়ে আনন্দ প্রকাশ করা আবশ্যক!!”
এ আকীদা ও বিশ্বাসকে ধারণ করে আমাদের সমাজের এক শ্রেণির ভাইয়েরা অজ্ঞতাবশত আরবী সফর মাসের শেষ বুধবারকে ইসলামি দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন। এমনকি এ দিন সরকারী ছুটির ঘোষণা করা হয়!
শরীয়াতের দৃষ্টিতে ‘আখেরী চাহার শোম্বা’
শরীআতের দৃষ্টিতে এ দিবস, দিবস পালনের প্রেক্ষাপট এবং এ দিবসে বর্ণিত কোনো আমলই নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত নয়। বরং তা একটি গর্হিত বিদআত এবং অবশ্য পরিত্যাজ্য বিষয়।
এ দিবসের অনির্ভরযোগ্যতার কারণগুলো নিম্নরূপ-
১. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক ইয়াহুদী জাদু করেছিলো- এ কথা ঠিক। তবে গোসলের মাধ্যমে সুস্থতার তারিখ হিসেবে সফর মাসের শেষ বুধবার কথাটি সঠিক নয়। বরং দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার। হাফেয ইবনে হাজার রহ. এবং হাফেয ইবনে কাসীর রহ. এ দিনটি বৃহস্পতিবার ছিলো বলেই উল্লেখ করেছেন। (ফাতহুল বারী; ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাযী ৪৪৪২, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৪/১৯৩,)
২. দ্বিতীয়ত, এ গোসলের পর নবীজী আর গোসল করেননি- এ কথাও ঠিক নয়। কেননা, সহীহ হাদীস সমূহে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, নবীজী এরপর ইশার নামাযের আগে এক রাতে গোসল করেছিলেন। (সহীহ মুসলিম; হাদীস নং ৪১৮, সহীহ বুখারী; হাদীস নং ৬৮১)
৩. তৃতীয়ত, সাহাবায়ে কেরাম খুশি হয়ে এ দিন রোযা রেখেছিলেন এবং নফল নামায আদায় করেছিলেন- এ কথাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন! এ জাতীয় কোনো বর্ণনা হাদীসের কোনো কিতাবেই উল্লেখ নেই।
৪. চতুর্থত, কোনো বিশেষ দিনকে ধর্মীয় দিবস মনে করা এবং তাতে বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগী করার জন্য শরীআতের সুনির্দিষ্ট দলীল-প্রমাণ আবশ্যক। অথচ কুরআনে কারীম কিংবা হাদীসে পাকে এ দিবসের উল্লেখ থাকা তো দূরের কথা, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনদের যুগ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ তিন যুগেও এ দিবস পালনের কোনো রেওয়াজ পাওয়া যায় না।
৫. দাওয়াতের নববী দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে গিয়ে নবীজী কাফেরদের পক্ষ হতে অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে সে সকল কষ্ট থেকে নাজাতও দিয়েছেন। এ ছাড়া মহান আল্লাহ তাকে অনেক নেয়ামতও দান করেছেন।
নবীজীর এ কষ্ট থেকে মুক্তিপ্রাপ্তি কিংবা কোনো নেয়ামত লাভ করা নিঃসন্দেহে উম্মাতের জন্য আনন্দ ও খুশির বিষয়। কিন্তু এ খুশির দিনকে ইসলামি দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে- মর্মে সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতে এর কোনো উল্লেখ নেই!
সারকথা, ‘আখেরী চাহার শোম্বা’ দিবসের প্রেক্ষাপট হিসেবে বর্ণিত কারণগুলো যেমন ভিত্তিহীন, তেমনি এ দিবসকে ইসলামি দিবস মনে করাও প্রমানবিহীন! কাজেই বিশেষ কোনো আমলকে এ দিবসের আমল করারও কোনো সুযোগ নেই।
সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনগণ ‘রাসূল আনুগত্যের’ যে পথনির্দেশ রেখে গিয়েছেন- উম্মাতের হিদায়াত ও জান্নাতপ্রাপ্তির জন্য তাই যথেষ্ট। এ জাতীয় মনগড়া দিবসের বিদআতে লিপ্ত হওয়া এবং তাতে নির্ধারিত ইবাদত বন্দেগীকে দিবসকেন্দ্রিক মনে করা মারাত্মক গোনাহের কাজ। কাজেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ ভিত্তিহীন দিবসের যৌক্তিকতা বয়ান করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি এ দিবসকে কেন্দ্র করে সরকারী ছুটি ঘোষনা করারও কোনো যৌক্তিকতা নেই।
আল্লাহ তাআল আমাদেরকে এ গর্হিত বিদআত থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।
লেখক :
আরএম/