জুবায়ের রশীদ
তরুণ আলেম ও লেখক
'শবে বরাত' একটি বরকতময় রজনী। বিভিন্ন হাদীস দ্বারা এ রাতের ফজীলত বর্ণিত রয়েছে। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতে অধিক পরিমাণে ইবাদত করতেন। এ রাতে নির্দিষ্ট কোন ইবাদত যদিও নেই কিন্তু রাসুলের আমল দ্বারা বিশেষ কিছু ইবাদত প্রমাণিত হয় যা তিনি করেছেন। সেসবের মধ্য থেকে পাঁচটি মর্যাদাপূর্ণ আমল নিম্নে আলোকপাত করা হলো।
১.দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া: শাবান মাসের ১৫ তম রাত তথা শবে বরাতে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক পরিমাণে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়তেন। যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, এক রাতে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুম থেকে ওঠে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সেই নামাজে এতো দীর্ঘ সময় তিনি সিজদাবনত ছিলেন যে, আমার সন্দেহ হচ্ছিল তিনি ইন্তেকাল করেছেন কিনা। আমি উঠে গিয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। আঙুলটি নড়ে উঠল। আমি নিশ্চিত হলাম যে তিনি বেঁচে আছেন। অতঃপর আমি আপন স্থানে ফিরে এলাম।
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদা থেকে মাথা উঠালেন এবং নামাজ শেষ করে এক পর্যায়ে বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি ভেবেছ যে, আল্লাহর নবী তোমার উপর কোন অবিচার করেছে?
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি এমন কিছুই ভাবিনি। আমি বরং আপনাকে দীর্ঘ সময় সিজদায় দেখে ভয় পাচ্ছিলাম যে, আপনাকে আল্লাহ পাক উঠিয়ে নিলেন কিনা!
অতঃপর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি জান আজকের এ রাতটি কোন রাত?
আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ রাতটি শাবানের পঞ্চদশ রজনী। এতে মহান প্রভু তার বান্দাদের উপর বিশেষ দৃষ্টি দেন।
ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করে দেন। রহমতপ্রার্থীদের রহমত দান করেন। অপরদিকে পরশ্রীকাতর ব্যক্তিদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেন। ( শোয়াবুল ঈমান, খন্ড, ৩ পৃষ্ঠা, ৩৮২- ৩৮৩ হাদীস নং, ৩৮৩৫। জমউল জাওয়ামী, খন্ড, ১ পৃষ্ঠা, ১৮৫। আততারগীব, খন্ড, ২ পৃষ্ঠা, ২৪২)
২. সালাতুত তাসবীহ: সালাতুত তাসবীহ একটি স্বতন্ত্র আমল। শবে বরাতের সাথে সম্পর্কিত কোন আমল নয়। তবে মানুষ যেহেতু এ রাতে বেশি বেশি ইবাদতে নিয়োজিত থাকে। অধিক পরিমাণে নফল নামাজ পড়ে।তাই সালাতুত তাসবীহকে কেউ এ রাতের বিশেষ ইবাদত মনে না করে আদায় করতে পারে।
হাদীসে এর বিশেষ ফজীলত বর্ণিত রয়েছে। জীবনে অন্তত একবার হলেও এ নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ নামাজ আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। মসজিদের ইমাম বা কোন আলেমের নিকট থেকে জেনে এই রাতে উক্ত আমল করা যেতে পারে।
৩. পরেরদিন রোজা রাখা: হযরত আলী রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন শাবান মাসের ১৫ তম রাত তোমাদের সম্মুখে এসে যায় তখন তোমরা সে রাতে নামাজ পড় এবং পরবর্তী দিনে রোজা রাখ।
কারণ সেদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বান্দাদের ডেকে বলতে থাকেন, আছ কি কোন ক্ষমাপ্রার্থী যাকে আমি ক্ষমা করে দেব? আছ কি কোন রিজিকপ্রার্থী যাকে আমি রিজিকের ব্যবস্থা করে দেব? আছ কি কোন বিপদগ্রস্ত যাকে আমি বিপদ থেকে মুক্ত করে দেব?
এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতেই থাকেন, আছ কি কেউ অমুক বস্তুর প্রার্থী, আমি যার সকল মনোবাসনা পূর্ণ করে দেব? ( ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৮৪। শোয়াবুল ঈমান, খন্ড ৩ হাদীস নং, ৩৮২২-৩৮২৩)
উল্লিখিত হাদীস দ্বারা দুটি আমল প্রমাণিত হয়, এক, শবে বরাতে নফল নামাজ আদায় করা। দুই, পরবর্তী দিনে রোজা রাখা। তাই এ দুটি আমল করা চাই।
৪. বেশি বেশি দুয়া করা: এই রাতে দুয়া কবুল হয়। তাই বেশি বেশি দুয়া করা। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, পাঁচটি রাত এমন আছে, যাতে বান্দার কোন দুয়া ফেরত দেয়া হয় না। এক, জুমার রাত। দুই, রজব মাসের প্রথম রাত। তিন, শাবান মাসের মধ্যরাত (শবে বরাত)। চার ও পাঁচ, দুই ঈদের রাত। ( মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং, ৭৯২৭)
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, আমাদের কাছে পৌঁছেছে যে, পাঁচটি রাতে দুয়া বেশি বেশি কবুল করা হয়। এক, জুমার রাত। দুই, ঈদুল আযহার রাত। তিন, ঈদুল ফিতরের রাত। চার, রজব মাসের প্রথম রাত। পাঁচ, শাবান মাসের ১৫ তম রাত তথা শবে বরাত। ( কিতাবুল উম্ম, খন্ড, ১ পৃষ্ঠা, ২৩১। আস সুনানুল কুবরা, খন্ড, ৩ পৃষ্ঠা, ৩১৯।
৫. বেশি বেশি তওবা ও ইস্তেগফার করা: হযরত উসমান ইবনে আবিল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, শাবান মাসের ১৫ তম রাতে আল্লাহ তায়ালা এই বলে ডাকতে থাকেন, তোমাদের মাঝে কেউ আছে কি কোন ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করে দিব? আছে কি তোমাদের মাঝে কিছু চাইবার মতো কেউ, আমি তার সকল চাহিদা পুরণ করে দিব?
অতঃপর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এভাবে সকল প্রার্থনাকারীর সকল প্রকার বৈধ মনোবাঞ্ছা পুরণ করা হয়। কিন্তু ব্যভিচারী ও মুশরিকদের প্রার্থনা কবুল করা হয় না। ( শোয়াবুল ঈমান, খন্ড, ৩ পৃষ্ঠা, ৩৮৩ হাদীস নং, ৩৮৩৬। আদ দুররুল মানসুর, খন্ড, ৬ পৃষ্ঠা, ২৭।
আরএম/