রোকন হারুন: আয়েশা লেমু জন্ম গ্রহণ করেন ব্রিডজেট আয়েশা হানির ঘরে। তিনি এঞ্জেলিক খ্রিস্টান হিসেবে বেড়ে উঠেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে একজন নাইজেরিয়ান শেখের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরে তিনি একজন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হয়ে ওঠেন। সেই সাথে নারী শিক্ষার জন্য ‘Federation of Muslim Women Associations in Nigeria (Fomwan)’ নামের সংগঠনও গঠন করেন।
আয়েশা লেমু ২০০২ সালে দেয়া এক বক্তৃতায় স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসের ১৪ তারিখে আমার জন্ম। আমি চার্চ অব ইংল্যান্ডের সহচার্যে বড় হই কিন্তু কখনও চার্চের শিক্ষাকে বিশ্বাস করতে পারতাম না।
আমি সর্বদা সত্যকে খুঁজে বেড়াতাম। ভেতর থেকে সত্যের জন্য এক ধরনের টান অনুভব করতাম। সত্যের সন্ধান করতে ১৪ বছর বয়সে বৌদ্ধধর্ম অতপর হিন্দু ধর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করি। ২০ বছর বয়সে কিছুটা আধ্যাত্মিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি। সেসময় আমার মনে হত আমি কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না, এমনকি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কেও আমি অবিশ্বাস করতে শুরু করি।
এর বেশ কিছুদিন পরে কয়েকজন মুসলিম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। মুসলিম বন্ধুদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে আমার ভুল ধারণাসমূহ দূর করার জন্য পবিত্র কুরআনের একটি অনুদিত কপি সংগ্রহ করি।
আয়েশা লেমু বলেন, আমি ইসলাম সম্পর্কে খুব কমই জানতাম এবং ইসলামকে গ্রহণযোগ্য ধর্ম হিসেবে মূল্যায়ন করতাম না। কারণ, ইসলাম সম্পর্কে খ্রিস্টান ধর্মের চেয়েও নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতাম।
এরপর যখন থেকে পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন শুরু করি তখন মনে হচ্ছিল আমি সত্য খুঁজে পাচ্ছি। এ গ্রন্থ শুধুমাত্র ১৪শত বৎসর পূর্বের কোনও মরুবাসীদেরকে সম্বোধন করে লেখা কোনও গ্রন্থ নয় বরং এই বিশ শতকের আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি গ্রন্থ।
তার কয়েক সপ্তাহ পর আয়েশা লেমু লন্ডনের রিজেন্ট’স পার্ক মসজিদে সফর করেন এবং সেখানেক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি লন্ডনের ‘SOAS’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Islamic Society’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন এবং সংগঠনটির প্রথম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
‘SOAS’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করার পরে তিনি ইংরেজি শিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ কাজের সময় শেখ আহমেদ লেমুর সাথে পরিচয় ঘটে।
১৯৬৬ সালে আয়েশা লেমু নাইজেরিয়ার কানো নামক স্থানে বসবাস করতে চলে আসেন এবং সেখানকার একটি স্থানীয় বিদ্যালয়ে পাঠ দান শুরু করেন। তার স্বামী শেখ আহমেদ লেমু বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
১৯৭৬ সালে স্বামী শেখ আহমেদ লেমুর সাথে নব গঠিত নাইজেরিয়া রাজ্যে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানকার মিন্না শহরের ‘Women Teachers' College’ এ শিক্ষকতায় যোগ দেন। আর স্বামী নাইজেরিয়ার শরিয়া আদালতের আপীল বিভাগের প্রধান বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন।
আয়েশা লেমু যখন নাইজেরিয়ায় প্রথম এসেছিলেন তখন তিনি সেখানকার বিদ্যালয়সমূহে ইসলাম সম্পর্কে দেয়া শিক্ষা পদ্ধতি দেখে হতবম্ব হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, সেখানে শুধুমাত্র কিভাবে প্রার্থনা করতে হবে, কিভাবে উপবাস থাকতে হবে ইত্যাদি শেখানো হত। কিন্তু কেউই শিক্ষার্থীদের এ কথা বলতো না যে, কেন তারা প্রার্থণা করবে বা উপবাস থাকবে এমনকি কেনই বা তারা ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস করবে?
১৯৬৯ সালে আয়েশা লেমু এবং তার স্বামী যৌথভাবে ‘Islamic Education Trust (IET) নামে একটি দাতব্য সংস্থা গড়ে তুলেন যার মাধ্যমে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া শুরু হয় ।
১৯৭৮ সালে তিনি সংস্থাটির পরিচালক নিযুক্ত হন। একই সাথে তিনি নাইজেরিয়ার বিদ্যালয় সমূহের জন্য ইসলামিক নীতিমালা গঠন বিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৫ সালে আয়েশা লেমু নাইজেরিয়ার মুসলিম নারীদের মতামতকে আরো জোরালো করার জন্য ‘Fomwan’ নামের সংগঠন গড়ে তুলেন এবং সংগঠনটির প্রথম জাতীয় নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন।
সংগঠনটির শুরু থেকে আজ অবধি নাইজেরিয়ার মুসলিম নারীদের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানে কাজ করে চলেছে।
আয়েশা লেমু অন্তত ৩০টি বই লিখেছেন যার বেশির ভাগই জুনিয়র ইসলামিক অধ্যয়নমূলক বই। এ বইগুলো নাইজেরিয়ার বিদ্যালয়সমূহে পাঠদান করানো হয়। ২০০০ সালে তিনি ‘Order of Nigeria’ এর সম্মানিত সদস্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি এই মহীয়সী নারী পরলোক গমন করেন।
-আরএইচ