তাওহীদ আদনান
ইন্ডিয়া থেকে
উপমহাদেশে শ্রেষ্ঠ দীনি বিদ্যাপিঠ উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম দেওবন্দ আজ থেকে প্রায় দুই বৎসর পূর্বে ২০১৬ এর ৫ ডিসেম্বর মাওলানা সাদ কান্ধলবীর ব্যাপারে একটি ফতোয়া প্রকাশ করেছিল৷ ফতোয়াটি ছিলো মাওলানা সাদ কান্ধলবীর কিছু ভ্রান্ত কথা ও আক্বীদা সম্পর্কে৷
ফতোয়াতে বলা হয়েছিল, তাবলিগি জামাত একটি মুবারক জামাত৷ যা জুমহুরে উম্মত ও আকাবিরদের অনুসৃত পথ-পদ্ধতি থেকে সরে গিয়ে সংরক্ষিত থাকতে পারবে না৷
আম্বিয়া আলাইহিস সালামদের শানে বেয়াদবি, চিন্তার পদস্খলন, তাফসির বিররায়, আহাদিস ও আসারে’র মনগড়া ব্যাখ্যার সাথে হকপন্থী উলামায়ে কেরাম কোনোভাবেই একমত হতে পারেন না এবং এ বিষয়ে তারা চুপও থাকতে পারেন না৷
কেননা, ওই ধরনের ধ্যান-ধারণা পরবর্তীতে একটি ভিন্ন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করে পুরো জামাতকে হক ও সত্য থেকে দূরে ঠেলে দেবে৷ এ জন্য সার্বিক বিবেচনায় উম্মতে মুসলিমা বিশেষত তাবলিগি বন্ধুদের এ বিষয়টি জানানো আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করি যে, মাওলানা সা’দ নিজের স্বল্প জ্ঞানের ফলে জমহুর আকাবিরে উম্মতের পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন৷ যা স্পষ্ট পথভ্রষ্টতা৷
জানা যায়, ২০১৬ এর ৫ ডিসেম্বরের সেই ফতোয়াটি প্রকাশের আগে এবং পরে বহুবার চিঠি মারফত ও দূত মারফত মাওলানা সাদ কান্ধলবীকে তার প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড ও কথা-বার্তা থেকে রুজু করার আবেদন জানানো হয়েছিল দেওবন্দ থেকে৷ কিন্তু আজ অবধি সেই আবেদনের সন্তোষজনক কোনো উত্তর আসেনি মাওলানা সাদের পক্ষ থেকে৷
দেওবন্দ থেকে উক্ত ফতোয়া প্রকাশের পর থেকে আজ পর্যন্ত দুই দুটি বছর কেটে গেলেও এখনো পর্যন্ত দেওবন্দের সাথে সুরাহা হয়নি মাওলানা সাদ ও তাবলীগ ইস্যুর৷ উপরন্তু মাওলানা সাদ দেওবন্দের শর্ত মেনে রুজু না করায় আজ সর্বত্র তাবলীগ দুই দলে বিভক্ত৷ যা নিয়ে প্রায়শই চলছে হানাহানি৷
বর্তমান সময়ে তাবলীগ ইস্যুতে দেওবন্দের অবস্থান
বর্তমান সময়ে তাবলীগ ইস্যুতে দেওবন্দের অবস্থান কী তা জানতে মাদরাসা কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, দেওবন্দের অবস্থান স্বরূপ গত ৭ মে দেওবন্দের পক্ষ থেকে তাবলীগ বিষয়ে সর্বশেষ একটি এলান প্রকাশ করা হয়েছে৷ ওটাই দেওবন্দের বর্তমান অবস্থান৷
এরপর প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যায় গত ৭ মে ২০১৮ ইং তারিখের একটি এলান রয়েছে সেখানে৷ এলানটিতে দারুল উলুম দেওবন্দ পরিপূর্ণভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে মাওলানা সাদ ইস্যু ও তাবলীগ ইস্যুতে৷
৭ মে-এর প্রকাশিত সেই এলানে বলা হয়, প্রায় এক সপ্তাহ যাবত নতুন করে আবার একটি কথা মিডিয়ায় খুব প্রচারিত হচ্ছে যে দারুল উলুম দেওবন্দ সা’দ কান্ধলভীর রুজুনামা গ্রহণ করে নিয়েছে৷
নতুনভাবে এই খবর প্রচারের পর থেকে অনেকেই মতানৈক্য ও সন্দেহে পতিত হচ্ছে যে দারুল উলুম দেওবন্দ তার অবস্থান থেকে সরে গেছে৷ তাই দারুল উলুম দেওবন্দ পুনরায় তার অবস্থান স্পষ্ট করাকে জরুরি মনে করে৷
দারুল উলুম দেওবন্দ এই ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচারের দরুণ এর জবাব স্বরূপ এলানে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, দারুল উলুম দেওবন্দের সম্মানিত আসাতিযা ও মুফতিয়ানে কেরাম এখনো পূর্বের অবস্থানেই কায়েম রয়েছে৷ না তা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, না সা’দ কান্ধলভীর রুজুনামা গ্রহণ করেছে৷
সাথে সাথে দারুল উলুম দেওবন্দ উক্ত এলানে বলেছে, তাবলীগ জামাতের সাথে দারুল উলুম দেওবন্দের না পূর্বে কোনো শত্রুতা বা বিরোধ ছিল, না বর্তমানে আছে৷
এলানে আরো বলা হয়, তাবলীগ জামাতের অন্তর্গত কলহের ব্যাপারে দারুল উলুম দেওবন্দ আজও নিজ অবস্থানে অটল৷ তাবলীগের দুই গ্রুপে দ্বন্দ্ব এটা তাবলীগ জামাতের ভেতরগত বিষয়৷ এর সাথে দেওবন্দের কোনো সম্পৃক্ততা নেই৷
এলানের শেষে দোয়া স্বরূপ লেখা রয়েছে, আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে কথা ও কাজের পদস্খলন থেকে হেফাজত করুন এবং আমাদের সকলকে সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর অটল রাখুন৷
বিবৃতিতে সাক্ষর করেছেন, আল্লামা আবুল কাসেম নুমানি (মুহতামিম), মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি, মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরি, মাওলানা নিয়ামতুল্লাহ আজমি, মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমি, মাওলানা নূর আলম খলিল আমিনি, মাওলানা আবদুল খালেক সাম্ভুলি, মাওলানা জামিল আহমদ, মাওলানা যাইনুল ইসলাম কাসেমি, মাওলানা আমিন পালনপুরি ও মাওলানা কারি মুহাম্মদ উসমান প্রমুখ।
তাবলীগ ইস্যুতে সাহরানপুরের অবস্থান
বর্তমান সময়ে মাযাহেরে উলুম সাহরানপুরের অবস্থান কী তা জানতে যোগাযগ করা হয় সাহরানপুরে৷ যোগাযোগের ভিত্তিতে জানা যায় উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে তাবলীগ ইস্যুতে তাদের অবস্থান স্বরূপ তাবলীগ ইস্যুতে সর্বশেষ একটি এলান মাদরাসা কতৃপক্ষ গত জুলাই মাসের ২৮ তারিখেই প্রকাশ করেছে৷ ওটাই সাহরানপুরের সর্বশেষ এবং বর্তমান অবস্থান৷
অনুসন্ধানের পরে সানরানপুরের প্রদত্ত সেই এলানটি পাওয়া গেলে সেটি পড়ে বুঝা যায় গত জুলাই মাসের ২৮ তারিখ সাহরানপুর মাদরাসার মজলিসে শুরার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সেই বৈঠকেই তাবলীগের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন মাদরাসা কতৃপক্ষগণ৷
সেদিনের সেই মজলিসে শুরার আলোচনায় নিজামুদ্দীনের বিষয়টি দেওবন্দের সাথে অমিমাংসিত থেকে যাওয়ার দরুন বিষয়টিকে ফেতনার আশঙ্কা হিসেবে উল্লেখ করেই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন মজলিসে শুরার সদস্যগণ৷
শুরা বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তটি হলো, মাযাহিরে উলুমের ভেতরে দাওয়াত ও তাবলীগ কেবল মাওলানা মুহাম্মদ ইলয়াস রহ., মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ রহ. ও মাওলানা মুহাম্মদ এনআমুল হাসান রহ. এর মানহাজ ও পদ্ধতি অনুসারেই পরিচালিত হবে।
উল্লেখিত আকাবিরদের পদ্ধতির বাইরে ভিন্ন কোনো পদ্ধতি অনুসারে কোনো তাবলীগ চলবে না সাহরানপুরে৷
তাবলীগ জামাতের উল্লেখিত আকাবিরদের মানহাজ ও পদ্ধতিতে সাহরানপুরে তাবলীগ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন শায়েখ জাকারিয়া রহ. জামাতা ও সাহরানপুর মাদরাসার শাইখুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মদ আকিলব, মাদরাসার মহাপরিচালক মাওলানা মুহাম্মদ সালমান এবং শায়েখ জাকারিয়া রহ. এর নাতি ও মাদরাসার জেনারেল সেক্রেটারি মাওলানা মুহাম্মদ শাহেদ৷
এ তিন উস্তাদের নেগরানীতেই সাহরানপুরে আকাবিরদের পদ্ধতিতে তাবলীগের কাজ পরিচালিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে৷ এর বাইরে অন্য কারো কথায় বা কাজে তাবলীগ পরিচালিত হবে না৷
উল্লেখ্য, মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান হলেন মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর শ্বশুর। যার তত্ত্বাবধানে দেওবন্দ থেকে সর্বপ্রথম ফতোয়া প্রকাশের পর সাদ কান্ধলভীর আপত্তিকর বয়ানের পক্ষে ও দেওবন্দের ওয়াজাহাতনামার বিপক্ষে পুস্তিকা রচিত হয়েছিল৷
যেই পুস্তিকার খণ্ডন অবশ্য পরবর্তীতে দেওবন্দসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও করা হয়েছিলো৷
সাহরানপুরে মজলিসে শুরার বৈঠকে সেদিন উপস্থিত ছিলেন, হারদূই হযরতের খলিফা আলহাজ্ব হাকীম কালীমুল্লাহ, ইসলামী ফিকাহ একাডেমি আবুধাবির সদস্য মাওলানা ত্বকীউদ্দিন নদভী মাযাহেরী, সাহরানপুর মাদরাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ আকিল, জামিয়া আকালকুয়া মুম্বাইয়ের প্রিন্সিপাল মাওলানা গোলাম মুহাম্মদ বাস্তানভী, মাওলানা মুফতি মাসুম রায়চুটি, মাওলানা মুফতী সাবীল আহমদ, মাওলানা মুহাম্মদ আরিফ বারাহেমী, গোলাম রাফে জামাল শেরওয়ানী, শায়খ ইবরাহীম গুজরাটি, মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ শাহেদ সাহারানপুরী ও মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান, মহাপরিচালক সাহরানপুর।
উল্লেখ্য, বৈঠক শেষে মজলিসে শুরার পক্ষ থেকে মাদরাসার লেটার পেডে উক্ত নোটিশটি জারি করা হয়েছিস৷ নোটিশের নিচে মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর শ্বশুর ও সাহরানপুর মাদরাসার মহাপরিচালক মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান-এর সাক্ষর রয়েছে৷
মাওলানা সা’দ সম্পর্কে দেওবন্দের বিশেষ ফতোয়া
সেই বৈঠকে সম্মিলিতভাবে বেশকিছু প্রস্তাব গৃহিত হয়। সেগুলো হলো, এখন (মাযাহিরে উলুমের ভিতরে) শুধু ফাযায়েলে আমল পড়া হবে।
মারকায ও শুরার সিদ্ধান্ত থেকে সরে মাযাহিরে উলুমের ভেতরে দাওয়াতের মেহনত হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলয়াস রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ রহ. ও হযরত মাওলানা মুহাম্মদ এনআমুল হাসান রহ. এর মানহাজ ও পদ্ধতি অনুসারে পরিচালিত হবে।
মাওলানা মুহাম্মদ আকেল, মাওলানা মুহাম্মদ সালমান ও (মাওলানা) মুহাম্মদ শাহেদ এর নেগরানিতে মেহনত পরিচালিত হবে।
জানা যায়, বৈঠকে দাওয়াতের মেহনতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের এ সিদ্ধান্তের ওপর পূর্ণ সততার সঙ্গে আমল করার নির্দেশও জারি করা হয়েছিল। এর ব্যতিক্রম না করার মর্মে এলানটি দেয়ালে দেয়ালে টানিয়েও দেয়া হয়েছিল তখন৷
তাবলীগ জামাত একটি দীনি মেহনত, খোদায়ি কাজ। এর মধ্যে কোনো ভ্রান্তি থাকুন, ভুল পথে কাটজটি পরিচালিত হোক তা চান না উলামায়ে কেরাম। আর উলামায়ে কেরামের কাজই হলো ভুল কাজকে শুধরে দেয়া। বিগত কয়েকবছর ধরে তারা এ মেহনতই করছেন।
কিন্তু তাবলীগের একটি অনুসারী সেটি না বুঝে আলেমদেরই ভুল সাব্যস্ত করছে তা একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছে বড় অন্যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ছহিহ বুঝ দান করুন। আমিন।
‘একসঙ্গে রক্তাক্ত জখমের এত রোগী কখনো দেখিনি’
আরআর