কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
আলেম, লেখক ও শিক্ষক
জুবাইদা ছিলেন যে কোনো ভালো কাজে সর্বাধিক আগ্রহী এবং যে কোনো নেক ও পুণ্যের কাজে সকলের চেয়ে অগ্রগামী। খলিফা হারুনুর রশিদের এই বিদুষী স্ত্রী কেবল মুসলিম জাহানের সম্রাজ্ঞীই নন, বিশ্বনবী সা.-এর রক্তের ধারক।
সম্পর্কে তাঁর চাচাতো বোন এবং খলিফা আল মানসুরের নাতি। সমসাময়িক দুনিয়ায় তাঁর মতো বিদ্বান, সুন্দরী, ধর্মপরায়ণা, পরোপকারী এবং বুদ্ধিমতী নারী দ্বিতীয়জন ছিলেন না।
কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি এবং ধর্মতত্ত সম্পর্কে সম্রাজ্ঞীর পাণ্ডিত্যের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র- এশিয়া থেকে ইউরোপ, চীন থেকে ভারত কিংবা আফ্রিকা থেকে রাশিয়া অবধি।
হারুনুর রশিদের অস্বীকৃতির পরে যিনি হারামে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছিলেন এবং তার হাত দিয়ে আল্লাহ তাআলা এ ধরনের অনেক শুভকার্য সম্পাদন করিয়েছিলেন।
দেশের সচেতন নাগরিকের কাছে নাহর-এ-জুবাইদা একটি প্রসিদ্ধ বাক্য। একে জুবাইদার নাহরও বলা হয়ে থাকে। নাহর অর্থ-সরু, স্রোতস্বিনী, জলধারা, খাল, নালা ইত্যাদি।
ইতোপূর্বেকার আলোচনায় আপনারা জানতে পেরেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নগরী বাগদাদ ছিলো আব্বাসীয় খলিফাদের রাজধানী। তার মধ্যে জজিরাতুল আরব তথা বর্তমান সৌদি আরবও ছিল।
মরুভূমিপ্রবণ পবিত্র মক্কায় জমজমের পানি বাদে তেমন পানির উৎস ছিলো না। ফলে হাজীরা সেখানে গমন করলে সেকালে পানির অভাবে কষ্ট পেত। কিংবদন্তি আছে রানী জুবাইদা একরাত্রে স্বপ্ন দেখলেন অসংখ্য পুরুষ তাকে ভোগ করছে। ঘুম ভাঙ্গার পর তিনি খুব বিব্রতকর বোধ করছিলেন।
এক বিচক্ষণ দাসীকে তার স্বপ্ন বলে শিখিয়ে দিয়ে বাগদাদের বিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্য। দাসী থেকে স্বপ্নের কথা শুনে ধর্মীয় ব্যক্তি বললো- এটি তোমার স্বপ্ন হতে পারে না। স্বপ্ন কার তুমি আগে খুলে বলো, তারপর আমি ব্যাখ্যা দেবো।
ফলে দাসী রানী জুবাইদার কাছে গিয়ে তা বললে রানী এটা তার স্বপ্ন সত্য বলে দেয়ার জন্য বলেন। দাসীর কথায় ধর্মীয় ব্যক্তি ব্যাখ্যায় বলেন, রানী জুবাইদা এমন কাজ করবেন যাতে অগণিত মানুষ উপকৃত হবেন।
১৯৩ হিজরিতে খলিফা হারুনুর রশিদের সময়ে পানির অভাব এতই তীব্র হয়েছিলো যে, এক বালতি পানি ২০ দিরহামে বিক্রি করা হতো। খলিফা হারুনুর রশিদ কর্তৃক পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনাও হাজীগণকে পানির সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারল না।
১৯৩ হিজরিতে তাঁর মৃত্যুর পর রানী জুবাইদা হজ্বব্রত পালনে গেলেন। পবিত্র মক্কায় পানির সমস্যা দেখে তাকে এতই ব্যথিত করেছিল যে পানির সমস্যা চির অবসানের জন্য একটি খাল খননের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন।
জাবিতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য দূর হবে কবে?
পবিত্র মক্কা এরিয়ায় জমজমের পানি বাদে অন্যভাবে পানির ব্যবস্থা দুর্লভ হওয়ায় আমিরুল মোমেনিন হযরত ওমর রা. জরুরি ভিত্তিতে পানির ব্যবস্থা করেন। আমিরে মুয়াবিয়াও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সকল প্রচেষ্টা বর্ধিত পানির চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়।
হজযাত্রীগণের দুঃখের অবসান হলো না। হজ্বব্রত পালনের পর বাগদাদ ফিরে রানী জুবাইদা অত্যন্ত দয়ালু কণ্ঠে জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন, পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে খাল খননের নিমিত্তে আমি সকল হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছি। যাদের কাছে আমি টাকা পাবো সে টাকা পরিশোধ করতে হবে না এবং আমি যাদের কাছে ঋণী তাদের ঋণ অতিসত্তর দ্বিগুণ হারে পরিশোধ করা হবে।
অতপর তিনি হাজীদের কল্যাণে পবিত্র মক্কানগরী পর্যন্ত একটি খাল খননের আদেশ দিলেন। সেকালে এ খাল খনন প্রকৌশল বিদ্যার এক অসাধারণ কাজ। খালটি এমন সময়ে খনন করা হয়েছিলো যখন আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ছিলো না। হাজার বছরব্যাপী এ খালটি মানবের সেবা করেছে।
মানবকল্যাণে কাজ করা ছিলো রানীর অন্যতম আসক্তি। রানী জুবাইদা সেকালে কুফা থেকে পবিত্র মদিনা ও পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত মরুভূমির ওপর দিয়ে প্রায় ১৪০০ কি. মি. দীর্ঘ সড়কের উন্নয়ন সাধন করেছিলেন যা হজযাত্রীগণ ব্যবহার করতেন।
পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা দামেস্ককেন্দ্রিক উমাইয়াদের শাসন আমলে ছিলো তেমনিভাবে বাগদাদকেন্দ্রিক এ দুই পবিত্র নগরী আব্বাসীয়দের শাসন আমলে ছিলো দীর্ঘ সময় ধরে।
ফলশ্রুতিতে আব্বাসীয় শাসকগণ সেকেলে পদ্ধতিতে বাগদাদের সাথে এ পবিত্র নগরীর যাতায়াতের জন্য রাস্তা সংস্কার ও নানান সুযোগ সুবিধা নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা বিষয়ে অর্থ ব্যয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করাটা স্বাভাবিক।
সেকালে আরব মরুভূমিতে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিলো উট। উটকে বলা হতো মরুভূমির জাহাজ। অতপর গাধা ও ঘোড়া ব্যবহৃত হয়। সেকালে দিনে বিশ্রাম রাতে যাতায়াত। সাধারণ নিয়মে এক রাতে ১৬ মাইল পর্যন্ত যাওয়া যেত।
১৬ মাইল পর বিশ্রাম অবস্থানকে বলা হত মঞ্জিল। ৩ দিনের তথা ৪৮ মাইলের ঊর্ধ্বের যাত্রাকে ইসলাম ধর্ম মতে কসর হিসেবে গণ্য। সেকালে মঞ্জিলে মসজিদ, খাওয়ার পানির ব্যবস্থা, কিনে খাওয়া বা রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকত। অনেক মঞ্জিলে অবস্থাভেদে প্রহরীও থাকত।
রানী জুবাইদা বাগদাদ থেকে পবিত্র এ দুই নগরীতে মঞ্জিলের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। সাথে উট, গাধা, ঘোড়া যাতায়াতে সুবিধার জন্য সমতলে বালি সরিয়ে এবং পাহাড় পর্বত কেটে সড়ক সংস্কার করেন।
রানী জুবাইদা খাল খনন নির্মাণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বিখ্যাত প্রকৌশলী ও সারভেয়ারদের ডেকে পাঠান। সমগ্র এলাকা জরিপ করার পর তারা সিদ্ধান্ত দিলেন হুনায়ন (পবিত্র মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী পাহাড়ি এরিয়া) উপত্যকার পার্বত্য ঝর্ণা- যা সেখানকার অধিবাসীদের পানীয় জল, সেচের জলের প্রয়োজন মিটাতো, সেখান থেকে খালটি খনন করে আনা হবে।
এ হুনায়নে মুসলমানদের সাথে বিধর্মীদের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। যা গাযওয়ায়ে হুনায়ন যুদ্ধ নামে পরিচিত।
এ অঞ্চলটি কংকরময়, অনুর্বর, শুষ্ক এবং আবহাওয়া উষ্ণ। ফলে ভূপৃষ্ঠে একটি খালের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন ছিল। তাই প্রকৌশলীরা টানেলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ খাল খননের পরিকল্পনা করেন, জনগণ যাতে এ খাল থেকে পানি সংগ্রহ করে তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে এর জন্য কিছুদূর অন্তর অন্তর ভূপৃষ্ঠে পানির স্টেশন স্থাপন করা হয়।
রানী জুবাইদার নির্দেশে হুনায়ন উপত্যাকার ঝর্ণা পানির অন্যান্য উৎসগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা হয়েছিলো। পর্বতের মধ্যে দিয়ে পানি আসা ছিলো একটি বিশাল কাজ। যাতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বিপুল সংখ্যক লোকবল এবং অপরিসীম অর্থ।
পর্বত কাটার জন্য, অনুর্বর এবং কংকরময় পাহাড় খনন করার জন্য প্রয়োজন হয়েছিলো অসংখ্য বিশেষজ্ঞের। কোনো কিছুই রানী জুবাইদার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাকে হতাশগ্রস্ত করতে পারেনি।
রানী বললেন, ‘যদি প্রয়োজন হয় কোদাল এবং শাবলের প্রতিটি আঘাতের জন্য আমি এক দিরদাম অর্থ পরিশোধ করবো’ এই বলে তিনি কাজ শুরু করার প্রতিজ্ঞা করলেন।
অনেক বছর কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে জবালে রামা তথা দোয়ার পর্বত পেরিয়ে এ নাহর আরাফাতে নিয়ে আসা হয়। তারপর নিয়ে আসা হয় মুজদালেফা এবং মিনায়। হুনায়ন উপত্যাকার ঝর্ণার পানি এবং পথিমধ্যে অন্যান্য উৎসগুলোকে এ নাহর অভিমুখে এনে এর সাথে সংযুক্ত করা হয়।
এ নাহরের মাধ্যমে পানি সরবরাহের মধ্য দিয়ে আল্লাহ পাকের দাওয়াতি মেহমান হজব্রত পালনকারী এবং পবিত্র মক্কা এলাকার জনগণ খাবার পানির সমস্যা মুক্ত হয়। এই হচ্ছে মানবদরদী বিশাল অন্তরের রানী জুবাইদার জীবনের এক বিশেষ কীর্তি।
-আরআর
[মালিবাগে চালু হয়েছে অত্যাধুনিক হিজামা সেন্টার। নবীজি সা. নির্দেশিত এ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করে সুস্থ থাকুন। হার্টের রোগ, কিডনির, লিভারের ও স্ট্রোকসহ শরীরের বাত ব্যথার জন্য খুবই উপকারী হিজামা: যোগাযোগ ০১৮৫৮১৪১৮৪৬]