মুফতী তাজুল ইসলাম জালালী
আলেম ও খতিব
১৪৪০হিজরী সনের মহররম মাস চলছে। এ মাসে রয়েছে পবিত্র আশুরা। বছরের চাকা ঘুরে প্রতি বছরই আমাদের মাঝে ফিরে আসে মহররম। আসে আশুরা। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে মুহাররম মাস ও আশুরার তাৎপর্য ও গুরুত্ব কি বা কতটুকু, সে সম্পর্কে মুসলমান হিসেবে আমাদের জেনে নেওয়াটা খুবই জরুরি।
পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীবাসীকে ১২ টি মাস র্নিধারণ করে দিয়েছেন। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত- মহাররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ। আবার এ চার মাসের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত মাস হলো মুহাররম।
পাঁচটি কারণে মুহাররম মাসটি অধিক সম্মানিত-
১. আল্লাহ তায়ালা নিজে এ মাসটিকে সম্মানিত ঘোষণা দিয়েছেন।
২. মুহাররম শব্দের অর্থই সম্মানিত।
৩.রাসুল সা. বলেছেন, এটি আল্লাহ তায়ালার মাস।
৪ . রাসুল সা. বলেছেন, এ মাসের যে কোন দিনের রোজা (শুধু আশুরার রোজা নয়) রমজানের রোজার পরে সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ।
৫. এ মাসে রয়েছে পবিত্র আশুরা।
মুহাররম মাস পুরোটাই দামি ও সম্মানিত, গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বিশেষ করে এ মাসের দিনগুলোর মধ্যে আশুরার দিনটি হলো সর্বাধিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ।
আশুরা কী? এর গুরুত্ব কতটুকু এবং কেন?
আররিতে আশুরা বলা হয় ১০ সংখ্যাকে। আশুরা হলো দশম (১০ম)। প্রতি মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররম এবং এ মাসের ১০ তারিখকেও আশুরা বলা হয়।
মুহাররম মাসের ১০তারিখটি ঘটনা বহুল হওয়ায় সারা পৃথিবীতে এ তারিখটিই আশুরা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। তাই বর্তমান পরিভাষায় আশুরা বলতে কেবলই মুহাররম মাসের ১০ তারিখকেই বুঝায়।
আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
পৃথিবীর শুরু থেকেই সকল জাতির কাছে মহররম ও আশুরা গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল অতুলনীয়। আজও তা স্বতন্ত্র গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিদ্যমান রয়েছে। কারণ আশুরার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দুটি দৃষ্টিকোণ ।
শরীয়তের বিধি বিধানের দৃষ্টিকোণ
১। রমজান মাসের রোজার আগে আশুরার একটি রোজা ফরজ ছিল।
২। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর থেকে আশুরার রোজা গুরত্বপূর্ণ একটি নফল ইবাদ হিসেবে আজও রয়ে যায়।
রাসূল সা. বলেন, তোমরা আশুরার রোজা পালন করো। আমি আশা করছি, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তায়ালা পিছনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।
মদীনায় হিজরতের কয়েক বছর পর নবীজি সা. জানতে পারেন মদীনার ইয়াহুদীরাও এ দিনে রোজা রাখে। বিষয়টি জেনে রসূল বলেছেন, আমি যদি আগামীতে বেচে থাকি তাহলে আশুরার সাথে মিলিয়ে আগে বা পরে আর একটি রোজা মিলিয়ে রাখবো।
কিন্তু নবীজী সা.আর পরের বছর বেঁচে থাকেন নি। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা. এর চাহিদা মোতাবেক আশুরার আগে পরে একটি দুটি রোজা মিলিয়ে রাখতেন।
৩। রাসূল সা. বলেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে নিজের পরিবারের জন্য মুক্ত হস্তে (হাতখুলে বেশি বেশি) খরচ করবে, আল্লাহ পাক তার জন্য সারা বছর (রহমতের দুয়ার খুলে) তার রিজিকের (প্রাচুর্যের) ফায়সালা করবেন।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ
পৃথিবীর শুরু থেকেই এ দিনটি ঘটনা বহুল। বহু ঘটনা বা ইতি হাসের জ্বলন্ত সাক্ষী এই আশুরা। বর্তমানে এই তারিখের ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের দুটি অধ্যায় রয়েছে।
ক. আনন্দও বিজয় গাঁথা ইতিহাস। খ. বেদনা ও বিষাদের ইতিহাস।
বিজয় গাথা ইতিহাসের মধ্যে অন্যতম ১০
১। এই দিনে প্রথ পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষিত হয়।
২। হযরত আদম আ. ও হাওয়া আ. এর দোয়া কবুল হয়।
৩। হযরত নুহ আ. কিসতি থেকে জমিনে অবতরণ করেন।
৪। হযরত ইবরাহীম আ. নমরুদের আগুন থেকে মুক্তি পান।
৫। হযরত আইয়ুব আ. ১৮ বছর পর রোগমুক্ত হন।
৬। হযরত ইউনুস আ. মাছের উদর থেকে নিষ্কৃতি পান।
৭। হযরত মুসা আ. ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পান
৯। হযরত ইউসুফ আ. ও হযরত ইয়াকুব আ. এর সাক্ষাত হয়।
১০। ক্বাবা শরীফে প্রথম গিলাফাবৃত করা হয়।
এছাড়া অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে এই আশুরার দিনে। সকল ঘটনাই ইসলাম, মুসল মান ও হকের বিজয় ও আনন্দের ইতিহাস। আশুরার দিন মুসলমানদের আনন্দের দিন বিজয়ের দিন। আশুরাহলো মুসলমানদের জাতীয় বিজয় দিবস।
বেদনা ও বিষাদের ইতিহাস
মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মুলমানদের নিজেদের ভুল বুঝাবুঝির করনে ৬১ হিজরী সনে রাজনৈতিক সহিংসতায় হযরত হুসাইন রা.সহ তার পরিবারের ৭২ জন সদস্যের ইতিহাস কাঁপানো নিষ্ঠুরতায় করুনভাবে শাহাদত বরণ।
ভুল সংশোধন
আমাদের সমাজে বর্তমানে আশুরাকে শোক দিবস মনে করে। মাতম করে, তাজিয়া করে। তরল খিচুড়ি দিয়ে কাঙ্গালি ভোজ করে ইত্যদি। এগুলো উচিত নয়।
৪টি সংশোধনী
১। এই দিনে সংঘঠিত ইসলামের ইতিহাস সবগুলোই বিজয়ের ইতিহাস। সুতরাং এই দিনটি মুসলমানদের জাতীয় বিজয় দিবস। শোক দিবস নয়।
২। হযরত হুসাইন রা. ও তার পরিবারের শাহাদাত এটা আমাদেরই রাজনৈতিক ইতিহাস। যুদ্ধটি ছিল মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে। উভয় পক্ষের ইতিহাস মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ইতিহাস।
রাষ্ট্র ক্ষমতার মতদ্বন্দ্বে হযরত হুসাইন রা. পক্ষে যেমন সাহাবায়েকিরাম অনেকে ছিলেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক কারণে অনেক সাহাবি এজিদের পক্ষেও ছিলেন। এগুলো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এর দাবি রাখে। এখানে ধর্মীয় বিশ্লেষণ করা একদমই বোকামি।
যাদের ষড়যন্ত্রে নবী পরিবারের এ করুন পরিণতি হয়েছে তাদের ধর্মীয় বিশ্লেষণের কারণেই আজ মুসলমানরা আশুরার প্রকৃত ইতিহাস ও পালনীয়া কর্তব্য থেকে দূরে।
এ দিনটি মুসলমানদের শোক গাঁথা বিজয় দিবস। ঈদের দিনে ছেলে মারা গেলে প্রতি বছর মায়ের কাছে ঈদের দিন যেভাবে আসে আমাদের কাছেও আশুরা এভাবেই আসে।
৩। হাদীসে পাকে এই দিনে ভাল পোশাক পড়া, ভাল খাবারের আয়োজনের কথা রয়েছে নিশ্চয় এটা শোকদিবসের কথা নয়। আমাদের সমাজে পয়লা বৈশাখে নতুন পোশাক আর ইলিশ মাছ চলে আর আশুরায় চলে নোংড়া কাপড় পড়ে শোকের মাতম।
উত্তম খাবারে স্থলে ব্যবস্থা হয় তরল খিচুড়ির এসব কি শরিয়তের চাহিদা বিরোধী কাজ নয়?
৪। আর কেয়ামতের শোক সে তো কেয়ামত হওয়ার পড়ে।
আমল
১। রোজা রাখা (একাধিক)।
২। পরিবারে ভাল পোশাক ও ভাল খাবারের আয়োজন করা।
৩। দরুদশরিফ পড়া।
৪। বিজয় স্বরণ করে আলহামদুলিল্লাহ বেশি বেশি পড়া।
৫। কারবালার ইতিহাস স্বরণ করে বেশি বেশি ইন্নালিল্লাহ পড়া ও আহলে বইতের জন্য হাততুলে বা না তুলে দোয়া করা।
৬। কিয়ামতের কথা স্বরণ করে দোয়া, ইস্তিগফার, দান-সদকা ও নফল ইবাদত করা।
এসে গেল যাদুকরী মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার