আওয়ার ইসলাম: ইসলামি ভ্রাতৃত্বের মানদণ্ড ঈমান। তাই একজন মুমিন অপর মুমিনের প্রতি সম্প্রীতি-ভালবাসা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করবে, তা সে যে দেশের হোক, যে ভাষারই হোক। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَیْنَ اَخَوَیْكُمْ.
মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০
আরেক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِیَآءُ بَعْضٍ.
মুমিন নর ও মুমিন নারী সকলেই একে অন্যের বন্ধু। -সূরা তাওবা (৯) : ৭১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسّهَرِ وَالْحُمّى.
সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়, যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ¦র ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১১; সহীহ মুসলিম, হদীস ২৫৮৬
অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ، يَكُفّ عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ، وَيَحُوطُهُ مِنْ وَرَائِهِ.
মুমিন মুমিনের জন্য আয়না। মুমিন মুমিনের ভাই। সে তার জমি সংরক্ষণ করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে হেফাযত করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯১৮
এই সম্প্রীতি ও সহযোগিতার নির্দেশ তাকওয়া ও কল্যাণের পথে, ন্যায় ও বৈধ কাজে। কুরআনে কারীমের ইরশাদ-
وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَان.
তোমরা তাকওয়া ও ন্যায় কাজে পরস্পরে সহযোগিতা করো। পাপাচার ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা করো না। -সূরা মায়েদা (৬) : ০২
ন্যায় ও কল্যাণের বিষয়ে নিজ কওমকে সাহায্য করা অন্যায় সম্প্রদায়প্রীতি নয়। জুলুম ও অন্যায় কাজে কওমকে সহযোগিতা করাই হচ্ছে নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা। একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘আসাবিয়াত’ (তথা সাম্প্রদায়িকতা) কী? তিনি জবাব দিলেন, নিজ কওমকে তার অন্যায় অবিচারে সাহায্য করা। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১১৯
সুতরাং অন্যায়ের ক্ষেত্রে পক্ষপাতই হল সাম্প্রদায়িকতা, যা ইসলামে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। ইরশাদ হয়েছে-
لَيْسَ مِنّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيّةٍ، وَلَيْسَ مِنّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيّةٍ، وَلَيْسَ مِنّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيّةٍ.
যে ব্যক্তি আসাবিয়াতের দিকে ডাকে বা আসাবিয়াতের কারণে লড়াই-যুদ্ধ করে বা আসাবিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১২১
অতএব ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হল, তাকওয়া ও কল্যাণের কাজে মুসলমানগণ পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। নিজেদের মাঝে প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখবে এবং অন্যায়ের পক্ষাবলম্বন ও সহযোগিতা থেকে বিরত থাকবে।
এখানে ইসলামের সীমাহীন সৌন্দর্য এই যে, ইসলাম প্রীতি-সৌহার্দ্যরে চূড়ান্ত স্তরের প্রতিও মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। ঈমানী ভাইয়ের জন্য আপন স্বার্থ বিসর্জনেরও উৎসাহ দেয়।
ইসলামের সূচনালগ্নে মক্কার মুসলিমগণ এক কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। আপন গোত্রের অবিচার ও নিপীড়ন তাদেরকে স্বদেশত্যাগে বাধ্য করেছিল।
তখন মদীনার মুসলমানগণ সহযোগিতা ও সহানুভূতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তারা নিজেদের প্রয়োজন ও দারিদ্র্য সত্ত্বেও সহায়-সম্বলহারা মুহাজির মুসলমান ভাইদের জন্য ধন সম্পদ ও আপন স্বার্থ ত্যাগ করেছিলেন।
তাদের পরার্থপরতার এ গুণটি পছন্দ করে আল্লাহ পাক কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেন-
وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۫ؕ .
তারা (আনসারেরা) নিজেদের উপর (মুহাজিরদের) প্রাধান্য দেয়। যদিও নিজেদের প্রয়োজন ও অভাব থাকে। -সূরা হাশর (৫৯) : ০৯
সূরাতুদ দাহরে আল্লাহ পাক জান্নাতের বিশেষ কিছু নিআমত উল্লেখ পূর্বক এসকল নেআমতের অধিকারীগণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন-
وَ یُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّهٖ مِسْكِیْنًا وَّ یَتِیْمًا وَّ اَسِیْرًا اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِیْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّ لَا شُكُوْرًا .
(তারাই এসকল নিআমত লাভ করবে যারা) এবং যারা মিসকীন, এতীম ও বন্দিদেরকে খাবার দান করে তার প্রতি (নিজেদের) আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও। (আর বলে) আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তোমাদের থেকে আমরা কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। -সূরা দাহর (৭৬) : ৮-৯
অন্য এক আয়াতে সৎকর্ম ও পুণ্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে-
وَ لٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ اٰمَنَ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ الْمَلٰٓىِٕكَةِ وَ الْكِتٰبِ وَ النَّبِیّٖنَ وَ اٰتَی الْمَالَ عَلٰی حُبِّهٖ ذَوِی الْقُرْبٰی وَ الْیَتٰمٰی وَ الْمَسٰكِیْنَ وَ ابْنَ السَّبِیْلِ وَ السَّآىِٕلِیْنَ وَ فِی الرِّقَابِ.
বরং পুণ্য তো হল, মানুষ ঈমান রাখবে আল্লাহ, শেষ দিন, ফেরেশতা, (আল্লাহর) কিতাব আর নবীগণের প্রতি এবং (নিজ) সম্পদের প্রতি ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও তা দান করবে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে। -সূরা বাকারা (২) : ১৭৭
নিজের প্রয়োজন সত্ত্বেও নিঃস্বার্থভাবে অপর ভাইকে নিজের উপর প্রাধান্যদানের বিষয়ে ইসলামের এই সুমহান আদর্শ সহজে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এখানে সাহাবায়ে কেরামের আলোকিত জীবনচরিত থেকে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে, যাতে ফুটে উঠেছে এ-শিক্ষাটির বাস্তব ও সমুজ্জল চিত্র। শুরুতেই স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মপন্থা ও পবিত্র সীরাত থেকে তাঁর একটি ঘটনা লক্ষ করুন।
হযরত সাহল বিন সাদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন নারী সাহাবী নবিজীর জন্য সুন্দর কারুকার্য করা একটি নতুন কাপড় হাদিয়া এনে আরয করলেন, আমি এটি স্বহস্তে তৈরি করেছি।
আপনি তা পরিধান করলে খুশী হব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাপড়টি গ্রহণ করলেন। তাঁর কাপড়ের প্রয়োজনও ছিল।
যখন তিনি তা লুঙ্গি হিসাবে পরিধান করে ঘরের বাইরে আসলেন, এক ব্যক্তি বলল, খুব চমৎকার কাপড় তো! আমাকে তা দান করবেন কি? তখন নবীজী ঘরে ফিরে গিয়ে তা খুলে ভাঁজ করে লোকটির জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
এ দৃশ্য দেখে অন্যান্য সাহাবী ঐ ব্যক্তিকে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন, আরে মিয়া! তুমি কি জানো না, কাপড়টি নবীজীর প্রয়োজন রয়েছে। আর তিনি কোনো কিছু চাইলে ‘না’ বলেন না।
সে জবাবে বলল, আমি সবই জানি, এরপরও চেয়েছি, যাতে তাঁর মুবারক শরীর-স্পর্শে ধন্য কাপড় দিয়ে আমি নিজের কাফন বানাতে পারি। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর পর সেই কাপড়েই তাকে দাফন করা হয়েছিল। -সহিহ বুখারি, হাদিস ১২৭৭, ২০৯৩, ৫৮১০, ৬০৩৬
এটা তো নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী জীবনের একটি ঘটনামাত্র। তাঁর পবিত্র সীরাত অধ্যয়ন করলে এ চিত্র খুব স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে যে, জান-মালের পুরাটাই তিনি দ্বীন-ইসলামের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।
তিনি কখনোই আপন স্বার্থ বা নিজের সুখ-শান্তির কথা ভাবেননি। সর্বদাই তাঁর চিন্তা ছিল উম্মতকে নিয়ে। তাদের প্রয়োজন ও কল্যাণ নিয়ে।
তাঁর কাছে কোনো সম্পদ এলেই তিনি তা অভাবী ও প্রয়োজনগ্রস্তদের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন; এক বর্ণনায় তো এসেছে, এক ব্যক্তি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে এসে কিছু চাইল।
তিনি প্রার্থনাকারীকে বললেন, এখন তো আমার কাছে দেয়ার মত কিছুই নেই, তোমার প্রয়োজন মোতাবেক তুমি আমার নামে কারো থেকে কর্জ নিয়ে নাও, আমার হাতে কিছু আসলে আমি ঐ ঋণ পরিশোধ করে দিব।
এ কথা শুনে হযরত উমর রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ পাক তো আপনাকে সাধ্যের বাইরে কিছু করার নির্দেশ দেননি; বরং আমিই প্রার্থনাকারীকে কিছু দিয়ে দিই।
হযরম উমরের একথা নবীজীর মনঃপুত হল না। ঐ মুহূর্তে এক আনসারী সাহাবী বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ইচ্ছা মত দান করতে থাকুন।
মহান আরশপতির কাছে কমে যাওয়ার আশংকা করবেন না। তার এ কথায় নবীজী খুবই খুশি হলেন এবং মুচকি হাসলেন। বললেন, আমাকে এমনটিই আদেশ করা হয়েছে। -শামায়েলে তিরমিযি (৩৫৫) (শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ তাহকীককৃত) মুসনাদে বাযযার (২৭৩); আলমুখতারাহ, যিয়া মাকদিসী (৮৮); মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/২৪২
সূত্র: আল কাউসার
বিসফটি – বিস্তারিত জানুন
আরো পড়ুন-
‘সমকামী নারীকে প্রথমেই বেত্রাঘাতে ইসলামের গুণাবলি প্রকাশ পায়নি’
জেরুসালেম থেকে দূতাবাস সরানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলো প্যারাগুয়ে
‘আমাকে একটু বেশি মানুষ রিসিভ করেছে এতে দোষের কী?