রাশেদ আহমেদ
পৃথিবীর অন্য যেকোনো সংস্কৃতির উৎসবের সঙ্গে ইসলামের উৎসবের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। অন্য ধর্ম কিংবা সংস্কৃতির উৎসবগুলো হয় নিরেট দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে। জাঁকজমক আর বিলাসিতাই এসব উৎসবের মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু ইসলাম একটি ভিন্ন সংস্কৃতির দিকে মানুষকে আহ্বান করে। বিলাসিতা কিংবা ভোগবাদিতা নয়; স্রেফ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই এই সংস্কৃতির উৎসবের উদ্দেশ্য।
মুসলিমদের জন্য আল্লাহ রব্বুল আলামিন দুটি উৎসবের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন- একটি ঈদ-উল-ফিতর, যাকে আমরা বলি রোজার ঈদ। আরেকটি ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদ।
এরমধ্যে রমজানে টানা এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলিমদের আনন্দের জন্য দেয়া হয়েছে ঈদ-উল-ফিতর। তবে এই উৎসব শুধু উৎসব নয়; এর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক আবেদন আছে।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে ব্যক্তি হিসেবে মুসলিমদের একটি বড় ইবাদতের মাধ্যমে যে অর্জন, তার জন্য সুস্থ ও নির্মল আনন্দ উদযাপিত হয় ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে। সে অর্জন হচ্ছে, এক মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা যাতে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও যৌনানন্দ থেকে বিরত থাকতে হয়। এটা মুমিন নর-নারীর জন্য সুনির্দিষ্টভাবেই একটি বিরাট সফলতা ও কৃতিত্ব।
সবচেয়ে বড় কথা, এই ঈদ হচ্ছে মহান রব্বুল আ’লামিনের ক্ষমা ঘোষণার একটি দিন। মুসলিমরা ঈদের দিন জমায়েত হয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যারা ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠাসহ আল্লাহর শরণাপন্ন হয়, তিনি তাদের করুণা ও ক্ষমা করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস প্রণিধানযোগ্য। তিনি ইরশাদ করেন, ‘যখন ঈদুল ফিতরের দিন আসে, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যারা রোজা পালন করেছে তাদের সম্পর্কে ফিরিশতাদের নিকট গর্ব করে বলেন- হে আমার ফেরেশতারা, তোমরা বলতো! যে শ্রমিক তার কাজ পুরোপুরি সম্পাদন করেছে তার প্রাপ্য কি হওয়া উচিত?
উত্তরে ফেরেশতারা বলে, হে মাবুদ! পুরোপুরি পারিশ্রমিকই তার প্রাপ্য। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দারা তাদের প্রতি নির্দেশিত ফরজ আদায় করেছে, এমনকি দোয়া করতে করতে ঈদের নামাজের জন্য বের হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আমার মহিমা, গরিমা, উচ্চ মর্যাদা ও উচ্চাসনের শপথ, আমি অবশ্যই তাদের প্রার্থনায় সাড়া দেব। এরপর নিজ বান্দাদের লক্ষ্য করে আল্লাহ পাক ঘোষণা দেন- তোমরা ফিরে যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের সাধারণ পাপরাশিকে পুণ্যে পরিণত করে দিলাম। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তখন তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় (বাড়িতে) প্রত্যাবর্তন করে।’ (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব)
যদিও অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই ঈদকেও দিন দিন জাহেলি রূপ দেয়া হচ্ছে। একমাস সিয়াম সাধনার পর অনেক ধর্মভীরু মুসলিমও ঈদের দিন নানা গুনাহর কাজে জড়িয়ে পড়েন। কখনো অজ্ঞতাবশত, আবার কখনো শয়তানের ধোঁকায় পড়ে। মুসলিম তরুণ-তরুণীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ঈদের দিন যেন নির্লজ্জতার উৎসব হয়ে দাঁড়ায়! এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
এই ঈদ শুকরিয়া আদায়ের দিন। মুসলিমরা যখন সবচেয়ে আনন্দমুখর থাকে, তখনও তারা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমেই। ঈদের একটি সামাজিক চেতনাও আছে। পরস্পরের সঙ্গে সহমর্মিতা বিনিময়, দান-সাদকা করা, জাকাত দেয়া, বঞ্চিতকে সাহায্য করা। সাদাকালো, ধনী-গরিব মিলেমিশে সবাইকে উৎসবে এক কাতারে নিয়ে আসে ঈদ।
সর্বশেষ যে কাথাটি বলার আছে- মুসলিম উম্মাহর জন্য বর্তমান সময়ের ঈদ আনন্দের উৎসব আর নেই। যাদের ভাই-বোনরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের জন্য কোনো উৎসবই যেন আনন্দ বয়ে আনতে পারে না। ইউরোপের দেশে দেশে ইসলামবিদ্বেষের মহড়া চলছে। সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, আরাকান আর কাশ্মীরের মুসলিমদের আর্তনাদে আজ আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে।
সম্প্রতি মার্কিন দূতাবাস মুসলিম ভূমি জেরুজালেমে স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনের মুসলিমদের ওপর বর্বর নির্যাতন করেছে ইহুদিবাদী ইসরায়েল। আট মাসের শিশু লায়লাও রেহাই পায়নি ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞ থেকে। সারাবিশ্ব- এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জন্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া যেন আর কোনো উপায় ছিল না। আরাকানের মুসলিমরা শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। ওদের জীবনে ঈদ নেই! কাশ্মীরের মুসলিমদের ওপর চলছে নিপীড়ন। সিরিয়ার মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুকে মাথায় নিয়ে ঘুমাতে যায়।
মুসলিম পরিচয়টাই যেন পৃথিবীতে এক আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে অপপ্রচার চলছে, ইসলাম এক নৃশংস নির্মম ধর্ম! অথচ এই পৃথিবীকে সভ্যতা শিখিয়েছে ইসলাম।
ইতিহাসে যদি এমন একটু সময় থেকে থাকে, যখন মানবতা শান্তির ছায়াতলে বসবাস করতে পেরেছে- সেই সময়টুকু ইসলামের স্বর্ণযুগ। হেরা গুহায় যে আলোর মশাল জ্বলেছিল, তা-ই ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বজুড়ে। আবেগের বশবর্তী হয়ে কথাগুলো বলছি না, ইতিহাস থেকে প্রমাণ দিতে পারি।
নিজেদের বিভেদ আর কলহ আজ মুসলিমদের একটি নিষ্পেষিত আর অবহেলিত জাতিতে পরিণত করেছে। তবে এখনো স্বপ্ন দেখি- মুসলিমরা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বিশ্বসভ্যতায় একচ্ছত্র নেতৃত্ব দেবে। ভারত থেকে আন্দালুসিয়া, আরব থেকে আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে বলকান- সব জায়গায় আবার ছড়িয়ে পড়বে হেরার আলো। নিপীড়িত মানুষগুলো শান্তির ছায়ায় আশ্রয় পাবে। সেদিন আমরা একত্রে আবার ঈদ উদযাপন করবো- সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, আরাকান আর কাশ্মীরের মুসলিমদের আর্তনাদ আর শোনা যাবে না।
লেখক: সাংবাদিক