আওয়ার ইসলাম : ‘আমি শতাধিক লোককে হত্যা করেছি, কিন্তু তার জন্য আমার কোন অনুতাপ নেই, কারণ তাদের সবারই মৃত্যুই প্রাপ্য ছিল।’ ইসলামিক স্টেটের (আইএস) এক নিজ জবানবন্দীতে এসব কথা বলেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন তার কাহিনি। কিভাবে সিরিয়ার বাশার আসাদ-বিরোধী বিক্ষোভকারী থেকে তিনি একজন সশস্ত্র যোদ্ধায় পরিণত হলেন, নানা সংগঠন ঘুরে একসময় আইএসে যোগ দিলেন, তার পর আইএস ছেড়ে পালিয়ে তুরস্কে আশ্রয় নিলেন।
এটি একজন সিরিয়ানের গল্প, যিনি একজন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী হিসেবে বাশার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যোগ দেন। কিন্তু পরে চারপাশের যুদ্ধ-সহিংসতা-রক্তপাতের পরিবেশের মধ্যে নিজেই পরিণত হন এক ঘাতকে।
খালেদ (আসল নাম নয়) শুধু যে রাক্কার পরিস্থিতির কারণেই একজন হত্যাকারীতে পরিণত হয়েছিলেন তা নয়। তাকে আসলে এ কাজে যোগ দিতে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
খালেদ বলেন, আমাদের প্র্যাকটিস টার্গেট ছিল ধরা পড়া সিরিয়ার সরকারী সৈন্যরা। তাদের বসানো হতো কঠিন সব জায়গায়, যেখানে তাদের গুলি করার জন্য স্নাইপার দরকার হতো।
কখনো একদল বন্দীকে বাইরে ছেড়ে দেয়া হতো। বলা হতো যে, তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট একজনকে এমনভাবে গুলি করতে যাতে অন্য কারো গায়ে গুলি না লাগে।
তারা আরো প্রশিক্ষণ নেয় কিভাবে মানুষ মারতে হয়। এবং এ কাজে শিকার হিসেবে ব্যবহার করা হতো তাদের হাতে ধরা পড়া বন্দীদের।
ছয় জন লোককে ওই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের বলা হয় আলেপ্পোর একটি বিমানঘাঁটিতে হাজির হতে। সেখানে একজন ফরাসী প্রশিক্ষক তাদের শেখাবে কিভাবে পিস্তল চালাতে হয়, কিভাবে আগ্নেয়াস্ত্রে সাইলেন্সার লাগাতে হয়, আর কিভাবে চালাতে হয় 'স্নাইপার রাইফেল'। স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করে চোরাগোপ্তা বন্দুকধারীরা, লুকোনো একটি জায়গায় বসে থেকে তারা নির্ভুল নিশানায় একটি মাত্র গুলি খরচ করে কাউকে হত্যা করতে পারে।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ সময়ই হত্যাকান্ডগুলো ঘটানো হতো মোটরবাইক থেকে। একজন মোটরবাইক চালাবে, আর তার পেছনে যে বসবে সে গুলি করবে। আপনাকে মোটর বাইকটা লক্ষ্যবস্তুর গাড়ির পাশে নিয়ে যেতে হবে - তার পর তাকে গুলি করতে হবে এবং সে পালাতে পারবে না।
খালেদ বলেন, তিনি শিখেছেন কিভাবে কোন লোককে অনুসরণ করতে হয়। কিভাবে অপরিচিত লোকদের দিয়ে টার্গেটকে চিহ্নিত করতে করতে হয়। কিভাবে একটা গাড়ির বহরকে বিভ্রান্ত করতে হয়। এটা ছিল একটা রক্তাক্ত, অমানবিক প্রশিক্ষণ।
খালেদ ছিলেন আহরার আল-শামের একটি গ্রুপের কমান্ডার। রাক্কার নিরাপত্তা অফিস ছিল তার দায়িত্বে।
কিন্তু ২০১১ সালে সিরিয়ান বিপ্লবের যখন সূচনা হয় তখন খালেদ ছিলেন শান্তিপ্রিয় একজন লোক। তিনি বলছিলেন, আমি কিছুটা ধার্মিক ছিলাম, তবে খুব গোঁড়া ছিলাম না।
তিনি প্রথম যেদিন সরকারবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন সেদিন তার মুক্তি আর সরকার-ভীতি মিলে এক বিচিত্র অনুভুতি হয়েছিল।
প্রথমদিকে ওই সব বিক্ষোভে অস্ত্র নিয়ে যাবার কথা কেউ বলেনি, কারো তেমন সাহসই ছিল না। কিন্তু তাদের নিরাপত্তাবাহিনীর গ্রেফতার দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়েছে।
একদিন খালেদ নিজেও আটক হলেন। একমাসে কারাগারে থেকে তিনি ছাড়া পেলেন। তবে কারাগারে ঢোকানোর আগে তাকে এত নির্যাতন করা হয় যে তিনি পিঠের ব্যথায় হাঁটতে পারতেন না।
খালেদ বলেন, সবচেয়ে বর্বর অত্যাচার করেছিল বিশেষ একজন নিরাপত্তা রক্ষী।
সে খালেদকে বাশার আসাদের একটা ছবির সামনে হাঁটু মুড়িয়ে বসাতো। বলতো, তোমার ঈশ্বর মারা যাবে, কিন্তু বাশার আসাদ মারা যাবে না। সে টিকে থাকবে।
খালেদকে সিলিং থেকে বেঁধে ঝোলানো হতো, কাপড় খুলে তাকে পেটানো হতো। সেই রক্ষীটা বলতো, আমি তোমাকে ঘৃণা করি, আমি চাই তুমি আমার হাতে মরো।
খালেদ বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে যদি আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে আমি যেভাবেই হোক ওকে হত্যা করবো।
ছাড়া পাবার পর বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেবার পর খালেদ সত্যি সত্যি খুঁজে বের করেছিলেন ওই নিরাপত্তা রক্ষীকে।
খালেদ বলেন, আমি তাকে ধরে নিয়ে গেলাম একটা বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। আমি তার হাত ও জিভ কেটে ফেলেছিলাম, কিন্তু তাতেও আমার তৃপ্তি হয় নি।
তিনি বলেন, সে যখন আমাকে অনুনয় করছিল তাকে মেরে ফেলার জন্য তখনই আমি তাকে হত্যা করি। আমি প্রতিশোধ নিতে এসেছিলাম, তাই আমার কোন ভয় করে নি। তাকে অত অত্যাচার করার পরও আমি কোন দু:খ বা অনুতাপ বোধ করি নি।
কিছুদিন পর খালেদ বিপ্লবের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেন। শুধু তার নিজের টিকে থাকার জন্যই তিনি যুদ্ধ করছিলেন।
যুদ্ধকৌশল নিয়ে বিবাদ, প্রতারণা, ক্ষমতার লড়াইয়ে নানা পরিবর্তন - এসব নানা কারণে বিদ্রোহীরা অনেকেই দল পরিবর্তন করতে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটেই খালেদ আহরার আল-শাম ত্যাগ করেন। আল-শাম তাকে একজন ঘাতক হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
এর পর তিনি যোগ দেন আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট আল-নুসরা ফ্রন্টে। সে সময় ইসলামিক স্টেট ছিল ছোট সংগঠন, খালেদ এবং তার সাথীদের হাসি-ঠাট্টার পাত্র।
আরো পড়ুন : তরুণের গুলিতে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহত