সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন আলহেরা
পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অপরের মাল ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনকারীকে আমাদের সমাজে দালাল বলে অভিহিত করা হয়। দালালিকে আরবিতে ‘সামসারা’ আর দালালকে ‘সিমসার’ বলা হয়। যিনি দালালি করেন, তিনি কখনও বিক্রেতার পক্ষে, কখনও ক্রেতার পক্ষে আবার কখনও ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের পক্ষে দালালি করে থাকেন। (আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ১০/১৫১)।
বর্তমানে অসাধু ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়িক অঙ্গনে অসততার আধিক্যের কারণে কোনো জিনিস ক্রয় করতে বা বিক্রি করতে সঠিক দাম পাওয়ার ব্যাপারে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগতে হয়। বাধ্য হয়ে মানুষ এমন দালালদের খোঁজেন, যারা মূল্য সম্পর্কে পরিপক্ব ধারণা রাখে। আবার অনেক সময় স্বল্পতা, নিরাপত্তার অভাব ও অনুপস্থিতির অজুহাতেও দালাল ধরার প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে দালাল ধরার সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে অসুবিধাও রয়েছে। কারণ অন্যান্য পেশার মতো এ পেশায়ও অনুপ্রবেশ ঘটেছে প্রতারক, মিথ্যাচারী ও দুশ্চরিত্রের লোক।
স্বভাবধর্ম ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক এ প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ দালাল তার মেধা, শ্রম ও সময় ব্যয় করে অন্যের পণ্য খরিদ করে দেয় বা বিক্রি করে দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে দালাল হলোÑ আজিরে মুশতারিক বা সময়মুক্ত শ্রমিক। অতএব অন্যান্য শ্রমিকের মতোই দালালি করে মজুরি নেয়া জায়েজ। তবে শর্ত হলো, কত টাকা মজুরি দিতে হবে তা আগেই নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। (ফাতাওয়া শামি : ৫/৩৩, আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/২৭২, ফাতহুল বারি : ৪/৪৫২, আলমুদাওয়ানা : ৩/৪৬৬, আলমুগনি : ৮/৪২, ফাতাওয়াল লাজনাতিত দায়িমা : ১৩/১২৫, ফাতওয়া শায়খ ইবনে বাজ : ১৯/৩৫৮)।
দালালির কয়েকটি সুরত
দালালির বিভিন্ন সুরত হতে পারে। একটি সুরত হতে পারে এরকম যে, কোনো ব্যক্তি এভাবে চুক্তি করল যে, আমার গাড়ি-বাড়ি বিক্রয় করা দরকার। তুমি আমাকে ১ মাসের ভেতর ক্রেতা খুঁজে দাও। আমি তোমাকে ১ মাসের বেতন প্রদান করব। এখন লোকটি যদি ১৫ দিনেই ক্রেতা খুঁজে দিতে পারে, তাহলে সে ১৫ দিনের পারিশ্রমিকই পাবে। আবার পুরো মাস চেষ্টা করেও যদি ক্রেতা মেলাতে না পারে, তবুও সে পুরো মাসের বেতন পেয়ে যাবে। এটা দালালি নয়; মাসিক বেতন। এটা জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে কারোই দ্বিমত নেই। (মাবসুত লিসসারাখসি : ১৫/১১৫, আওনুল মা’বুদ : ৯/১২৪)।
তবে দালালির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সুরত হলো এভাবে চুক্তি করা যে, তুমি আমার গাড়ি-বাড়িটি বিক্রি করে দাও। বিক্রি করে দিতে পারলে ৫ হাজার টাকা প্রদান করব। এতে সাধারণত সময় ধার্য করা থাকে না, বরং লেনদেন সমাপ্তি শেষে তাকে চুক্তিকৃত টাকা প্রদান করা হয়। চাই সে দুই দিনের ভেতরই করুক বা ২ মাস লেগে যাক বা তার চেয়ে বেশি। যখন সে কাজ সমাধা করে দিতে পারবে, তখনই টাকা পাবে। এমনকি সে যদি অনেক পরিশ্রম করার পরও পণ্যটি বিক্রি করে দিতে না পারে, তাহলে সে চুক্তিকৃত টাকা থেকেও বঞ্চিত হবে। এটাকে ‘জাআলা’ (কাজ শেষে মজুরি) বলে। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৬৩)। দালালির এ সুরতটি জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। ইমাম মালেক (রহ.), ইমাম শাফেঈ (রহ.) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট থাকলে দালালিকে নিঃশর্তভাবে জায়েজ বলেন। (ফাতহুল বারি : ৪/৪৫২)। আর ইমাম আবু হানিফা রহ. এর পক্ষ থেকে এ ধরনের চুক্তি (জাআলা) জায়েজ-নাজায়েজের ব্যাপারে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাই পরবর্তী সময়ে হানাফি আলেমরা যাদের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা শামি রহ. এটাকে জায়েজ সাব্যস্ত করেছেন। (ইলাউস সুনান : ১৩/৪০, বাদায়িউস সানায়ে : ৬/৮, আলমুগনি : ৬/৩৫০) এবং তারা কোরআনে কারিমের সূরা ইউসুফের ৭২নং আয়াত দ্বারা দলিল পেশ করে থাকেন।
ইউসুফ আ. এর পানপাত্র হারিয়ে ফেলা সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা বলল, আমরা বাদশাহর পানপাত্র হারিয়ে ফেলেছি এবং যে কেউ এটা এনে দেবে সে এক উটের বোঝা পরিমাণ মাল পাবে এবং আমি এর জামিন।’ যে ব্যক্তি বাদশাহর হারানো পেয়ালা এনে দেবে সে এক উট বোঝাই রেশন পাবে। এখানে যে চুক্তি হলো তাতে মেয়াদ ও পরিশ্রম কিছুই নির্ধারণ করা হয়নি, বরং কাজের শেষে পারিশ্রমিক ধার্য করা হয়েছে।
পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট হওয়ার দুইটি পদ্ধতি
ক. পরিমাণ নির্দিষ্ট করা। যেমন খালেদ বকরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলো, সে বকরকে জমি কিনে দেবে। বিনিময়ে বকর তাকে ৫ হাজার টাকা দেবে।
খ. দামের অংশ নির্দিষ্ট করা। যেমন জায়েদ ওমরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলো, সে ওমরের গরু যত টাকায় বিক্রি করে দেবে তা থেকে শতকরা ৫ টাকা হারে ওমর তাকে পারিশ্রমিক দেবে। দালালের উপরোক্ত উভয় ধরনের পারিশ্রমিক হালাল। এমনকি পারিশ্রমিকের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকলে একটি মাল বেচাকেনা করে দিয়ে উভয় পক্ষ থেকে দালালি মূল্য গ্রহণ করাও হালাল হবে।
নিষিদ্ধ দালালি যদি বিনিময় অনির্দিষ্ট রেখে বেচাকেনায় সহযোগিতার চুক্তি করা হয়, তাহলে চুক্তি ও বিনিময় সবই নাজায়েজ হবে। যেমন রাশেদ বকরকে বলল, আপনি আমার এ গাড়ি বিক্রি করে আমাকে ২ লাখ টাকা দেবেন। এর বেশি যত টাকায় বিক্রি করতে পারবেন; তা আপনার থাকবে। যুগশ্রেষ্ঠ ফকিহ মুফতি রশীদ আহমদ রহ. শেষোক্ত এ পদ্ধতিকে নাজায়েজ আখ্যা দিয়েছেন। অনুরূপভাবে গোপন দালালিও নাজায়েজ।
মন রাশেদ একটি পুরাতন মোবাইল বিক্রি করবে। কিন্তু তার ধারণা যে, এ ধরনের মোবাইল বর্তমানে কেউ কিনতে আগ্রহী হবে না। অপরদিকে বকর ঠিক সে ধরনেরই একটি মোবাইল খুঁজছে। জায়েদ এ সুযোগে দালালির মাধ্যমে উপার্জনের ইচ্ছা গোপন করে বন্ধুত্বের বেশ ধরে উভয়ের কাছে যেয়ে বেচাকেনার বিষয়টি চূড়ান্ত করল। মোবাইল কিনে দেয়ার কথা বলে, বকরের কাছ থেকে কিছু টাকা গ্রহণ করল। আবার বিক্রি করার কথা বলে রাশেদের কাছ থেকে কিছু টাকা গ্রহণ করল। এভাবে সে উভয় দিক থেকে টাকা খেল। কিন্তু বিষয়টি উভয় পক্ষের কেউই জানল না।
এ অবস্থায় জায়েদের জন্য ওই টাকা হারাম হবে। আরেক ধরনের কৃত্রিম দালাল রয়েছে, যারা শুধু দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আসল খরিদ্দারের সামনে খরিদ্দার সেজে পণ্যের দাম করে আসল খরিদ্দারকে ধোঁকা দেয়। এভাবে তারা বিক্রেতার কাছ থেকে চুক্তি অনুসারে কিছু টাকা গ্রহণ করে থাকে। ইসলামে কোনো ধোঁকাবাজির সুযোগ নেই।