মুফতী মানসূরুল হক
শাইখুল হাদিস ও প্রধান মুফতি, জামিয়া রাহমানিয়া (আলী এন্ড নুর রিয়েল এস্টেট)
সচেতন পিতা-মাতার পরিচয় হল, সন্তানের সার্বিক বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, পিতা-মাতার অসচেতনতা, অদূরদর্শীতা এবং দীন সম্পর্কে অজ্ঞতার দরুন সন্তানদের দুনিয়া-আখেরাত সব বরবাদ হয়ে যাচ্ছে।
নতুন প্রজন্ম ক্রমশ দীন-ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং প্রযুক্তির সয়লাবে গা ভাসিয়ে দিয়ে আখলাক-চরিত্র সব খোয়াতে বসেছে। এসব কিছুর পেছনে যে বিষয়টি রয়েছে তা হল, সন্তানদেরকে সময় মত বিবাহ না দেয়া।
ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে পিতা-মাতার দায়িত্ব হল দীনদার পাত্র-পাত্রী দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। ছেলেদের দাড়ি গজানোর দ্বারা আর মেয়েদের ঋতু শুরু হওয়ার দ্বারা পিতা-মাতাকে এ কথা বুঝানো হয় যে, তাদের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, আর দেরি করা যাবে না।
অতএব প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দু’এক বছরের মধ্যেই তাদের বিবাহ করিয়ে দেয়া পিতা-মাতার কর্তব্য।
এরপরও যদি বিয়ে না দেয়া হয়, আর একারণে ছেলে-মেয়ে কোন গুনাহে লিপ্ত হয়, অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি দেখে, তাহলে এ গুনাহের দায়দায়িত্ব পিতা-মাতার উপর বর্তাবে।
হাদীস শরীফে আছে, من ولد له ولد فليحسن اسمه وأدبه، فإذا بلغ فليزوجه فإن بلغ ولم يزوجه فأصاب إثما، فإنما إثمه على أبيه
সন্তান জন্মগ্রহণের পর পিতা-মাতার দায়িত্ব হল তার সুন্দর নাম রাখা এবং দীন শিক্ষা দেয়া, আর বালেগ হয়ে গেলে বিবাহ করিয়ে দেয়া। যদি বালেগ হওয়ার পরও বিবাহ না করায়, আর সন্তান কোন গুনাহে লিপ্ত হয়, তাহলে এর দায়ভার পিতার উপরই বর্তাবে। (বায়হাকী, হাদীস নং ৮২৯৯)
অন্য একটি হাদীসে আছে, পিতা-মাতার উপর সন্তানের হক হল, সুন্দর নাম রাখা, আকীকা করা, দীন শিক্ষা দেওয়া, বালেগ হওয়ার পর বিয়ে দেওয়া। (কিতাবুল বিররি ওয়াস্ সিলাহ, হাদীস নং ১৫৫)।
কাজেই পিতা মাতার দায়িত্ব শেষ হবে সন্তানকে বিয়ে দেওয়ার পর। (আওলাদ কো মুসলমান বানানে কা তরীকা, ২৭৩)
অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, আজ মুসলিম উম্মাহ ইহুদী-খ্রিষ্টানদের নানামুখি ষড়যন্ত্রের শিকার। এদেশে যত এন.জি.ও আছে, এর অধিকাংশই ইহুদী-খ্রিষ্টানদের অর্থে পরিচালিত। তারা সমন্বিত প্রচেষ্টায় সরকারকে দিয়ে এ আইন পাশ করিয়েছে যে, ১৮ বছরের আগে কোন মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না। তাদের ভাষায় এটা হল “বাল্যবিবাহ”। অথচ মেয়েরা সাধারণত আরো চার/পাঁচ বছর আগেই বালেগা হয়ে থাকে।
কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, এই আইনটা ১৬ বছরে করা হোক, কারণ মেয়েরা এতটা সময় (১৮ বছর) বসে থাকে না। পারিপার্শিকতাসহ বিভিন্ন কারণে তাদের পক্ষে চারিত্রিক পবিত্রতা ধরে রাখা সম্ভবপর হয় না। বন্ধু-বান্ধবের হাত ধরে চলে যায়, নানা অঘটন ঘটায়।
কিন্তু এনজিওদের হৈচৈয়ের কারণে সেটা আর সম্ভবপর হয়নি। এনজিওরা এই আইনটি পাশ করিয়েছে মূলত যিনা-ব্যভিচারকে ব্যাপক করার জন্য। এর জন্য তারা মুড়ি-মুড়কির মতো দেদারসে জন্মবিরতিকরণ ট্যাবলেট ও বিভিন্ন উপকরণ সাপ্লাই দেয়।
এরপরও কোন মেয়ে যদি বিপদে পড়ে যায়, পেটে অবৈধ সন্তান চলে আসে- এর জন্য তারা ‘মেরী স্টোপস’ প্রতিষ্ঠা করেছে, যার কাজ হল-মাতৃসেবার ছদ্মনামে অবৈধ গর্ভপাতের নিরাপদ আলয় তৈরি করা। আর মুসলমানরা মনে করছে, আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সরকার কত রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। (হামারে আয়েলী মাসায়েল, ১৬০)
অপর দিকে এন.জি.ও রা জনসাধারণের মস্তিষ্কে বিভ্রান্তির এক ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যাবে না। আর বাপ-মা খাড়া করেছে দুই ভূত। ক. এক হল, পড়াশুনা শেষ করা, চাকরি ঠিক হওয়া।
অনেক সময় দেখা যায় তাদের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটি বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে প্রস্তাব দেয়, আব্বা! আমি গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে করার প্রয়োজন মনে করছি। আর বাপ মা বলে, তোর এখনো লেখা-পড়াই শেষ হয়নি, বিয়ে করে বউকে খাওয়াবি কোত্থেকে?
(এর উত্তরে আমরা বলবো,) কেন, সে কি পড়াশুনার পাশাপাশি দু’একটা টিউশনি করে কিছু রোজগার করতে পারবে না? যদি না-ও পারে তাহলে আপনার প্রিয় রাসূল তো বলেই গেছেন, طعام الواحد يكفي الإثنين একজনের খাবার দু’জনের জন্য যথেষ্ট। দু’জনের খাবার তিন জনের জন্য যথেষ্ট। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২০৫৯)
আপনার ফ্যামিলিতে দু’চারজন সদস্য অবশ্যই আছে, আরেক জন আসলে কি তার জন্য ব্যবস্থা হবে না? অবশ্যই হবে। তো পড়া লেখা শেষ হওয়ার দরকার নেই। বালেগ হলেই বিয়ে দিয়ে দেন। রিযিকের মালিক আল্লাহ।
খ. দ্বিতীয় ভূত হল সিরিয়াল রক্ষা করা। যেমন, এক ছেলে দীনদার, আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে যায়। সে গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে করতে চায়, কিন্তু সিরিয়ালে তিন নম্বরে। অর্থাৎ তার আগে আরো দু’জন রয়ে গেছে। তখন বাবা মা বলে, আরে! তোর আগে তো আরও দুইজন রয়ে গেছে। তাদেরকে বাদ দিয়ে তোকে বিয়ে করাব কিভাবে?
প্রিয় পাঠক! শরী‘আতে কোন সিরিয়াল নেই। যার যখন পাত্র/পাত্রী পাওয়া যাবে, বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। এর বড় দলীল হল, হযরত মূসা আ. যখন ফেরাউনের রাজত্ব থেকে সঙ্গোপনে হযরত শুআইব আ. এর দেশে হিজরত করলেন।
আর শুআইব আ. তাঁর কন্যাদের কাছ থেকে হযরত মূসা আ. এর দীনদারীর এ বর্ণনা শুনলেন যে, আসার সময় কন্যারা যখন তার আগে আগে চলে তাকে রাস্তা দেখাচ্ছিল তখন মূসা আ. তাদেরকে বলেছেন যে, তোমরা আমার পেছন পেছন আসো এবং পেছন থেকেই রাস্তা বাতলে দাও।
এতে হযরত শুআইব আ. বুঝতে পারলেন, এই ব্যক্তি ভবিষ্যতে বড় কিছু হবেন। তখন তিনি হযরত মূসা আ. কে প্রস্তাব পেশ করলেন- দেখ, আমার দুই মেয়ের মধ্যে যাকে তোমার পছন্দ হয় তাকে তোমার সাথে বিয়ে দিব। (সূরা কাসাস, ২৭)।
দেখুন, তিনি বলেছেন- احدى ابنتيَّ هتين ‘আমার এই দুই মেয়ের কোন একজন’। একথা বলেননি, বড়জন কে বিয়ে দিব, বরং বলেছেন, দু’জনের যাকেই তোমার পছন্দ হয়…। অথচ আমাদের দেশে সিরিয়াল রক্ষা করাকে জরুরী মনে করা হয়। ফলে সিরিয়াল ভেঙ্গে কেউই ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চায় না।
এভাবে সময়মত বিয়ে-শাদী না দেওয়ার কারণে আজ আমাদের ছেলে-মেয়েরা বখে যাচ্ছে, ইন্টারনেটে যত পাপাচার আছে সেগুলো দেখে দেহ-মন সব নষ্ট করে ফেলছে।
কাজেই সচেতন অভিভাবকদেরকে বলছি, আপনারা আপনাদের ছেলে-মেয়েকে গুনাহ থেকে বাঁচান, মোবাইল, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার থেকেও বাঁচান এবং সময়মতো বিবাহ দিয়ে তাদের গুনাহমুক্ত ইসলামী যিন্দেগী যাপনের সুযোগ করে দিন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সহজ সরল ও পাপমুক্ত জীবন যাপন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
সূত্র: darsemansoor.com