মুফতী মানসূরুল হক
শাইখুল হাদিস ও প্রধান মুফতি, জামিয়া রাহমানিয়া (আলী এন্ড নুর রিয়েল এস্টেট) ঢাকা
১. যেহেতু ইলমে দীন শিক্ষা করা ফরযে আইন এবং দীনী মাহফিলের দ্বারা আসল উদ্দেশ্য ইলমে দীন শিক্ষা করা। সুতরাং প্রত্যেক এলাকায় হক্কানী উলামায়ে কিরামের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অনাড়ম্বরভাবে বৎসরে একাধিক বার দীনী মাহফিল করা উচিত। (সূরায়ে তাওবা:১২২, ইবনে মাজা হাদীস নং ২২৪, বাইহাকী হাদীস নং ১৬৬৬)
২. হক্কানী আল্লাহওয়ালা উলামায়ে কিরামকে দাওয়াত দিবে। বিশেষ করে যারা ওয়াজের বিনিময় গ্রহণ করেন না এমন বক্তাকে দাওয়াত দেয়ার ব্যাপারে প্রাধান্য দিবে। কারণ ওয়াজ করা আম্বিয়ায়ে কেরাম আ.-এর কাজ। আর এ কাজ দ্বারা তখনই উম্মতের ফায়িদা হয় যখন তা নবীগণ আ.-এর তরীকায় করা হয়।
আর কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে আছে যে, নবীগণ আ. ওয়াজের বিনিময় গ্রহণ করতেন না। তাঁরা একমাত্র আল্লাহ থেকে বিনিময় পাওয়ার আশায় ওয়াজ করতেন। (সূরায়ে ইয়াসীন:২১ শু‘আরা: ১২৭)
৩. যেহেতু লম্বা ওয়াজ সাধারণ মানুষ মনে রাখতে পারে না। এজন্য রাত ১০/১১টার মধ্যেই আলোচনা করে মাহফিল শেষ করবে। আজকাল অনেক স্থানে সারা রাত ওয়াজ করার নিয়ম চালু হয়ে গেছে। এটা বন্ধ করা উচিত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ততক্ষণ ওয়াজ করতে বলেছেন যতক্ষণ লোকদের আগ্রহ থাকে। আর মানুষের কমজোরীর কারণে সারা রাত আগ্রহ থাকে না। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭)
৪. ওয়াজের মাঝে সময়মত ইশার নামায জামা‘আত কায়েম করে পড়ে নিবে। যাতে মাহফিলের মাইকের দ্বারা পার্শ্ববর্তী এলাকার মসজিদের জামা‘আতের কোন ধরনের সমস্যা না হয়, মুসল্লীগণ ইশার জামা‘আতের ব্যাপারে পেরেশান না হয়। এবং ওয়াজ শেষ করে ইশার নামায মাকরূহ সময়ে পড়তে না হয়। (সুরায়ে নিসা: ১০৩, বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬২৪৫)
৫. মাহফিলের মধ্যে কোন হক্কানী পীর শ্রোতাদের যিকিরের মশক্ করাইতে চাইলে মাইক ছাড়াই করাবে। মাইকে যিকির করা শরী‘আতের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় নয়। এতে আশপাশের মসজিদে এবং লোকদের অনেক সমস্যা হয়। এবং এটা যিকরে জলীর মধ্যেও পড়ে ।
তাছাড়া আজকাল হক্বানী পীর নয় এমন বক্তাও নিজের খেয়াল-খুশী মত যিকির করাতে আরম্ভ করে। এটাও ঠিক নয়। (সুরায়ে আ‘রাফ: ২০৫, মুসনাদে আহমাদ হাদীস নং ১৯৪৯৫)
৬. মাহফিলের মধ্যে সুন্নাতের আলোচনা করবে এবং নামাযসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আমলের বাস্তব প্রশিক্ষণ দিবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বরং এটা মাহফিলের মূল উদ্দেশ্যও বটে। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৭৭)
৭. বয়ানের মধ্যে তারগীবী কথার সাথে যে পাঁচটি বিষয় ফরযে আইন তথা: আক্কাইদ, ইবাদাত, মু‘আমালাত (লেন-দেন), মু‘আশারাত (সামাজিকতা) এবং আখলাক (আত্মশুদ্ধি) তার উপর আলোচনা রাখবে। এরজন্য ওয়ায়েজীনদের মধ্যে ওয়াজের বিষয় বস্তু বন্টন করে দেয়া ভাল। (সূরায়ে বাকারা:১৭৭, বুখারী শরীফ হাঃ নং ৫০, মুসলিম শরীফ হাঃ নং ৯)
৮. লোকদের ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াত দিয়ে তাদের থেকে চাঁদা কালেকশন করবে না। কারণ প্রচারপত্রে ওয়াজ শুনানোর ঘোষণা বা ওয়াদা করা হয়। চাঁদার প্রয়োজন হলে জনসাধারণদের ডেকে পরামর্শ সভা করবে এবং সাহায্যের আবেদন করবে। (সূরায়ে বাকারা: ৪০)
৯. ওয়াজের মধ্যে ভিত্তিহীন কিস্সা-কাহিনী বলে শ্রোতাদের হাসানো বা কাঁদানোর বদ রসম বন্ধ করে দিবে। (মুসলিম শরীফ হাদীস নং ৫০৫)
১০. কোন জাহেলকে বক্তা বানাবে না। চাই সে যত সুন্দর বয়ানই করুক না কেন। কারণ এটা ক্বিয়ামতের আলামত। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৫৯, ১০০)
১১. চুক্তি করে ওয়াজের বিনিময় নেয়া বক্তাকে বা ফাসেদ আক্বীদাহ ও বে-আমল আলেম এবং টি ভি-এর কোন আলেমকে বক্তা বানাবে না। কারণ এধরনের বক্তার বয়ানের দ্বারা জনগণের মধ্যে দীনের পরিবর্তে বদ দীনী সৃষ্টি হয়। (সূরায়ে বাকারা: ৪৪, মুসলিম শরীফ ১/৮৪, শু‘আবুল ঈমান-বাইহাকী হাঃ নং ৯০১৬, ৯০১৮)
১২. ওয়াজের শেষে আম দাওয়াত ও শিরনী তাবরকের নামে কোন কিছু বিতরণের ব্যবস্থা করবে না। এতে লোকদের তাওয়াজ্জুহ ওয়াজের দিকে না থেকে খানার দিকে থাকে। সেক্ষেত্রে বয়ানের দ্বারা কোন উপকার হয় না। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ২৬৯৭, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ১৭১৮, রদ্দুল মুহতার: ২/১৪০)
১৩. ওয়াজ মাহফিল জমানোর জন্য কুরআন তিলাওয়াত করাবে না। কারণ এ কাজের জন্য কুরআন নাযিল হয়নি। এর পরিবর্তে গজল ইত্যাদি পড়তে পারবে বা ছাত্রদের বিভিন্ন প্রদর্শনী পেশ করতে পারে। নিয়মিত বয়ান-ওয়াজ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে খায়ের ও বরকতের জন্য তিলাওয়াতের দ্বারা শুরু করবে। তিলাওয়াতের সময় সকলেই কুরআন তিলাওয়াতে মনযোগ দিবে ও তিলাওয়াতের আদবের দিকে লক্ষ রেখে শুনবে। (আলমগীরী:৫/৩১৫, রদ্দুল মুহতার: ১/৫১৮)
১৪. মাহফিলের রাস্তার মধ্যে কোন গেইট বা তোরণ বানাবে না। বা রঙ বেরঙের পতাকা লাগাবে না। এ গুলি অমুসলিমদের অনুকরণ। তেমনি ভাবে ষ্টেজের মধ্যে কোন আলোক সজ্জা করবে না। প্রয়োজনীয় লাইটের অতিরিক্ত লাইট লাগাবে না। এগুলি অপচয়। মাহফিলের বাইরে দূরে দূরে মাইক লাগাবে না। কারণ এর দ্বারা লোকদেরকে অনর্থক বিরক্ত করা হয়। (সূরায়ে বনী ইসরাইল: ২৭, ইবনে মাজা হাদীস নং ৪২৫, যিকর ও ফিকর: ২৫)
১৫. প্রচারপত্রে দিন তারিখ ও স্থান উল্লেখ করবে। বক্তাদের নাম ঘোষণার প্রয়োজন নেই। মানুষদেরকে ব্যক্তির আকর্ষণে জমা করবে না। বরং দীনের আকর্ষণে জমা করবে। কারণ ব্যক্তি চিরকাল থাকে না । এমনকি আল্লাহ না করুক অনেক ব্যক্তি হকের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ হেদায়েত করেন। আমীন! (মিশকাতুল মাসাবীহ হাদীস নং ১৯৩)
১৬. অনেক বক্তা চা পানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষে লোকদের মীলাদ-দুরূদে লাগিয়ে সে সুযোগে চা পান করেন । এটা দৃষ্টিকটু কাজ। দীনী উদ্দেশ্যবিহীন এধরণের দরূদ পড়াও নিষেধ। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭, ফাতহুল বারী: ১১/১৬৭)
১৭. চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে মাহফিল করবে না । এতে লোকদের কষ্ট দেয়া হয়, যা শরী‘আত বিরোধী কাজ। সুতরাং মসজিদ বা কোন মাঠ-ময়দানের মধ্যে মাহফিলের ব্যবস্থা করবে । (যিকর ও ফিকর: ১৪৩)
১৮. প্রকাশ্য ফাসেক বে-আমল কোন লোককে মাহফিলের সভাপতি বা পরিচালক কিংবা বিশেষ অতিথি ইত্যাদি বানাবে না। এতে খোদাদ্রোহীদের সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এতে আল্লাহর আরশ কম্পিত হয়। এটা হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৫৯)
১৯. মাহফিলের কোন ছবি এবং কোন প্রকার ভিডিও করে রাখবে না। এগুলো সব হারাম। এতে দীনী মাহফিলের লক্ষ-উদ্দেশ্য বরবাদ হয়ে যায়। এবং বদ দীনী ও গোমরাহী কায়েম হয়। (বুখারী শরীফ: ২/৮৮০, মুসলিম শরীফ: ২/২০০)
২০. কোন বক্তার আগমনে না‘রায়ে তাকবীর বা অন্য কোন শ্লোগান দিবে না । এটা সুন্নাতের খেলাফ। বিশেষ করে ওয়াজের মধ্যে কোন বক্তার আগমনে বক্তার বয়ান বন্ধ করে কোন কথার শ্লোগান দিবে না।
কুরআন-সুন্নাহ এর আলোচনা অনেক উচু কাজ। কারো আগমনে তা বন্ধ করার অবকাশ নাই। কোন বক্তার ব্যাপারে “প্রধান আকর্ষন” “জলসার মধ্য মনি” ইত্যদি বলে অন্যান্য উলামাদের খাট করবে না। কারণ সকলেই হক্বানী আলেম। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭, ফাতহুল বারী: ১১/১৬৭)
সূত্র: www.darsemansoor.com
পুরুষদের যে অভ্যাসগুলো বর্জন করতে হবে