মাসুদুল হক: পান তো নয়, যেন আগুনের গোলা! জ্বলন্ত পান মুখে পুরে এই কথাটিই মনে হবে আপনার। ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর বটে!
রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামঘেঁষা অনুশীলন মাঠের পাশের একটি গলিতেই সেলিম টি স্টল। কাঁচা মরিচ থেকে কতবেল—চায়ে মেশাতে তিনি কিছুই বাদ রাখেননি। এই দোকানের পাশেই পানের দোকান। ‘সেলিম স্পেশাল পান বিতান’।
সেদিন পানের দোকানে ছোট একটা কাগজে চোখ আটকে গিয়েছিল। ছাপার হরফে লেখা, ‘ফায়ার পান পাওয়া যায়—দাম ৫০ টাকা!’ ফায়ার বা আগুনে পানের কথা ফেসবুকে চোখে পড়েছিল।
পানের দোকানে যিনি বসে ছিলেন, তিনি সদা হাস্যোজ্জ্বল। আমাদের দেখেই একগাল হেসে দিলেন। জানতে চাইলেন, পান খাব কি না। তাঁর প্রশ্নে হ্যাঁ-না জানানোর আগেই আলাপ জমে উঠেছিল। তাঁর নাম আবদুল জলিল হাওলাদার। সেলিম চা স্টলের সেলিম তাঁর ছোট ভাই।
২০০৪ সাল থেকে শাহি মিষ্টি পানের ব্যবসা তাঁর। মাস তিনেক আগে যুক্ত করেছেন ‘ফায়ার’ পান। ফায়ার পান বানানোর কৌশল তিনি ইন্টারনেটে দেখেছেন। বানানোর কৌশল রপ্ত করেছেন পুরান ঢাকার একটি শাহি মিষ্টি পানের দোকানে। পাশের চায়ের দোকানে যেহেতু তরুণদের ওঠাবসা, তাই তরুণদের জন্যই শাহি মিষ্টি পানের ব্যবসায় নতুন পদটি যুক্ত করেছেন তিনি।
মূলত শাহি মিষ্টি পানের উপকরণগুলোর সঙ্গে বাড়তি কিছু মসলা যোগ করে বানানো হয় ফায়ার পান। কী কী দেওয়া হয় এই পানে? কিছুটা সন্দেহ হলো তাঁর। পাছে রেসিপি বেহাত হয়ে যায়!
সেই সংশয় অবশ্য কেটেও গেল। কুমড়ার মোরব্বা, খেজুর, শুকনা নারকেল, কাঁচা নারকেল, কালোজিরা, মধু, বাদাম, কিশমিশসহ কী কী মিশিয়ে তিনি এ পান বানান, তাঁর সবই সেদিন তিনি বলেছিলেন। তবে অবাক হয়েছি শুনে—ফায়ার পানে জর্দা, চুন অথবা সুপারি দেওয়া হয় না।
আবদুল জলিলের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনজন এলেন। বন্ধুরা মিলে এসেছেন আগুনে পান খাবেন বলে। আবদুল জলিল ফায়ার পান বানানো শুরু করলেন, আমাদের আগ্রহ যিনি ফায়ার পানটা খাবেন তাঁর দিকে। দেখে মনে হলো, তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন।
আবদুল জলিল ফায়ার পান বানিয়ে লোকটির মুখের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। উনি হাঁ করে পানটা মুখে পুরেই চিবাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পান চিবানোর পরে সব ভয়-ডর নিমেষেই গায়েব। চেহারায় বিজয়ীর হাসি।
বিজয়ী মাঈনুল হাসান বললেন, ‘কৌতূহল থেকেই পানটা খাওয়া। বন্ধুদের সামনে এই ফায়ার পান খাওয়ার ব্যাপারটার মধ্যে একধরনের বীরত্বও কাজ করে হয়তো!’
ফায়ার বানাতে প্রথমে কাঁচা পানের ওপর সব ধরনের মসলা দেওয়া হয়। সবশেষে দেওয়া হয় নারিকেলি। এই নারিকেলিতেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর পানটাকে গোলার মতো বানিয়ে পুরে দেওয়া হয় মুখে। এই মুখে পুরে দেওয়ার কাজটি আবদুল জলিল নিজেই করেন। কারণ? ‘পানটা কৌশলে মুখের ভেতর দিতে হয়। সবাই তা পারে না। আবার অনেকে ভয় পায়, তাই নিজেই খাওয়াইয়া দেই।’ বলছিলেন আবদুল জলিল।
পান বানিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন আবদুল জলিল
তবে, কারও মুখে ফোসকা পড়ার ঘটনা নাকি ঘটেনি। তিনি অবশ্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও জেনে নিয়েছেন। পানের গোলাটা মুখের ভেতরে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অক্সিজেন শূন্যতায় আগুন দপ করে নিভে যায়।
গড়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০টা শাহি মিষ্টি পান এবং ২০-৩০টা ফায়ার পান বিক্রি করেন তিনি। শাহি পানের মূল্য ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত হয়। বিভিন্ন উৎসবে এসব পান বিক্রির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়।
সেদিন আমরাও স্বাদ নিয়েছিলাম ফায়ার পানের। সে ফায়ার পান চিবোতে চিবোতে আরও অনেক কথা হয়েছিল ৩৮ বছর বয়সী আবদুল জলিলের সঙ্গে। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছোট সংসার তাঁর। ছেলেটা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি। তাঁর স্বপ্ন—একদিন সব মানুষ এসব ছোট ছোট ভয়কে জয় করবে।
সেটা ফায়ার পান দিয়েই হোক অথবা অন্য কোনোভাবে। সাহসী মানুষদের মুখের মধ্যে আগুনের গোলা পুরে দিতে কখনোই ভয় লাগে না তাঁর। তবে আবদুল জলিলের ভয় লাগে, যারা ভয় পায় তাদের খাওয়াতে। নিজে কখনোই ফায়ার পান খেতে পারেননি। কারণ, তাঁকে ফায়ার পান খাইয়ে দেওয়ার মানুষ নেই।
সূত্র: ছুটির দিনে
যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সাক্ষাৎকার