সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে কবি ও অনুসন্ধানী লেখক সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর রচিত প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘প্রিয়তমা’। রাসুল মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর স্ত্রীদের দাম্পত্যজীবন নিয়ে রচিত এ গ্রন্থটি নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। কেন এত আলোচিত হচ্ছে গ্রন্থটি, কী বিষয়ে লেখা গ্রন্থটি, কেন গ্রন্থের নাম প্রিয়তমা- এসব বিষয় জানতে গ্রন্থের লেখক সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর-এর মুখোমুখি হয়েছিলেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের নির্বাহী সম্পাদক রোকন রাইয়ান।
আপনার নতুন বই ‘প্রিয়তমা’ নির্মাণের প্রেক্ষাপট কী?
প্রথম প্রেক্ষাপট খুব সামান্য। একটি বই পড়তে গিয়ে রাসুল মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর স্ত্রী আয়েশা রা.-এর দাম্পত্যজীবনের একটি চমৎকার ঘটনা পেলাম। ঘটনাটি আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিলো- এতো সুন্দর ছিল তাঁদের দাম্পত্যজীবন?
দেরি না করে ঘটনাটি আমি গল্পের মতো দাঁড় করিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করলাম। ফেসবুকে পোস্ট করার পর পাঠকদের অভূতপূর্ব সাড়া পেলাম। বিভিন্ন ব্যক্তি, গ্রুপ ও পেজ গল্পটি বিপুলভাবে শেয়ার করা শুরু করলেন। ফেসবুকে এটি ছিল আমার সর্বোচ্চ শেয়ার হওয়া পোস্ট।
তখন আমার বোধোদয় হলো, নিশ্চয় এ ধরনের পবিত্র ভালোবাসার গল্প পাঠককে আন্দোলিত করে। রাসুলের দাম্পত্যজীবনের অসংখ্য প্রেমময় ঘটনা আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। এগুলো মানুষকে জানাতে হবে, তাঁদের বুঝাতে হবে- সত্যিকারের প্রেম আসলে এমন হয়। সেই ভাবনা থেকেই ‘প্রিয়তমা’ লেখার অনুপ্রেরণা।
দ্বিতীয়ত: আমি ইতিহাস পড়তে এবং ইতিহাস নিয়ে লেখতে পছন্দ করি। তবে আমি ইতিহাসকে আমার মতো করে উপস্থাপন করতে ভালোবাসি। পুরোপুরি এ সময়ের ভাষা, প্রাঞ্জল আধুনিক গদ্য, অভিনব উপস্থাপনায় মানুষের কাছে ইসলামের অনুপম দিকগুলো তুলে ধরতে চাই। সাধারণ ভাষায় রাসুলের দাম্পত্যজীবন লিখলে ক’জনই বা সেসব পড়ে? রাসুল ও তাঁর স্ত্রীদের দাম্পত্যজীবনকে তেমন ফিকশন আকারে উপস্থাপন করাটাও ছিল একটি বড় কারণ।
বইটা নবীজি সা.-এর স্ত্রীদের নিয়ে, অথচ প্রিয়তমা শব্দটা বহুল ব্যবহারে অনেকটাই বাজারি প্রেমের সাদৃশ্য পেয়েছে। একটু বেখাপ্পা লাগছে না?
বইয়ের নামটি আমি অনেক গবেষণা করার পরই নির্ধারণ করেছি। বই লেখা শুরু করার পর পরই আমার মাথায় এসেছে বইয়ের নাম কী হবে?
‘উম্মুল মুমিনিনদের জীবনী’ বা ‘রাসুলপত্নীদের জীবনের গল্প’ অথবা ‘রাসুলের দাম্পত্যজীবন’ এসবই খুব গৎবাঁধা নাম। আর এমন নামে বাজারে অনেক বইও আছে।
আমার বইয়ের নামটিও যদি তেমনই হয় তাহলে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে আমার বইয়ের তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না। কিন্তু এ বইটি কোনো অর্থেই বাজারের আর দশটা বইয়ের মতো নয়। এর কাহিনিবিন্যাস, গল্পের ঢং, ভাষাব্যবহার সবকিছুই অভিনব।
এ কারণে চিন্তা করছিলাম নতুন কিছু, অভিনব; একই সাথে মার্জিত। আমার এ দুশ্চিন্তার অবসান ঘটলো রাসুলের সাহাবি উমর ইবনে খাত্তাব রা. বর্ণিত একটি হাদিসের মাধ্যমে।
এক স্থানে তিনি আয়েশা রা.-এর ব্যাপারে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন ‘হিয়্যা হাবিবাতুর রাসুল’। যার সহজ বাংলা অর্থ- ‘তিনি রাসুলের প্রিয়তমা’।
এটি পড়ার পর আমার মনে আর কোনো দ্বিধা কাজ করেনি, বইয়ের নাম রাখলাম ‘প্রিয়তমা’। যেখানে উমর রা.-এর মতো সাহাবি রাসুলের স্ত্রীকে ‘রাসুলের প্রিয়তমা’ বলে সম্বোধন করতে পারেন সেখানে আমরাও তাঁদের রাসুলের ‘প্রিয়তমা’ বলতে পারি।
বাস্তবিকপক্ষে তাঁরা রাসুলের প্রিয়তমাই ছিলেন। প্রত্যেকজন স্ত্রীর প্রতি রাসুলের যে ভালোবাসা ছিল তাতে মনে হতো, প্রত্যেক স্ত্রীই রাসুলের ‘প্রিয়তমা’। এটা নিয়ে বেখাপ্পা লাগার কিছু নেই। যদি কারো বেখাপ্পা লাগে তবে আমি বলবো তাঁর অধ্যয়নের অভাব, রাসুল ও তাঁর স্ত্রীদের প্রেমময় দাম্পত্য ভালোবাসাকে জানার কমতি।
নবীজির স্ত্রীদের নিয়ে অনেক ধরনের বই আছে বাজারে, আপনার বইয়ের ভিন্নতা কী?
এককথায় বললে- পুরোটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। ‘প্রিয়তমা’ লিখতে রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে অনেক বাংলা, আরবি, উর্দু, ইংরেজি বই পড়তে হয়েছে। কিন্তু প্রিয়তমার মতো বিশদ এবং জীবনঘনিষ্ঠ কোনোটিই নয়।
আমি আগেই বলেছি, ইসলামের ইতিহাসকে আমি আধুনিক ভাষাশৈলী ও অভিনব উপস্থাপনায় পাঠকের সামনে তুলে ধরতে ইচ্ছুক। সে ইচ্ছা থেকেই আমি উম্মুল মুমিনিনদের জীবনকে ভিন্ন আলোয় আলোকিত করার চেষ্টা করেছি।
এটা অনেকটা উপন্যাস, অনেকটা গল্প আবার অনেকটা ইতিহাসের স্বাদ দেবে পাঠককে। কিন্তু সিরাত ও হাদিসের সীমারেখা মোটেও লঙ্ঘন করা হয়নি কোথাও। এটাই ‘প্রিয়তমা’র বৈশিষ্ট্য।
‘প্রিয়তমা’ পাঠককে কতটা আলোড়িত করবে বলে আশা করছেন?
বইটি পাঠককে কতটা আলোড়িত করবে, এটা আমিও জানি না। আর এটা জানা আমার জন্য খুব বেশি দরকারও নেই। আমি লিখতে ভালোবাসি।
‘প্রিয়তমা’ লিখতে গিয়ে যে আনন্দ আমি পেয়েছি, পাঠক কি বই পড়ে সে আনন্দ লাভ করতে পারবে? রাসুল ও আয়েশা বা খাদিজার ভালোবাসার কাহিনিকাব্য লিখে আমি যে আনন্দের অশ্রুজলে ভেসেছি, পাঠক কি আমার সে অশ্রুর দাম দিতে পারবে?
একটি বই লেখার মধ্যে লেখকের যে আনন্দ, পাঠক তার খুব কমই স্পর্শ করতে পারেন।
তবু বলবো, এ বইটি বাংলাদেশের বইয়ের ইতিহাসে একটি বেস্টসেলার বই হোক। এটি লেখক হিসেবে নয়, একজন রাসুলপ্রেমী মুসলিম হিসেবে আমার কামনা। রাসুলের দাম্পত্যজীবনের ছায়ায় যারা নিজেদের দাম্পত্য ভালোবাসা দৃঢ় করতে চান, তাদের জন্য এর চেয়ে ভালো বই খুব একটা নেই বাংলাভাষায়।
মাস ছয়েক আগে আপনার কবিতার বই ‘ইয়া আফরোজা ইয়া আফরোজা’ বের হলো। বছর না যেতেই আরেকটি ঢাউস বই। কোন মন্ত্রবলে এত লিখছেন?
এটা মন্ত্রবলের কোনো ব্যাপার নয়। বরং আমার তো মাঝে মাঝে আফসোস হয়, কেন আরও বেশি লিখছি না? দুটো কারণে আমার আরও বেশি লেখা দরকার।
এক. খোদা তায়ালা যেহেতু আমাকে লেখার সামান্য ক্ষমতা দিয়েছেন, এ কারণে এ ক্ষমতা কাজে লাগানো আমার জন্য ওয়াজিব। লেখালেখি গুণটা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের দান, সবাইকে দেন না। আমাকে সামান্য দিয়েছেন, আমার উচিত এই অনুগ্রহকে পুরোপুরি কাজে লাগানো।
দুই. আমাদের তরুণদের মাঝে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে যারা ইসলাম নিয়ে লেখালেখি করে থাকেন তাঁরা অনিশ্চয়তার মধ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলছেন- আমরা কী লিখবো বা কী লিখবো না, কীভাবে লিখবো, কেন লিখবো- এসব ব্যাপার নিয়ে তাঁরা নির্দিষ্ট কোনো পথ পাচ্ছে না।
এত বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর তরুণশ্রেণির প্রতিভাকে তো এভাবে উদ্দিষ্টহীনভাবে আপনি গলা টিপে হত্যা করতে পারেন না। তাঁর প্রতিভাকে আপনি ব্যবহার করতে পারছেন না, এটা আপনার অপারগতা। আপনার অপারগতায় আরেকজনের প্রতিভাকে কোন অধিকারে আপনি ধ্বংস করবেন?
এসব কারণে আমি কবিতার বই করেছি, গল্প লিখেছি, প্রবন্ধ লিখেছি, এখন গল্পভাষ্য লিখলাম; ভবিষ্যতে হয়তো উপন্যাস লিখবো, আরও অনেক কিছু লিখবো।
এর সব কিছুই আগামী তরুণদের সাহস যোগাক, তাদের পাটাতন দৃঢ় করুক। আমি অনিশ্চিত তরুণদের দৃঢ়পদ বাধাহীন হওয়ার স্বপ্ন দেখি। গণ্ডির শৃংখলে থেকে কখনো সৃষ্টিশীল কিছু সৃষ্টি করা যায় না।
আপনার প্রকাশিত বই কয়টি? সবগুলোর মধ্যে সেরা কোনটি? প্রিয়তমা কি সেরার তালিকায় থাকবে?
‘প্রিয়তমা’ নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনেরো। হ্যাঁ, প্রিয়তমাকে সেরার তালিকায় সবার উপরে রাখবো। প্রায় দেড় বছর ধরে গবেষণা-অনুসন্ধান করে লিখতে হয়েছে বইটি, প্রিয় হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তবে ইংরেজি থেকে অনূদিত ‘দ্য অ্যাডমিরাল’ বইটিও আমার অনেক প্রিয়। এছাড়াও আমার গল্পের ৭টি বইও অনেক প্রিয়। এ বইগুলোর কিছু গল্প লিখতে গিয়ে আমি বহুবার কেঁদেছি। কিছু গল্প পড়লে এখনও কান্না পায়। সবই প্রিয়, সন্তানের মতো।
কবিতা না গল্প? একটা লিখতে বললে কোনটা বেছে নেবেন?
অবশ্যই কবিতা। কবিতার মতো তৃপ্তির কিছু নেই আর। গল্প-উপন্যাস যদি হৃদয়ের খোরাক হয়, তবে কবিতা আত্মার খোরাক। আমি মাঝে মাঝে বন্ধুদের বলি, একটা কবিতা লেখা আর একটা সাম্রাজ্য জয় করা সমান আনন্দের।
আমি কোনোদিন লেখক হতে চাইনি, হয়তো কবি হতে চেয়েছি। লেখক হওয়া অনেকটা বৈষয়িক বিষয়, কিন্তু কবি হওয়া আধ্যাত্মিক বিষয়।
আরেকটি বিষয়। আমি কতটা কবি হতে পেরেছি, এটা জানার জন্যই আমি আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করি। অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এ বই নিয়ে, ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয়ই। তাতে আমার বিন্দুমাত্র কিছু যায় আসেনি। কেননা আমি কবিতা লিখি নিজের জন্য।
কবিতা যদি আপনার রক্তে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়, আপনি তো অন্যের তুষ্টির জন্য অপেক্ষা করবেন না। কবিতাই একমাত্র স্বাধীন লেখ্যসাহিত্য। বাকিসব নানা তুষ্টিতে ভরপুর।
তবে কবিতা লেখার একটা বড় উপকার হলো, কবিতা আপনার গদ্যকে মার্জিত করবে, আপনার গল্পকে সুললিত করবে। এ কারণে কবিদের উচিত বেশি বেশি গল্প-উপন্যাস লেখা।
সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।