হাফেজ মুফতি রিদওয়ানুল কাদির
আওয়ার ইসলাম
মাওলানা নুরুল ইসলাম। মিয়ানমারের আরেকজন বয়োবৃদ্ধ মজলুম মুহাদ্দিস। আজ এই প্রবীণ মুহাদ্দিস সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করবো। যার পুরো জীবন অনেক কষ্ট আর সংগ্রামে ভরপুর।
শৈশবকাল
মাওলানা নুরুল ইসলামের জন্ম বার্মার উত্তর মংডুর সিংগিরপাড়া গ্রামে। এখানেই বেড়ে উঠেছেন তিনি।
পড়ালেখা
পারিবারিক আবহে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর লেখাপড়া করেছেন বার্মার বিভিন্ন প্রসিদ্ধ দ্বীনি বিদ্যাপীঠে। এরপর উচ্চশিক্ষা লাভের মহান ব্রত নিয়ে হিজরত করেন বাংলাদেশে। ভর্তি হন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনি বিদ্যাপীঠ আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ায়।
১৩৯৯ হিজরীতে জামিয়া পটিয়ায় দ্বীনি শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন।
শিক্ষকবৃন্দ
জামিয়া পটিয়ায় তিনি যেসব মহীরুহের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, তন্মধ্যে খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ রহ., আল্লামা ইমাম আহমদ রহ., আল্লামা আমীর হোসাইন প্রকাশ মীর রহ., আল্লামা আলী আহমদ বোয়ালভী রহ., ফকীহুল মিল্লাত আল্লামা মুফতী আব্দুর রহমান রহ., আল্লামা নুরুল ইসলাম কদীম রহ. প্রমুখ অন্যতম।
কর্মজীবন
বাংলাদেশে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে দ্বীন প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে পাড়ি জমান স্বদেশ বার্মায়। যোগদান করেন বার্মার প্রসিদ্ধ দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম, মিয়াজামপুর, উত্তর মংডু। সেখানে দীর্ঘদিন দরসে-তাদরিসের খেদমত আঞ্জাম দেন।
হাদীসের খেদমতে
মিয়াজামপুর মাদরাসায় তিনি সিহাহ সিত্তার কিতাবসহ অসংখ্য কিতাবের দরস দান করেন। তহাবী শরিফ, মুল্লা হাসান, শরহুল আকায়িদিন নাসাফিয়্যাহ, সুল্লামুল উলুম, মায়বুজীসহ আরো অসংখ্য জটিল ও দুর্বোধ্য কিতাবের দীর্ঘদিন অত্যন্ত সুনামের সাথে দরস দেন।
এছাড়া মাঝখানে দুই বছর তিনি বার্মার আরেকটি প্রসিদ্ধ বিদ্যাপীঠ মাদরাসা রশিদিয়া চালিপ্রাং এ খেদমত করেন। সেখানে তিনি সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, তিরমিজি শরিফের পাঠদান করেন।
তার ছাত্রের ফিরিস্তিও অতি দীর্ঘ। যারা বার্মায় বিভিন্ন দ্বীনি খেদমতে আত্মনিয়োগ করেছিলো।
মাদরাসা পরিচালনা
বার্মার শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম, মিয়াজামপুরে তিনি দীর্ঘদিন যথেষ্ট সুনামের সাথে পাঠদানে ব্যাপৃত হন। অবশেষে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তার কর্মকাণ্ডের উপর সন্তুষ্ট হয়ে সর্বসম্মতভাবে তাকে মিয়াজামপুর মাদরাসা পরিচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে। তখন থেকে দীর্ঘ ২৩ বছর তিনি শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জুলুমের দাস্তান
২০১৪ সনে বার্মিজ মিলিটারিরা হঠাৎ করে মুসলমানদেরকে ঢালাওভাবে ধরপাকড় শুরু করে। তখন সাধারণ মুসলমানদের সাথে সাথে অসংখ্য বয়োবৃদ্ধ আলেম-ওলামাদেরকেও গ্রেফতার করে বার্মিজ সেনাবাহিনী। তেমনই এক দুর্দিনে সেনাবাহিনীর হাতে মসজিদ থেকে গ্রেফতার হন মাওলানা নুরুল ইসলাম।
২০১৪, ১৫ ও ১৬ সন, এই তিন বছর তিনি জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটান। এই তিন বছর তিনি যে অনির্বচনীয় জুলুমের শিকার হয়েছিলেন, তা বর্ণনায় তার চোখ বারবার সিক্ত হয়ে যাচ্ছিলো।
তার ভাষায়, বার্মার কারাগারটা মুসলমানদের জন্য ছিলো সাক্ষাৎ নরক। এমন কোন শাস্তি ছিলো না, যা তারা আমাদের দিত না। কয়েকদিন ভাত দেয়া বন্ধ করে দিতো। মাঝেমধ্যে বাসী ভাত দেয়া হতো। তরকারি বলতে শুধু ডালই বরাদ্দ থাকতো আমাদের জন্যে।
অযু করার জন্য পানি চাইলেই বেদম প্রহার করতো। মা-বোনদের উপর চলতো নির্যাতনের স্টিম রুলার। মা বোনদের উপর এমন সব নির্যাতন করতো, যা বলতেও মুখে বাঁধে। সেনাবাহিনীরা পালাক্রমে জনসম্মুক্ষে তাদেরকে ধর্ষণ করতো।
পারিবারিক জীবন
সাংসারিক জীবনে মাওলানা নুরুল ইসলাম ১০ সন্তানের জনক। তাদের মধ্যে চার সন্তান পরিপূর্ণ আলেম। তারা হলেন যথাক্রমে-
১. মাওলানা আব্দুল আযীয।
২. মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব।
৩. মাওলানা আব্দুল আহাদ।
৪. মাওলানা আব্দুল হালীম।
আর তিন সন্তান বর্তমানে অধ্যয়নরত আছে। তারা হলো, মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ শরহে বেকায়া জামাত,
আব্দুল বাসেত মিজান জামাত ও আব্দুস সামাদ হিফজ বিভাগে অধ্যয়নরত আছে।
বর্তমান হাল
বিশাল এক পরিবার নিয়ে মাওলানা নুরুল ইসলাম কুরবানির ঈদের পর বাংলাদেশে আসেন। বর্তমানে হোয়াইক্যং এর উনছিপ্রাং ক্যাম্পে বেশ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
মানুষের সামনে হাতও পাততে পারেন না আত্মমর্যাদাবোধের কারণে।
রাব্বে কারিম! যেসব মজলুম মুহাজির স্বদেশ থেকে হিজরত করে আমাদের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বিশেষত আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আলেম-ওলামারা, তাদের সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, উন্নতমানের কাপড়, মানসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দাও।
এবং তাদেরকে স্বসম্মানে নিজেদের স্বদেশে ফেরৎ যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করে দাও। আমীন
লেখক, মুহাদ্দিস, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া, টেকনাফ, ককসবাজার
লেখকের আরও লেখা
কেমন আছেন আরাকানের প্রসিদ্ধ লেখক মাওলানা শিব্বির আহমদ?