মুহাম্মদ জুবাইর
টেকনাফ থেকে
মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে আহত ছেলেসহ ৮ সদস্যের পরিবার নিয়ে অসহায় ও মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন রোহিঙ্গা অন্ধ হাফেজ আবদুর রহমান।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ট্রলার ভাড়া ও মিয়ানমার সেনাদের গুলিতে আহতদের বাংলাদেশে পাঠানো বাবত বিশাল অংকের দেনার দায়ে জর্জরিত ছাড়াও গুলিবিদ্ধ ছেলের চিকিৎসার খরচ যোগাতে ভিক্ষার ঝুলি মাথায় নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন অন্ধ এ হাফেজ আবদুর রহমান (৪৮)।
৯ অক্টোবর সোমবার সকালে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প (স্থানীয় ভাষায় রোহিঙ্গা টাল) সংলগ্ন পূর্ব পাশে স্থানীয় জহির আহমদের মালিকানাধীন জমিতে নতুন অনুপ্রবেশকারী অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে মাসিক ৫০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে থাকা ঝুপড়িতে দেখা হয় অন্ধ হাফেজ আবদুর রহমানের সাথে।
তার ২য় ছেলে মোঃ আলম (১৬) মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে আহত। ডান হাতে ও ডান পায়ে গুলি লেগেছে। বেপরোয়া নির্বিচারে করা ব্রাশ ফায়ারের গুলি। তাদের বাড়ি মিয়ানমারের মংডু মেরুল্লার ঝুমপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত আবদুচ্ছালাম।
নিজে অন্ধ হলেও সুন্দর সাজানো-গোছানো সুখের সংসার ছিল তাদের। সংসারে রয়েছে স্ত্রী দিল বাহার বেগম (৩৭), পুত্র শফিক আলম (১৮), মোঃ আলম (১৬), কন্যা ফেরদৌস বেগম (১৪), ছেলে মোঃ রিদুয়ান (১২), মোঃ জোহার (১০), কন্যা হুরি জন্নাত (৮)।
অশ্রু সজল নয়নে অন্ধ হাফেজ আবদুর রহমান আওয়ার ইসলামের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহে মিয়ানমার বাহিনী ও রাখাইন মিলে যেদিন আমাদের গ্রামে অভিযান শুরু করে, তখন পুরো গ্রাম জুড়ে ভয়াবহ অবস্থা। চারদিকে গুলির শব্দ। আগুনে বসতবাড়ি পোড়ানোর গন্ধ। মার মার, কাট কাট, লুটপাট আর অসহায় রোহিঙ্গাদের আর্তচিৎকার, দিকবিদিক ছুটাছুটি। প্রাণ বাঁচানোর তাকিদে আমরাও স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ পালানোর সময় মিয়ানমার বাহিনীর বেপরোয়া নির্বিচারে করা ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে আমার ২য় পুত্র মোঃ আলম (১৬), প্রতিবেশী পুতুইয়ার পুত্র শামসুল আলম (২৩), জমির হোছনের পুত্র আক্তার কামাল (২৫), আবুল হোছনের পুত্র জাহেদ হোছন (২০) এবং রাহমতুল্লাহ (২৩) নামে অপর এক যুবকসহ ৫ জন আহত হয়।
কোন প্রকার মিয়ানমার সেনা-পুলিশ ও মগদের চোখ এড়িয়ে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় আমরা পাহাড়ে আশ্রয় নিই। একদিকে গুলিবিদ্ধদের ক্ষত স্থান থেকে রক্তক্ষরণ, অন্যদিকে সেনা আতংক, সে এক ভয়ানক অবস্থা।
প্রথমে গুলিবিদ্ধদের জরুরি চিকিৎসার জন্য ৫ লক্ষ কিয়াট ট্রলার ভাড়া কর্জ করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর আমরা বাংলাদেশে আসি। ট্রলার মালিক ভাড়ার জন্য আমাদের টেকনাফের কাটাবনিয়া গ্রামে ২ দিন ধরে আটকে রাখে।
আমাদের ট্রলারে ১৮ জন রোহিঙ্গা ছিল। পূর্ব পরিচিত ও আত্মীয়দের কাছ থেকে কর্জ নিয়ে জনপ্রতি ৩ হাজার বাংলাদেশী টাকা ভাড়া পরিশোধ করে মুক্তি পাই। এরপর ৮ দিন নতুন পল্লানপাড়া একটি বাড়ির আশ্রয়ে থেকে নতুন অনুপ্রবেশকারী অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে এখানে চলে আসি’।
মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে আহত পুত্র মোঃ আলমের চিকিৎসা বিষয়ে বলেন, ‘প্রথমে টেকনাফের সরকারী হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল।
কয়েকদিন সেখানে ভর্তি ছিল। এরপর থেকে বাসায় আছে। তার চিকিৎসার জন্যও প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে ধার-কর্জ করে। ওষুধ কিনতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এখনও ক্ষত স্থান শুকায়নি। হাতে-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। ধাক্কা-ধাক্কি করে লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণও সংগ্রহ করা যাচ্ছে না।
ট্রলার ভাড়ার দেনার টাকা, গুলিবিদ্ধ পুত্রের চিকিৎসার জন্য জরুরি ওষুধ কেনার টাকা, ঝুপড়ি বাসার মাসিক ভাড়ার টাকা এবং ৮ সদস্যের পরিবারের খরচের টাকা যোগাড় করতে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষায় নামতে হয়েছে’।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি জন্মান্ধ নই। বালক অবস্থায় ১৩ বছর বয়সে অসুস্থতায় আমার উভয় চোখ নষ্ট হয়ে যায়। মিয়ানমারে মুসলমানদের উন্নত চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই। ১৫ বছর বয়সে আমি হাইচ্ছুরাতা গ্রামে হাফেজ আবুল খায়েরের তত্বাবধানে হেফজ শুরু করি। শিক্ষক এবং সহপাঠিদের সহযোগিতায় আমি পূর্ণ পবিত্র কুরআন হেফজ সমাপ্ত করেছি।
তিনি বলেন, এখন আমি চরম অসহায়। কর্জ পরিশোধ করা দূরে থাক, গুলিবিদ্ধ ছেলে এবং জরুরি খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ঝুপড়ি বাসার মাসিক ৫০০ টাকা ভাড়া পরিশোধ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভবিষ্যৎ দিনগুলো কিভাবে কাটবে সেগুলো নিয়ে বড়ই দু:শ্চিন্তায় আছি।
মাওলানা কামালুদ্দীন; বার্মিজ সেনাদের তিনটি গুলি যার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি