সম্প্রতি ধর্ষণ অতীতের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। পাঁচ বছরের শিশু থেকে ৬৫ বছরে পৌঢ়া কেও রেহায় পাচ্ছে না পাশব ধর্ষকের হাত থেকে। এমনকি নিজের সন্তানও না। ধর্ষণের এমন ভয়াবহ প্রকোপ এবং আলেম সমাজের করণীয় সম্পর্কে বলেছেন জামিয়াতুস সুন্নাহ শিবচরের মাদারীপুরের মুহতামিম ও মাসিক আল জামিয়া’র সম্পাদক মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ আল ফরিদী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আতাউর রহমান খসরু।
আওয়ার ইসলাম : পত্র-পত্রিকা খুললেই ধর্ষণের খবর। এমন বিকৃত মানসিকতা বৃদ্ধির কারণ কি?
মাওলানা আল ফরিদী : আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ও নিরাপদ জীবনের জন্য দৃষ্টি অবনত রাখতে বলেছেন। পুরুষকেও বলেছেন, নারীকেও বলেছেন। আল্লাহ বলেছেন, নারী পুরুষ সবাই নিজ নিজ সীমানায় থাকবে। কিন্ত আমাদের শিক্ষা, সমাজ ও আইন সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সীমা অতিক্রম করে যাওয়াকেই সাফল্য বলার চেষ্টা করছে। ফলে সমাজে বিশৃংখলা বাড়ছে।
তারা যে আজ ধর্ম ও নৈতিকতামুক্ত হওয়াকে আধুনিকতা বলছে সেটাই সমাজের জন্য কাল হয়েছে। এ আধুনিকতা ইউরোপ আমেরিকাকে ধ্বংস করেছে। সেখানে আজ সমাজ নেই, পরিবার নেই। মানুষের স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা নেই।
আওয়ার ইসলাম : আপনি বলছেন, শিক্ষা, সমাজ ও আইন সর্বত্র আল্লাহর সীমা লঙ্ঘনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিষয়টি একটু স্পষ্ট করুন?
মাওলানা আল ফরিদী : কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন শিক্ষাক্ষেত্রে মূলনীতি দাঁড় করিয়েছে ‘শিক্ষা হবে ধর্মহীন’। শিশুকে ধর্মের বন্ধনমুক্ত করা এখন রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ। একটি শিশুকে তার শৈশব থেকে যদি ধর্মহীনভাবে গড়ে তোলা হয়, তার জীবনে যদি পরকালীন জবাবদিহি না থাকে, নৈতিকতার বলয়ে সে যদি জীবন কাটাতে অভ্যস্ত না হয়, তাহলে প্রবৃত্তির দাস পশুতে পরিণত হবে। এটাই স্বাভাবিক।
সহশিক্ষার বিষয়টিও বলা যেতে পারে। সহশিক্ষা শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিকতা ধ্বংস করছে। আমি মনে করি, ক্লাস ফাইভ থেকে ছেলে-মেয়েকে পৃথক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা প্রদান করা উচিৎ।
আওয়ার ইসলাম : আমাদের মতো একটি স্বল্প আয়ের দেশের পক্ষে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনার দাবি কী বাস্তবসম্মত?
মাওলানা আল ফরিদী : অবশ্যই। আমি মনে করি, সরকার চাইলে তা সম্ভব। পৃথক ব্যবস্থার অর্থ শুধু পৃথক স্কুল নয়। বরং পৃথক ক্লাসরুম বা ভিন্ন ভিন্ন শিফটও করা যেতে পারে। সকালে মেয়েরা এবং বিকেলে ছেলেরা পড়বে।
ইহকালীন জীবনই আমার সব- এ ধারণা বর্জন করতে পারলেই আমাদের পক্ষ তা করা সম্ভব। আমাদের ঈমানের দাবি হলো, আমরা আল্লাহর আনুগত্য করবো এবং রাসুল সা. এর অনুসরণ করবো।
আওয়ার ইসলাম : আর সমাজের কোন কোন বিষয় ধর্ষণকে উৎসাহিত করছে?
মাওলানা আল ফরিদী : প্রথমত, চরিত্রহীনতা যে নিন্দনীয় এ ধারণাই দেয়া হচ্ছে না। উল্টো তা উস্কে দেয়ার নানা আয়োজন আমাদের সমাজে রয়েছে। যেমন, সহশিক্ষা, নগ্ন আকাশ সংস্কৃতি, বাধাহীন অশ্লীলতা ও নগ্নতা।
এখন প্রতিটি ইউনিয়নে ইউনিয়নে নগ্নতার নখের আচড় পড়েছে। একটি অপরিপক্ক বালকও ইচ্ছে করলে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের নগ্নতা ও অশ্লীলতা দেখতে পারছে। উঠতি বয়সী তরুণ ও যুবারা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে এসব দেখে। এরপর যা ইচ্ছে তা করছে।
যতোদিন আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের চরিত্রহীনতাকে উস্কে দেয়া উপাদান দূর করা যাবে না, নিয়ন্ত্রণ করা হবে না, ততোদিন ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
আওয়ার ইসলাম : আপনি কী মনে করেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন পর্নোগ্রাফি, ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ রোধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?
মাওলানা আল ফরিদী : আমাদের প্রধান বিচারপতিও বলেছেন, আমাদের আইন -যার ভিত্তি বৃটিশ রচিত আইন- তা স্বাধীন দেশের উপযোগী নয়। শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তা নয়; বরং বৃটিশ আইনের বার্ধক্য ও ফাঁক-ফোকর অপরাধ ও অপরাধীদের লালন করছে। এ আইন আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
আওয়ার ইসলাম : আপনি বলছেন প্রচলিত আইন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর বিপরীতে পর্নোগ্রাফি, ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ দমনে ইসলামের বিধান কী?
মাওলানা আল ফরিদী : ইসলামি বিধান বলে লাভ কী? ইসলামি বিধান কার্যকর করার দায়িত্ব কোনো ব্যক্তি বা সমাজের নয়। তা ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব যথাযথ কর্তপক্ষের। তাই আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে। সরকার চাইলে আলেমগণ একটি কাঠামো তাদের সামনে তুলে ধরতে পারেন।
আওয়ার ইসলাম : সমাজে শিশুধর্ষণের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলাম ধর্ষণ ও শিশু ধর্ষণের মাঝে কোনো পার্থক্য করে কি?
মাওলানা আল ফরিদী : ধর্ষণ শব্দটি পরে আবিস্কৃত। ইসলাম বলে ব্যভিচার। ব্যভিচারকে ধর্ষণ বলার মধ্যে একটি সমস্যা আছে। ধর্ষণ বলা হয় জোরপূর্বক দৈহিক সম্পর্ককে। ব্যভিচার বলা হয় নৈতিক ভিত্তি নেই এমন যে কোনো দৈহিক সম্পর্ক ও মেলামেশাকে। ধর্ষণ আইনের চোখে অপরাধ কিন্তু ব্যভিচার নয়।
সমস্যা হলো, যে ছেলেটি কোনো নারীর সম্মতিতে অবৈধ সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে, এক সময় সে তার চাহিদা পূরণে নারীর অসম্মতিতে বা জোরপূর্বক দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করবে। তাই ব্যভিচারের বিরুদ্ধেই ইসলাম শাস্তির বিধান প্রণয়ন করেছে।
শিশু ধর্ষণও ব্যভিচার, প্রাপ্ত বয়স্ককে ধর্ষণ করাও ব্যভিচার। দুটোই অপরাধ। কোনো সন্দেহ নেই, শিশুর প্রতি অন্যায় আচরণ অনেক বেশি অমানবিক।
আওয়ার ইসলাম : রাষ্ট্র বিলম্বে বিয়ে করতে উৎসাহিত করছে। অনেকেই মনে করেন, বিলম্বে বিয়ে যৌন সহিংসতার অন্যতম কারণ।
মাওলানা আল ফরিদী : একথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন, যে বিধান আমি দিয়েছি তা যদি তোমরা মান্য না কর, তাহলে সমাজে ব্যাপক বিশৃংখলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। আল্লাহর বাণীর প্রতিফলনই আমরা দেখছি।
আওয়ার ইসলাম : ধর্ষণের ব্যাপারে আলেমদের কথা বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন?
মাওলানা আল ফরিদী : এ ব্যাপারে কথা আলেমগণই বলছে। অন্য কেউ তাদের মতো এতো বেশি বলছে না। ৪ লাখ মসজিদ থেকে ৪ লাখ খতিব প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছেন। কিন্তু মিডিয়া যেহেতু তাদের কথা প্রচার করে না, তাই তাদের অবদান ও অবস্থান মানুষের সামনে আসছে না।
যারা আলেমদের কথা শুনছে, তাদের কাছে আসছে তারা এমন ঘৃণিত কাজ থেকে দূরে আছে। যারা আসে না তাদের দ্বারাই এমন অপরাধ কর্ম হচ্ছে।
আওয়ার ইসলাম : যেহেতু যৌন অপরাধের প্রবণতা অনেক বেড়েছে তাই আলেমদের বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখার প্রয়োজন আছে মনে করেন?
মাওলানা আল ফরিদী : আমি মনে করি, সরকারের উচিৎ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে আলেমদের কথা প্রচারের ব্যবস্থা করা। কেননা সমাজ সুরক্ষার মূল দায়িত্ব সরকারের এবং সমাজ আলেমদের কথা শোনে।
আওয়ার ইসলাম : ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ দমনে বিশেষ করণীয়গুলো কী হতে পারে?
মাওলানা আল ফরিদী : বিশেষ করণীয় হিসেবে আমি উল্লেখ করবো, ইসলামি মূল্যবোধের লালন, সে আলোকে জীবনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, যৌন বিশৃংখলা উৎসাহিত করে এমন উপকরণ থেকে দূরে রাখা, শৈশব থেকে নৈতিক মূল্যবোধে গড়ে তোলা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হলো কুরআনকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা।