মুহাম্মাদ লুতফেরাব্বী
এমফিল গবেষক, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর
গত ১১ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কওমী মাদরাসার দাওরা হাদিসের সনদের স্বীকৃতি ও মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দেশের সর্বত্র পক্ষে বিপক্ষে আলোচনার ঝড় বইছে এ নিয়ে।
আজ ১২ মে স্বীকৃতি ঘোষণার এক মাস পর পেছনে একটু দৃষ্টি দিতে চাই।
এক. টক অব দ্য কান্ট্রি : প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা দেশের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যারা ইসলামকে পাশ কাটিয়ে চলত তারাও এখন নরম সুরে কথা বলছে। যারা ইসলামপন্থীদের মাথায় কাঠাল ভেংগে খেত তারা নিজেদের ব্যর্থতা লুকাতে একমুখে দশ কথা বলছে। ইচ্ছাকৃত অবহেলায় একপেশে করে রাখা দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী মুলধারার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় সব মহলেই তাদের সমীহ বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই ভোটের রাজনীতির অধীন হওয়া অনুচিত। কিন্তু ইসলামী রাজনীতি সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে এই সমীকরণের জালে নতুন কোন ফাঁদে পা না দিক এটাই কামনা করি।
দুই. মিডিয়া ও বিরোধী পক্ষ : গুরুত্বপূর্ণ যেকোন বিষয়ে দেশী - বিদেশী মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ সব সময় থাকে। এমনকি ছোটখাটো সামান্য বিষয়কেও প্রতি মুহুর্তের আপডেট আর রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে। কিন্তু গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সরকারি প্রোগ্রামের প্রচার নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো যে আচরণ করেছে তা সত্যি আশ্চর্যজনক। প্রথমদিকে মূল বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে পার্শ্ব বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও বামধারার তথাকথিত সুশীল বুদ্ধিজীবীদের আস্ফালনে এ নিয়ে আলোচনা তুলতে বাধ্য হয়। ইসলাম ও ইসলামী সকল কিছু নিয়ে সব সময় ততষ্ঠ এই বুদ্ধিজীবীরা স্বীকৃতি ঘোষণার পর থেকেই আরো বেশী হতাশ ও আতংকিত হয়ে গেছে। তাদের বক্তব্য - লেখনী থেকে তা স্পষ্ট।
এই বামপন্থী বুদ্ধি ব্যবসায়ী ও তাদের সমর্থক মিডিয়ার মনোভাব আরো স্পষ্ট বুঝা গেছে সাম্প্রতিক আলোচিত কিছু টকশো অনুষ্ঠানে। কওমী মাদরাসার শিক্ষা ও আদর্শ নিয়ে উলামায়ে কেরামের ধারালো যুক্তির প্রতিউত্তর কেউই তেমনটি করতে পারেনি। তবুও প্রোপাগান্ডা থেমে নেই।
স্বীকৃতি নিয়ে সবচেয়ে কদর্য রূপ প্রকাশ করেছে তথাকথিত সুন্নী জামায়াত। আহলে হক্ব উলামায়ে কেরামের ব্যাপারে তাদের মনে কিরূপ জিঘাংসা বিদ্যমান তা তাদের সাম্প্রতিক আচরণ ও পদক্ষেপসমূহ থেকেই বুঝা যায়।
এসব প্রতিহিংসা, অপপ্রচার ও প্রোপাগাণ্ডার তাৎক্ষণিক কার্যকর প্রতিবাদের স্বল্পতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মিডিয়া অঙ্গনে আমাদের ব্যর্থতা। গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে প্রযুক্তির শক্তিশালী ও কার্যকর ব্যবহারের প্রয়োজনিয়তা অনস্বীকার্য। সবাই এই কথা বুঝলেও সমন্বিত কোন উদ্যোগ নেই। কেন নেই এ প্রশ্নের অনেক উত্তর থাকলেও বাস্তবতা হলো, এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে আমাদের।
তিন. আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়া বাংলাদেশ : গত এক মাসে স্বীকৃতির ব্যাপারে মোটা দাগে যে অগ্রগতি দেখা গেছে তা হলো সম্মিলিত তাকমিল পরীক্ষার জন্য একটি বোর্ড গঠিত হওয়া। এই বোর্ডের অধীনেই এবছর দাওরার পরীক্ষা দিবেন শীক্ষার্থীরা।
গঠনের পর থেকেই নাম সহ নানা বিষয়ে আলোচনার কাঠগড়ায় এই প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাসংক্রান্ত সর্বোচ্চ একটি বোর্ডের নাম সবার সহজবোধগম্য করে রাখা দরকার ছিল বলে অনেক মন্তব্য করছেন। তবে এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক বিষয়ই এখানে রয়ে গেছে যার আশু সমাধান অনতিবিলম্বে জরুরি।
তন্মধ্যে অন্যতম হলো, মাস্টার্সের উপযোগী করে শিক্ষা সিলেবাস প্রণয়ন করা।
উল্লেখ্য, একটি কাজের সফলতার জন্য শুধু নৈতিক চরিত্রবান হওয়াটা যথেষ্ঠ নয়; বরং সে বিষয়ে পর্যাপ্ত দক্ষতা - অভিজ্ঞতাও প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্হা একটি জনগোষ্ঠির মেরুদণ্ড। তাই আন্তর্জাতিক মানের সিলেবাস প্রণয়নে শুধুমাত্র "বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন" নয়; শিক্ষাকারিকুলাম বিষয়ে গবেষক দেশী - বিদেশী স্কলারদের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা উচিত।
চার. ফেসবুকের লাগামহীনতা : এদেশের লক্ষাধিক মাদরাসা ছাত্র - শিক্ষকের প্রাণের দাবি কওমী সনদের স্বীকৃতি। তাই এই স্বীকৃতিকে ঘিরে কারো আগ্রহ, আশংকা, কৌতুহলের কমতি ছিলনা। প্রতিদিন পক্ষে বিপক্ষে অসংখ্য স্ট্যাটাস শুধু এ নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এত আলোচনা - সমালোচনার সারকথা খুবই সামান্য।
আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মানুষকে বর্তমানে এতটাই বাক-বুদ্ধিস্বাধীনতা দিয়েছে যে, এর নিয়ন্ত্রণ কখনো সম্ভব কিনা তা বলা মুশকিল। তাই উনিশ-কুড়ির ছোট কিশোরও লম্বা লম্বা কথা বলছে স্বীকৃতির ভালমন্দ নিয়ে।
স্বীকৃতির গতি-প্রকৃতি, শিক্ষাব্যবস্থার নানাদিক নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুয়েকজন গঠনমূলক আলোচনা করলেও সামগ্রিকভাবে কোন স্পষ্ট রূপরেখা কেউ দিতে পারেননি। এই না পারার পেছনে অনেকগুলো কারণের অন্যতম হলো অস্পষ্টতা। "ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী সাহিত্যে মাস্টার্স" এই শব্দের দাবি ও উপযোগিতার বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় পর্যায়ে (হয়ত) স্পষ্ট হলেও সাধারণভাবে পরিষ্কার নয়।
শেষ কথা, কওমী সনদের সমমানের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে প্রজ্ঞাপন আকারে এসেছে। সরকারি পর্যায়ে স্বীকৃতির অগ্রগতি এখনো পর্যন্ত এতটুকুই। এটিকে আইন আকারে পাশ করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার তেমন কিছুই এখনো চোখে পড়েনি। তাই এনিয়ে কিছু বলার নেই।
কিন্তু যে সত্যটি এখানে বলতে চাই তা হলো, শত অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো জ্বলছে কওমী মাদরাসায়। নৈতিকতা ও যোগ্যতার অপূর্ব সম্মিলন রয়েছে এখানে। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে জাতিকে একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্হা উপহার দিতে পারে এই কওমী মাদরাসা। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও অধ্যবসায়। দায়িত্বশীলগণ সেদিকে ভাববেন এই আশাই করি।
কওমি স্বীকৃতি নিয়ে তিনটি আলোচিত টকশো
প্রশ্নবাণে কওমি মাদরাসা : আমাদের নির্মম রসিকতা
আরআর